বিশেষ প্রতিবেদন

ফায়ার হাইড্রেন্ট নেই ঢাকার রাস্তায়!

রাজধানীর নিমতলীর পর আগুনের বড় ধাক্কা লাগে চুরিহাট্টায়। চকবাজারের চুরিহাট্টার শোক কাটতে না কাটতেই বনানীর এফআর টাওয়ারে আগুনের ঘটনা, এরপর গুলশান। প্রায়দিনই রাজধানীর কোথাও না কোথাও আগুন লাগছে। আগুনে শুধু মানুষ নয়; নিরাপদে থাকার স্বপ্নও পুড়ছে নগরবাসীর। একের পর এক অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় সবাই যেন দিশেহারা। সবচেয়ে বড় হতাশাজনক বিষয় হলো, আগুন নিয়ে সেবাদানকারী সংস্থাগুলোর কার্যকর উদ্যোগ না নেয়া।

Advertisement

অগ্নিদুর্ঘটনার হাত থেকে জানমাল ও সম্পদ রক্ষার কার্যকর ব্যবস্থা হলো ফায়ার হাইড্রেন্ট সিস্টেম (পানি সরবরাহের উৎস)। বিশ্বের প্রায় সব শহরে অগ্নিদুর্ঘটনা রোধে এ ব্যবস্থা গড়ে তোলা হলেও ব্যতিক্রম শুধু ঢাকা।

আরও পড়ুন >> সেলফি না তুলে এক বালতি পানি আনলেও উপকার হয় : প্রধানমন্ত্রী

অপরিকল্পিত এ নগরীতে ফায়ার হাইড্রেন্ট ব্যবস্থা গড়ে তোলার কোনো উদ্যোগই নেয়া হয়নি। এ ব্যবস্থা গড়ে তোলার দায়িত্ব পানি সরবরাহ ও পয়ঃনিষ্কাশন কর্তৃপক্ষ- ওয়াসার। কিন্তু ঢাকার কোথাও একটি ‘স্ট্রিট ফায়ার হাইড্রেন্ট’ স্থাপন করা হয়নি। অথচ, শহরের গুরুত্বপূর্ণ সড়ক কিংবা এলাকা এবং মার্কেট সংলগ্ন এলাকায় একটি করে ফায়ার হাইড্রেন্ট স্থাপনের কথা।

Advertisement

তবে ঢাকা ওয়াসা কর্তৃপক্ষ বলছে, ঢাকায় রয়েছে তাদের ৮৬৫টি পাম্প। সবগুলো পাম্প স্টেশনেই রয়েছে ফায়ার হাইড্রেন্ট সিস্টেম। চলতি বছরেই ঢাকায় বসানো হবে কয়েক হাজার ফায়ার হাইড্রেন্ট।

আরও পড়ুন >> প্রথম জীবনের মৃত্যু হয়েছে, দ্বিতীয় জীবন পেলাম

ফায়ার হাইড্রেন্ট হচ্ছে পানির একটি সংরক্ষণাগার। এখানে উচ্চ চাপে পানি সংরক্ষিত হয়। ফলে কাছাকাছি কোথাও আগুন লাগলে এ পয়েন্টে পাইপ লাগিয়ে সহজেই আগুন নেভানোর ব্যবস্থা করা যায়।

ঢাকায় অগ্নিকাণ্ডের অধিকাংশ ঘটনায় পানি সংকটের কথা শোনা যায়। এক্ষেত্রে উন্নত বিশ্বে ব্যবহৃত হয় ফায়ার হাইড্রেন্ট।

Advertisement

আরও পড়ুন >> মামা, মাকে কিন্তু আজ নিয়েই যাব

বিশেষজ্ঞ ও ফায়ার সার্ভিসের কর্মকর্তারা বলছেন, নিমতলী ও চকবাজারে ফায়ার সার্ভিসকর্মীরা প্রয়োজনীয় পানি সরবরাহের অভাবে দ্রুত আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে পারেননি। একই সমস্যা লক্ষ্য করা গেছে বনানীর এফআর টাওয়ারের আগুনেও। ফলে আগুনের ব্যাপ্তি আর ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ বেড়েছে। ফায়ার হাইড্রেন্ট থাকলে পানির সংকটে পড়তে হতো না ফায়ার ফাইটারদের।

জানা যায়, নবাবি আমলেও ঢাকায় কার্যকর পানি ব্যবস্থাপনা ছিল। ঢাকার দ্বিতীয় নবাব আবদুল গণি (১৮৩০ - ১৮৯৬) তার শাসনামলে বেশকিছু জনহিতকর কাজ করেন। তার মধ্যে অন্যতম ছিল ঢাকার পানি ব্যবস্থাপনা অর্থাৎ ফায়ার হাইড্রেন্ট সিস্টেম। পানি পরিশোধন করে বিনামূল্যে সেই পানি নগরবাসীর জন্য সরবরাহের ব্যবস্থা করেন তিনি। ওই পানি খাওয়া ও গোসলের কাজে ব্যবহার করতেন নগরবাসী।

