দেশজুড়ে

আব্দুল জলিলের অবদানে বেঁচে আছেন অনেক কিডনি রোগী

সূচরিতা দেবনাথ। ২০১৬ সালে নওগাঁ সরকারি কলেজ থেকে বাংলা বিষয়ে মাস্টার্স করেছেন। বাড়ি বগুড়ার আদমদীঘি উপজেলার সান্তাহারের দৈনিক বাজারে। তিন ভাই-বোনের মধ্যে তিনি ছোট। বাবা মুদি দোকানি। চোখে মুখে তার সোনালি স্বপ্ন। পড়াশোনা শেষ করে কলেজে শিক্ষকতা করবেন। কিন্তু সেই স্বপ্ন ভেঙে গেছে তার। শরীরে বাসা বেঁধেছে মরণব্যাধি কিনডি রোগ।

Advertisement

মাস্টার্সে পড়াশোনা করার সময় কোমরে ব্যথা অনুভব করেন। এরপর চিকিৎসকের পরামর্শে গ্যাসের ও ব্যথার ট্যাবলেট খেতে থাকেন। কিন্তু কোনো উপশম না হওয়ায় শরীর ও পা ফুলতে থাকে। এরপর ভারতে গিয়ে ধরা পড়ে কিনডির সমস্যা।

সেখানে ৩২ দিন চিকিৎসা শেষে ফিরে আসেন দেশে। এতে তার খরচ হয় প্রায় ৭ লাখ টাকা। মঙ্গলবার নওগাঁ সদর হাসপাতালে ডায়ালাইসিস সেন্টারে সূচরিতা দেবনাথ চিকিৎসা নিচ্ছিলেন। এ সময় কথা হয় তার সঙ্গে। তার স্বপ্ন নিয়ে অনেক দুঃখ প্রকাশ করেন।

সূচরিতা দেবনাথ বলেন, এখন সপ্তাহে দুবার হাসপাতালে ডায়ালাইসিস নিচ্ছি। নওগাঁ থেকে প্রায় ৫ কিলোমিটার দূরে বাড়ি হওয়ায় কিছুটা সুবিধা পাচ্ছি। বাড়ি থেকে একা এসে চিকিৎসা নিয়ে আবার ফিরে যেতে পারছি। ডায়ালাইসিসের পর শরীর তেমন ভালো থাকে না। আমাদের মতো রোগীরা বেশি দূর বাসে করে যেতেও পারে না। নওগাঁ সদর হাসপাতাল কাছে হওয়ায় একদিকে যেমন যাতায়াতে ভোগান্তির হাত থেকে রক্ষা পাচ্ছি, অন্যদিকে ভালো চিকিৎসা সেবাও পাওয়া যাচ্ছে।

Advertisement

তিনি বলেন, চোখে মুখে অনেক স্বপ্ন ছিল পড়াশোনা শেষ করে কলেজের শিক্ষক হবো। কিন্তু সেই আশা এখন গুড়েবালি। স্বপ্নগুলো ম্লান হয়ে গেছে, অন্ধকার দেখছি। এখন পর্যন্ত প্রায় ১২ লাখ টাকার মতো খরচ হয়েছে। চিকিৎসার খরচ বহন করতে গিয়ে সংসারে এখন টানাপোড়েন শুরু হয়েছে। তারপরও পরিবার থেকে চিকিৎসার  চেষ্টা করছে। সাতদিন পর পর শরীরে রক্ত উৎপাদনের জন্য ইনজেকশন দিতে হয়। যেটা ভারত থেকে নিয়ে আসতে হয়। তিন মাস পর পর ভারতে গিয়ে চেকআপ করিয়ে আসি। যদি কোনো কিনডি ডোনার পাওয়া যায় তাহলে বেঁচে থাকা সম্ভব।

শুধু সূচরিতা নন। হাজার হাজার মানুষ এখন কিনডি রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। বেঁচে থাকার জন্য শরীরে দুটি কিডনির ভূমিকা অপরিসীম। যদি এটি নষ্ট হয়ে যায় পুনরায় শরীরে স্থানান্তর করা সম্ভব না হলে মৃত্যু অবধারিত। তারপরও মানুষ বেঁচে থাকার জন্য প্রাণপণ লড়াই করেন। অনেকে আবার জীবনের শেষ সম্বলটুকু বিক্রি করেন। কেউ বেঁচে থাকেন। কেউ মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করে হেরে যান।

নওগাঁ সদর আধুনিক হাসপাতাল সূত্রে জানা যায়, ২০১২ সালের আগস্টে মরহুম জননেতা আব্দুল জলিল নওগাঁবাসীর সুবিধার জন্য মার্কেন্টাইল ব্যাংক ফাউন্ডেশনের সৌজনে দুই শয্যাবিশিষ্ট ‘আব্দুল জলিল হেমো ডায়ালাইসিস সেন্টার’ চালু করেন। এরপর ২০১৩ সালে আরও তিনটি মেশিন বাড়িয়ে মোট পাঁচটি মেশিন দিয়ে অদ্যাবধি ডায়ালাইসিস সেবা প্রদান করা হচ্ছে। ডায়ালাইসিস চালুর পর থেকে ২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ৮ হাজার ৪২১ জন রোগী সেবা নিয়েছেন। একজন রোগীর ডায়ালাইসিসের জন্য প্রথমে ২ হাজার ৯শ টাকা খরচ হয়। এরপর দ্বিতীয়, তৃতীয় ও চতুর্থ ধাপে ১ হাজার ৯শ টাকা করে খরচ হয়। চারটি ধাপ শেষ হলে আবার নতুন করে ২ হাজার ৯শ টাকা দিয়ে ডায়ালাইসিস শুরু করতে হয়।

