সিলেটের ঐতিহাসিক স্থাপনা ‘আবু সিনা ছাত্রাবাস’ ভেঙে হাসপাতাল নির্মাণের উদ্যোগের প্রতিবাদে বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন-বাপা সিলেটের উদ্যোগে দু'দিনের কর্মসূচি পালন করছে।
Advertisement
কর্মসূচির অংশ হিসেবে মঙ্গলবার দুপুর সাড়ে ১২টায় কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের সামনে মানববন্ধন করা হয়। মানববন্ধন শেষে আন্দোলনকারীরা আবু সিনা ছাত্রাবাস পরিদর্শন করেন।
মানববন্ধনে বাপার নেতাকর্মী ছাড়াও সিলেটের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থাপত্যবিভাগের শিক্ষক-শিক্ষার্থী, বিভিন্ন সাংস্কৃতিক ও নাগরিক সংগঠনসহ প্রগতিশীল রাজনৈতিক নেতারা কর্মসূচির সঙ্গে একাত্মতা পোষন করে বক্তৃতা করেন।
মানববন্ধন চলাকালে বক্তারা বলেন, কালের সাক্ষী ‘আবু সিনা ছাত্রাবাস’ ঐতিহাসিক ভবনটিকে সংস্কার করে সুরক্ষা করতে হবে। ১৫০ বছরের পুরনো এ স্থাপনায় এক সময় প্রেস ও সংবাদপত্র ছাপানো হতো। এরপর ব্রিটিশ শাসনামলে এখানে হাসপাতাল স্থাপিত হয়। ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে আহতদের এখানে চিকিৎসা দেয়া হয়েছে। পরবর্তীতে সিলেটের প্রথম মেডিকেল কলেজ ও পরবর্তীতে এটি ‘আবু সিনা ছাত্রাবাস’ হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে।
Advertisement
বক্তারা বলেন, অনুপম স্থাপত্যশৈলীর ঐতিহাসিক এ ভবনটিতে সুরসম্রাট ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাসহ অসংখ্য গুণিজন এসেছে। এখানে অডিটরিয়ামে সিলেটের প্রথম নাটকও মঞ্চস্থ হয়েছে। এরকম একটি ঐতিহাসিক স্থাপনা ভেঙে জেলা হাসপাতাল করা মোটেও গ্রহণযোগ্য নয়। বাংলাদেশ পুরাকীর্তি আইন ১৯৬৮ অনুযায়ীও এটি ভাঙা সম্পূর্ণ বেআইনি। নগরের ভেতরে দুটি সরকারি হাজসপাতাল আছে। আরেকটি জেলা হাসপাতাল নির্মাণ করতে হলে শহরতলি এলাকায় করলে ভালো হয়। এখানে আরেকটি হাসপাতাল হলে নগরে তীব্র যানজটের সৃষ্টি হবে।
আয়োজকদের পক্ষ থেকে বাপা সিলেটের সাধারণ সম্পাদক আবদুল করিম কিম বলেন, এ ভবনে সিলেটের প্রথম সংবাদপত্র ‘শ্রীহট্ট প্রকাশ’ প্রকাশিত হয় ১৮৭৬ সালে। পরে ১৯৩৬ সালে এ বাড়িতে মানুষের চিকিৎসা সেবার জন্য ছোট পরিসরে হাসপাতাল চালু করা হয়। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় এ হাসপাতালের বর্ধিতাংশে বার্মা-ইংরেজ সৈনিকদের চিকিৎসা দানের লক্ষে মিলিটারি হাসপাতাল চালু করা হয়।
পরবর্তীতে ১৯৪৮ সালে এ ভবনে মেডিকেল শিক্ষাদানের জন্য নির্মাণ করা হয় 'লাইসেন্সড মেডিকেল ফ্যাকাল্টি’ (এলএমএফ)। ১৯৬২ সালে এটিকে মেডিকেল কলেজে রূপান্তরিত করা হয়।
