মতামত

ধর্ষণের প্রবৃদ্ধি: সমৃদ্ধি ছাগলে-পাগলে

ধর্ষণ এখন মহামারি পর্যায়ে। চলছে নন-স্টপে। কমতি নেই সিয়াম সাধনার পবিত্র রমজানেও। বর্তমানে গড়ে প্রতিদিন ধর্ষণ সংখ্যা অন্তত সাত। তাদের পাঁচজনই শিশু। পুরুষ নামের এ মানুষরূপী হায়েনারা রেহাই দিচ্ছে না দুধের শিশুকেও। প্রতিবন্ধী, মাদ্রাসাশিক্ষার্থী, নার্স-ডাক্তারসহ নারী মাত্রই এদের খুবলে খাওয়ার আইটেম। অপরাধ ঢাকতে গিয়ে এরা পৈশাচিকভাবে হত্যা করছে ধর্ষণের শিকার নারী-শিশুদের।

Advertisement

বাংলাদেশ শিশু অধিকার ফোরামের দেওয়া ধর্ষণের হিসাবটি ভয়াবহ। চলতি বছরের প্রথম চার মাসেই ধর্ষিত হয়েছে ২৮৬টি শিশু। এর মধ্যে গণধর্ষণ ৩৫। প্রতিবন্ধী শিশু ১৪। ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে ১৬ জন শিশুকে।

ধর্ষণের পর আত্মহত্যা করেছে ১০ শিশু। মানবাধিকার সংগঠন ‘মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের হিসাবে চলতি মাসের প্রথম আট দিনেই ৪১ শিশু ধর্ষিত হয়েছে। এদের মধ্যে রয়েছে চার ছেলে শিশুও। মহিলা পরিষদসহ আরো কিছু প্রতিষ্ঠানেরও এ সংক্রান্ত হিসাব রয়েছে।

পত্রিকাসহ গণমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্যই তাদের হিসাবের মূল ভিত্তি। বলার অপেক্ষা থাকে না, এর বাইরে ধর্ষণের আরো ঘটনা অপ্রকাশিত থেকে যাচ্ছে। এদিকে, ছাগলামির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে পাগলামিও। সাম্প্রতিক এক হিসাব মতে, দেশে প্রতি ১০০ জনের ৩৪ জনই মানসিক ব্যাধিগ্রস্ত। এ হার কেবল বাড়ছেই।

Advertisement

স্বাস্থ্য অধিদফতরের হেলথ বুলেটিন-২০১৮ এর পরিসংখ্যান বলছে, দেশে প্রাপ্ত বয়স্কদের ১৬ দশমিক ১ ভাগ মানসিক রোগী। ১৮ বছরের কম বয়সী শিশু-কিশোরদের মধ্যে এ হার ১৮ দশমিক ৪। ২০০৯ সালে হওয়া সর্বশেষ জাতীয় সমীক্ষার ফলাফল অনুযায়ী প্রতি পাঁচজনের মধ্যে অন্তত একজন কোনো না কোনো মানসিক রোগাক্রান্ত।

মনোরোগ বিশেষজ্ঞসহ সংশ্লিষ্ট মহল থেকে বলা হচ্ছে, এই সংখ্যা এখন কয়েক গুণ বেড়েছে। গত ক’দিন ধরে পাবনার মানসিক হাসপাতালে অস্বাভাবিক মাত্রায় রোগী বাড়ছে। তাদের সামলাতে হিমশিম খাচ্ছে পাগলের হাসপাতাল নামের বিশেষায়িত প্রতিষ্ঠানটির ডাক্তার-নার্সসহ সংশ্লিষ্টরা। চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, সেখানে সুস্থ হওয়া অনেক রোগী নতুন রোগীদের সঙ্গে থাকতে থাকতে ফের রোগী হয়ে গেছেন। হাসপাতালের পরিসংখ্যান বিভাগের তথ্যমতে, ৫০০ শয্যাবিশিষ্ট পাবনা মানসিক হাসপাতালে গত ১০ বছরে ভর্তি হয়েছে প্রায় ১৫ হাজার রোগী।

কিছুটা সুস্থ হওয়ার পর ছাড়পত্র দেওয়া হয়েছে ১৩ হাজারের বেশি জনকে। এ পরিসংখ্যানে বেশিরভাগ রোগী সুস্থ হয়ে বাড়ি ফেরার কথা বলা হলেও বাস্তব চিত্র ভিন্ন। সুস্থ হওয়া অনেকে বারবার ফিরছেন হাসপাতালে। তাদের মধ্যে ৩ থেকে ১৫ বার পর্যন্ত পুনরায় ভর্তি হয়েছে। কী ভয়াবহ তথ্য!

প্রথমত লক্ষণ দেখে মানসিক রোগী শনাক্ত করেন এ রোগের চিকিৎসকরা। পরে চিকিৎসা চলে নানা পর্বে। অনিয়ম, বিশৃঙ্খলা, নানামুখী চাপ, বেশুমার প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তি, লোভ, ক্রোধ, প্রতিহিংসা, বিচারহীনতা মানুষকে মানসিক রোগীতে পরিণত করে ছাড়ছে বলে অভিমত বিশেষজ্ঞ ও চিকিৎসকদের। কেউ মানসিক রোগে আক্রান্ত হলে তার আচরণে নানা পরিবর্তন আসে। বেহুদাও হাসে-কাঁদে। চিৎকার করে কথা বলে। আবার গম্ভীর ভাব নিয়ে চুপসে যায়। কখনো বিষণ্ণ থাকে। আবার উৎফুল্লও হয়। মন যা চায় তা-ই বলে। তা-ই করে। এসব লক্ষণ দৃষ্টে দেশে পাগল বা মনোরোগীর সংখ্যা বের করা কঠিন। ক’জনের মধ্যে নেই এসব লক্ষণ? কে আমরা এ রোগমুক্ত?