ছুটির দিন ছাড়া প্রতিদিন সকাল ৯টা থেকে দুপুর আড়াইটা পর্যন্ত এক শিফটে পাঁচটি মেশিনের সাহায্যে সেবা দেয়া হচ্ছে। তবে মেশিনের সংখ্যা কম হওয়ায় ডায়ালাইসিস সেন্টারে তালিকাভুক্ত রোগীদের সিরিয়াল অনুসারে ডেকে সেবা দেয়া হয়। এখানে কিডনি রোগ বিশেষজ্ঞ ডাক্তার ছাড়াই হাসপাতালে কর্মরত ডাক্তার এবং সেবিকারা চিকিৎসা দিচ্ছেন।

Advertisement

গত ৮ বছরে হাসপাতালে কিডনি রোগীর সংখ্যা বৃদ্ধি পেলেও বাড়েনি যন্ত্রপাতি। সেবার মান ভালো হওয়ায় অন্য জেলা থেকেও এ হাসপাতালে আসছেন কিডনি রোগীরা। ‘হেপাটাইটিস বি পজেটিভ মেশিন’ না থাকায় রোগীদের অন্যত্র চলে যেতে হচ্ছে। জেলার ১১টি উপজেলা ছাড়াও বগুড়া, জয়পুরহাট জেলা থেকেও কিডনি রোগীরা সেবা নিয়ে থাকেন। এতে একদিকে যেমন বাড়ছে রোগীর চাপ, অপরদিকে পর্যাপ্ত যন্ত্রপাতি ও জনবল না থাকায় সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন রোগীরা। কিডনির চিকিৎসায় পর্যাপ্ত যন্ত্রপাতি ও জনবল দেয়ার দাবি জানিয়েছেন রোগী ও সচেতনরা।

নওগাঁ শহরের কোমাইগাড়ী মহল্লার বাসিন্দা গৃহবধূ সোহানী কাদের সানজু বলেন, গত চার বছর আগে ঘাড়ে প্রচুর ব্যথা হতো। প্রেসার মাপার পর হাই প্রেসার দেখা যায়। এরপর ডাক্তারের পরামর্শে বিভিন্ন চেকাপের পর দেখা যায় দুটো কিনডি নষ্ট হয়ে গেছে। প্রথমে বগুড়াতে ডায়ালাইসিস করা হয়। এরপর গত সাড়ে তিন বছর থেকে সদর হাসপাতালে সপ্তাহে দুইবার চিকিৎসা নিচ্ছেন। বাড়ির পাশে যেমন ভালো সেবা পাচ্ছেন, অপরদিকে ভোগান্তির হাত থেকে রক্ষা পাচ্ছেন।

সানজুর স্বামী রায়হান শামীম বলেন, রোগীকে ভালো খাবার দিতে হয়। ডায়ালাইসিসের পাশাপাশি ওষুধপত্র কিনতে হয়। এক কথায় এ রোগীর জন্য প্রচুর টাকা খরচ হয়। একটা পরিবারে যখন এ রোগ চলে আসে তা সম্পূর্ণ দুর্ভাগ্য। সবার পক্ষে এ রোগের চিকিৎসা করানো সম্ভব হয় না। তখন মনে হয় রোগীটা মারা গেলেই বুঝি ভালো হতো। অভিজ্ঞ চিকিৎসক, জনবল এবং পর্যাপ্ত যন্ত্রপাতি না থাকায় আমরা যথেষ্ট সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছি। এ ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রীর সুদৃষ্টি কামনা করেছেন তিনি।

শহরের হাট-নওগাঁ মহল্লার বাসিন্দা বয়জ্যেষ্ঠ গোলাম রাব্বানী বলেন, তিনি ডায়াবেটিসের রোগী। গত তিনমাস আগে চিকিৎসার জন্য চেন্নাই যাওয়ার পর সেখানে পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর কিনডিতে রোগ ধরা পড়ে। বাড়ি থেকে বার বার বলা হচ্ছিল ডায়ালাইসিস নিতে হবে। আমি নিতে চাইছিলাম না। শেষে বাধ্য হয়ে ডায়ালাইসিস নিতে হচ্ছে।

ডায়ালাইসিস সেন্টারে দেখভালকারী হায়াত মাহুমদ বলেন, আমরা এক শিফটে ছুটির দিন ছাড়া প্রতিদিন সকাল ৯টা থেকে দুপুর আড়াইটা পর্যন্ত পাঁচটি মেশিনে দুইজন সেবিকা দিয়ে সেবা দিয়ে থাকি। সেবার মান ভালো হওয়ায় অন্য জেলা থেকেও রোগীরা আসেন। দিন দিন এ রোগীর সংখ্যা বাড়ছে। মেশিনের সংখ্যা কম হওয়ায় তালিকাভুক্ত রোগীদের সিরিয়াল অনুসারে ডেকে সেবা দেয়া হয়।

নওগাঁ আধুনিক সদর হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসক ডা. মুনির আলী আকন্দ বলেন, এ জেলা ছাড়াও বাইরের জেলা থেকে কিডনি রোগীরা সেবা নিয়ে থাকেন। যে পরিমাণ রোগী আছে তার তুলনায় মেশিনের সংখ্যা কম। ডায়ালাইসিস সেন্টারে কোনো কিডনি বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক না থাকায় হাসপাতালে কর্তব্যরত চিকিৎসক ও নার্সদের দিয়ে রোগীদের সেবা দেয়া হচ্ছে। এছাড়া ‘হেপাটাইটিস বি পজেটিভ’ মেশিন জরুরি প্রয়োজন। এ মেশিন থাকলে রোগীদের সেবার মান আরও বৃদ্ধি পাবে।

আব্বাস আলী/এমএএস/পিআর