সময়ের বিবর্তনে ওই হাইড্রেন্ট সিস্টেম অকার্যকর হয়ে পড়ে। সেই সঙ্গে উধাও হতে থাকে রাজধানীর জলাশয় ও পুকুরগুলো। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রায় বসবাস অনুপযোগী এই ঢাকা শহরে অগ্নিদুর্ঘটনায় জানমাল ও সম্পদের ক্ষতি কমিয়ে আনতে সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন দ্রুতগতির পানির সরবরাহ ব্যবস্থা। সেটা মেটাতে স্ট্রিট ফায়ার হাইড্রেন্টের বিকল্প নেই।

আরও পড়ুন >> চকবাজারের আগুনের এক্সক্লুসিভ ভিডিও

২০১১ সালে ঢাকা সিটি কর্পোরেশনকে উত্তর ও দক্ষিণে বিভক্ত করা হয়। লক্ষ্য ছিল একটাই, নগরকে আধুনিক ও সুন্দর করে গড়ে তোলা এবং নাগরিক সেবা নিশ্চিত করা। কিন্তু অগ্নিদুর্ঘটনা রোধ কিংবা দ্রুত আগুন নেভাতে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে দেখা যায়নি কোনো প্রতিষ্ঠানকে।

ফায়ার সার্ভিস অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে একাধিকবার এ বিষয়ে গুরুত্ব তুলে ধরে ফায়ার হাইড্রেন্ট স্থাপনের তাগিদ ও পরামর্শ দেয়া হলেও তা বাস্তবায়ন শূন্যের কোটায় রয়েছে।

আরও পড়ুন>> অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রীর জন্য আত্মাহুতি দিলেন স্বামী

এ বিষয়ে জানতে চাইলে ফায়ার সার্ভিসের উপ-পরিচালক (অপারেশন ও মেইনটেন্যান্স) দেবাশীষ বর্ধন জাগো নিউজকে বলেন, ‘রাজধানীতে প্রায়দিনই ঘটছে অগ্নিদুর্ঘটনা। অধিকাংশ সময় পানির স্বল্পতার কারণে আগুন নেভাতে বেগ পেতে হয় ফায়ার ফাইটারদের। সরু রাস্তায় পানি বহনকারী গাড়িগুলো প্রবেশ করতে পারে না। বাড়ির নিচের রিজার্ভ ট্যাংকগুলোতে পর্যাপ্ত পানি থাকে না। এছাড়া নগরীর বিভিন্ন স্থানে থাকা জলাধারগুলো ভরাট করে ভবন নির্মাণ করা হয়েছে। ফলে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনার সময় পানির সংকটে পড়তে হয় ফায়ার সার্ভিসের সদস্যদের। এ সংকট কাটাতে জরুরি ভিত্তিতে ফায়ার হাইড্রেন্ট সিস্টেমে যাওয়া প্রয়োজন।’

আরও পড়ুন >> ২৬ দিনেই বিধবা হলেন স্মৃতি

তিনি বলেন, ‘পুরান ঢাকাসহ সারা শহরে স্ট্রিট হাইড্রেন্ট বসাতে সিটি কর্পোরেশন ও ওয়াসাকে অনেক আগে থেকে অনুরোধ করা হচ্ছে। কিন্তু ফলাফল এখনও শূন্য।’

রাজধানীতে খুব দ্রুত ফায়ার হাইড্রেন্ট স্থাপনের ওপর গুরুত্বারোপ করে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের (বিআইপি) সাধারণ সম্পাদক পরিকল্পনাবিদ ড. আদিল মুহাম্মদ খান জাগো নিউজকে বলেন, ‘ঢাকা হচ্ছে বিশ্বের সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ শহর। অপরিকল্পিত নগরও বটে। সঙ্গত কারণে এখানে অগ্নিঝুঁকিও বেশি। কিন্তু আপনি যদি মানুষের জীবনকে গুরুত্ব দেন তাহলে আগুন ঠেকাতেই হবে।’

‘অগ্নিদুর্ঘটনা রোধে ফায়ার হাইড্রেন্ট স্থাপন খুবই জরুরি। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে, ঢাকা শহরে এ ধরনের কোনো ব্যবস্থা নেই।’

আরও পড়ুন >> বনানীর এফআর টাওয়ারে আগুন

তিনি বলেন, ‘পরিকল্পিত এলাকায় তো বটেই, ঢাকার অপরিকল্পিত এলাকার জন্যও বেশি কার্যকর ফায়ার হাইড্রেন্ট সিস্টেম। চুরিহাট্টার আগুনের সময় পানি সরবরাহে সমস্যা ছিল। সেখানে ফায়ার হাইড্রেন্ট থাকলে আগুন আরও আগে নিয়ন্ত্রণ করা যেত। ঢাকার সব স্থানেই ফায়ার হাইড্রেন্ট দ্রুত সময়ের মধ্যেই স্থাপন করা সম্ভব এবং সে সুযোগও রয়েছে। শুধু সংশ্লিষ্টদের উদ্যোগটা জরুরি।’

আরও পড়ুন >> ‘বাবার জন্য রক্ত দিয়েছে, মাকে দিচ্ছে সান্ত্বনা’

বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) যুগ্ম সম্পাদক স্থপতি ইকবাল হাবিব জাগো নিউজকে বলেন, ‘সময় এসেছে পরিকল্পনার। উদ্যোগটা জরুরি। আগে প্ল্যান করতে হবে। ফায়ার হাইড্রেন্ট বেশি দরকার ঘনবসতিপূর্ণ এলাকাগুলোতে। সেখানে প্ল্যান ও ম্যাপ করে দেখতে হবে কী সংখ্যক হাইড্রেন্ট স্থাপন করতে হবে।’

‘প্রকল্প গ্রহণ করা গেলে ছয় মাস থেকে এক বছরের মধ্যেই তা বাস্তবায়ন সম্ভব। তবে বলে রাখা দরকার, বিদ্যমান ব্যবস্থাপনায় ফায়ার হাইড্রেন্ট স্থাপন করা ঠিক হবে না। এজন্য আলাদা লাইন ও আলাদা পাইপ ও প্রেসার তৈরির মেশিনও স্থাপন করতে হবে। আবার পুকুর, জলাশয় উদ্ধার করে সেখান থেকে হাইড্রেন্ট লাইন স্থাপন করে দ্রুত পানির সরবরাহও করা সম্ভব।’

আরও পড়ুন >> থাইগ্লাসে ‘মৃত্যুকূপে’ পরিণত হয়েছিল এফআর টাওয়ার

এ বিষয়ে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব মো. মোহসীন জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমাদের মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে যৌথ সভায় স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় ও সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠান ওয়াসাকে ফায়ার হাইড্রেন্ট স্থাপনের জন্য বারবার তাগিদ দেয়া হয়েছে। বনানী ও চুরিহাট্টার পর এটার গুরুত্ব এখন আমরা সবাই অনুভব করছি। আশা করছি, সংশ্লিষ্টরা সহসা এ ব্যাপারে উদ্যোগ নেবেন।’

আরও পড়ুন >> ২৬ মিডিয়া ভবনের ১৮টিই অতি অগ্নিঝুঁকিতে

এ বিষয়ে ঢাকা ওয়াসার পরিচালক (টেকনিক্যাল) এ কে এম শহিদ উদ্দিন জাগো নিউজকে বলেন, ‘ঢাকা শহরে আমাদের ফায়ার হাইড্রেন্ট নেই, এমন নয়। ঢাকায় আমাদের ৮৬৫টি পাম্প স্টেশন আছে, সেখানেও এ সিস্টেম আছে। তবে তা পর্যাপ্ত নয়। অগ্নিঝুঁকিতে থাকা এলাকায় এটি সবসময় কার্যকরও নয়।’

তিনি বলেন, ‘শহরের গুরুত্বপূর্ণ সড়ক কিংবা এলাকা এবং মার্কেট সংলগ্ন এলাকায় ওয়াসার পক্ষ থেকে ২০০ ও ৩০০ মিটার অন্তর অন্তর একটি করে ফায়ার হাইড্রেন্ট স্থাপন করা হবে। প্রকল্প তৈরির কাজ চলছে। আশা করা যায়, চলতি বছরেই এ কাজ শুরু হবে।’

আরও পড়ুন >> নিমতলী ট্র্যাজেডি : সুপারিশ বাস্তবায়নে নিষ্ক্রিয়তা কেন অবৈধ নয়

প্রসঙ্গত, ২০১০ সালের ৩ জুন পুরান ঢাকার নবাব কাটরার নিমতলীর ৪৩ নম্বর বাড়িতে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। ওই আগুনে ঝরে যায় ১২৪ প্রাণ। রাসায়নিকের গুদামে রক্ষিত দাহ্য পদার্থের কারণে পুরান ঢাকার নবাব কাটরার নিমতলীতে ভয়াবহ আগুন ছড়িয়ে পড়ে বলে তদন্তে উল্লেখ করা হয়। এরপর গত ২০ ফেব্রুয়ারি রাতে রাজধানীর চুড়িহাট্টায় ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে নিহত হন ৭১ জন এবং আহত হন অনেকে।

আরও পড়ুন >> খিলগাঁও বাজারের আগুন নিয়ন্ত্রণে

ওই ঘটনার পর রাজধানীর অগ্নিদুর্ঘটনা রোধে নড়েচড়ে বসে সংশ্লিষ্ট সেবাদানকরী প্রতিষ্ঠানগুলো। চুড়িহাট্টার আগুনের রেশ কাটতে না কাটতেই গত ২৮ মার্চ বনানীর এফআর টাওয়ারে অগ্নিকাণ্ডে ২৬ জন নিহত এবং ৭১ জন আহত হন। এর একদিন পর ৩০ মার্চ গুলশান ডিএনসিসি মার্কেটে আগুন লাগে। সর্বশেষ গত বুধবার (৩ এপ্রিল) রাতে রাজধানীর খিলগাঁও ফ্লাইওভারের নিচে কামারপট্টি বাজারে আগুন লাগে।

জেইউ/এনডিএস/এমএআর/পিআর