Advertisement

অবস্থা যে পর্যায়ে এসে ঠেকেছে সেখানে কাউকে পাগল বলার অবস্থাও নেই। বললে নির্ঘাত বিপদে পড়তে হবে। কারণ প্রভাবগত দিক থেকে এ শ্রেণিই সংখ্যাগুরু। তাদেরই জয়জয়কার। তাদের কেউ বাধা দিচ্ছে না। বরং সমর্থন বেশি পাচ্ছে পাগলামি করা গোষ্ঠিটি। পাগলামিসহ তাদের অনাচার স্মার্টনেস হিসেবে একটা শিল্পমান পেয়ে যাচ্ছে। তারা যা করছেন-বলছেন সবই চলনসই। সমর্থনও ব্যাপক। অচল হিসেবে কেউ বাধ সাধছেন না। বলছেন না, একটু থামলে ভালো হয়। আর সুস্থ-বিবেকবানরা পড়ে গেছেন সংখ্যালঘুর কাতারে। যার জেরে মনুষ্যত্বের সংখ্যা ও মানের তথ্য-সাবুদ বড় দুর্বল। মানব সম্পদ উন্নয়নে অব্যাহতভাবে পেছাচ্ছে বাংলাদেশ।

মানব সম্পদ ও মনুষ্যত্বের উন্নয়নের এ করুণ দশার মধ্যেও পশুত্বের প্রবৃদ্ধি-সমৃদ্ধি আকাশ ছোঁয়ার মতো। ছাগলে বাম্পপার। গোল্ডেন জিপিএ। ছাগল উৎপাদনে বিশ্বে অব্যাহতভাবে শীর্ষত্ব ধরে রেখেছে বাংলাদেশ। অবস্থান চতুর্থ স্থানে। ছাগলামির নিত্য উন্নতি হলেও ছাগলের বাম্পার ফলনের আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি নেই। প্রচারও নেই। এতে স্বীকৃতিটি পড়ে রয়েছে অজান্তে, আড়ালে, অবহেলার তলানিতে।

প্রায় এক যুগ ধরে ছাগল বিষয়ে কাজ করছে জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষিবিষয়ক সংস্থা-এফএও এবং আন্তর্জাতিক আনবিক গবেষণা কেন্দ্র-আইএইএ। সংস্থা দুটির মূল্যায়নে এসেছে পিলে চমকানো এ তথ্য। তারা জেনেছে বাংলাদেশে এখন ছাগলের সংখ্যা কমছে কম আড়াই কোটি। দেশের প্রায় এক কোটি লোক ছাগল পালন করে। একক কোনো প্রাণী পালনের ক্ষেত্রে এটা একটা রেকর্ড।

এ অগ্রযাত্রা অব্যাহত থাকলে ছাগল উৎপাদনে ভবিষ্যতে ফোর্থ পজিশন থেকে ফার্স্ট-সেকেন্ড পজিশন কঠিন হওয়ার নয়। পাগলামির সমান্তরালে ছাগলামির এ সমৃদ্ধি বুঝতে কারো বিশেষজ্ঞ হওয়া জরুরি নয়। পাতালে ওড়া ক্ষ্যান্ত দিয়ে মাটিতে না নামা পর্যন্ত এ থেকে নিস্তার মেলার সুযোগ নেই।

সেঞ্চুরিয়ান ধর্ষক দলীয় অভিভাবকত্বে বিদেশে যাওয়ার সুযোগ পেতেই থাকবে। নেতৃত্ব পরম্পরায় চলতেই থাকবে ধর্ষণ বা ধর্ষণের হুমকি দেওয়া । উপচে পড়বে মনগড়া গলাবাজি। বাংলাদেশকে বাংলাদেশ বানানোর জন্য করা মুক্তিযুদ্ধের চেতনা গাড়ি ছুটবে কানাডা-সিঙ্গাপুরে। আর পাবলিক টয়লেটে দেখতে থাকবো পাঁচতারা হোটেল।

পুনশ্চঃ খুব বেশি দিন আগের কথা নয়। বাংলাদেশে প্রথম ২৪ তলা বিল্ডিং হয়েছে। তখন সেই চব্বিশ তলা নিয়ে অনেক কথার সঙ্গে ছিল কিছু রসকথাও। তার মধ্যে একটা হলো- এক লোক চব্বিশ তলার উপর থেকে দেখলেন নীচে একটি এক টাকার স্বর্ণের কয়েন পড়ে আছে । তিনি সেটা নিতে দে ছুট।

কিছু দূর নেমে দেখলেন ওটা ওখানে আছে কিনা । তখন দেখে মনে হলো না এটা স্বর্ণের নয়, রূপার মুদ্রা। আরো কয়েক তলা নেমে দেখলে সেটা চার আনা শিকির মতো মনে হয় । আরো কিছু দূর নেমে দেখলেন সেটা আট আনার মতো। তারপর একেবারে নিচে নেমে দেখলেন এটা আসলে ম্যানহোলের ঢাকনা ।

লেখক : সাংবাদিক-কলামিস্ট; বার্তা সম্পাদক, বাংলাভিশন।

এইচআর/জেআইএম