১৯৪৮ সালে এ ভবনের দেয়াল নির্মাণ করা হয়। ১৯৭১ সালে পাক হানাদার বাহিনীর ধ্বংসযজ্ঞ থেকে বাড়িটি রক্ষা পায়নি। স্বাধীন বাংলাদেশে ১৯৭৮-৭৯ সালে হাসপাতালটি কাজলহাওরে পরিপূর্ণভাবে স্থানান্তরিত হলে ভবনটি ‘আবু সিনা ছাত্রাবাস’ হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছিল। এটির সংস্কার করে এখানে একটি পুরাকীর্তি মিউজিয়াম করা হোক। সিলেটে কোনো মিউজিয়াম নেই। এটি মিউজিয়ামের জন্য আদর্শ স্থান হতে পারে। এখানে হজরত শাহজালাল (রহ.) ও আউল-বাউল এবং অলি আউলিয়াদের ব্যবহারের জিনিসপত্র রাখা হয়ে দেশ-বিদেশ থেকে আগত লোকজন এক জায়গা সবগুলো দর্শনীয় জিনিস দেখতে পাবেন।
Advertisement
সুজন সিলেটের সভাপতি ফারুক মাহমুদ চৌধুরী সভাপতিত্বে মানববন্ধন চলাকালে বক্তব্য রাখেন, সচেতন নাগরিক কমিটি-সনাক সিলেটের সভাপতি ও জেলা প্রেসক্লাবের সাবেক সভাপতি আজিজ আহমদ সেলিম, বাংলাদেশ জাসদের কেন্দ্রীয় যুগ্ম সম্পাদক অ্যাডভোকেট জাকির আহমদ, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক অধ্যাপক ড. নাজিয়া চৌধুরী, সাম্যবাদী দল সিলেট জেলা শাখার সেক্রেটারি কমরেড ধিরেন সিংহ, সম্মিলিত নাট্য পরিষদের সভাপতি মিশফাক আহমদ মিশু, সিলেট মহানগর আওয়ামী লীগের তথ্য প্রযুক্তি সম্পাদক তপন মিত্র, তথ্যচিত্র নির্মাতা নিরঞ্জন দে, মহানগর জাসদের সহসভাপতি ফেরদৌস আরবী, সমাজকর্মী আলমগীর চৌধুরী কুমকুম, সেভ দ্য হেরিটেজ অ্যান্ড এনভায়রনমেন্টের সভাপতি আব্দুল হাই আল-হাদি, বাপা সিলেটের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক ছামির মাহমুদ, লিডিং ইউনির্ভাসিটির স্থপতি বিভাগের শিক্ষক শুভজিৎ চৌধুরী ও টিআইবির সহকারী ব্যবস্থাপক আশফাকুন নুর প্রমুখ।
আগামীকাল বুধবার হেরিটেজ নিয়ে কাজ করা সংগঠন সেভ দ্য হেরিটেজ অ্যান্ড এনভায়রনমেন্টের উদ্যোগে বিকেল ৪টায় আবু সিনা ছাত্রাবাস প্রাঙ্গণে ‘প্রতিবাদী অবস্থান কর্মসূচি’ পালন করা হবে।
উল্লেখ্য, সিলেট নগরের চৌহাট্টা এলাকায় আসাম প্যাটার্নের ‘ইউ’ আকৃতির একটি একতলা বিশাল ভবন। দেখলেই মনে হয় পুরনো জমিদার বাড়ি। প্রাচীন এই ভবনটি এই প্রজন্মের নগরবাসীর কাছে ‘আবু সিনা ছাত্রাবাস’ নামে পরিচিত। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, মুক্তিযুদ্ধসহ আর বহু ইতিহাসের সাক্ষী পুরনো এই ভবনটি সম্প্রতি ভেঙে ফেলার উদ্যোগ নিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। এই ভবন ভেঙে নির্মাণ করা হচ্ছে আড়াইশ’ শয্যা বিশিষ্ট সিলেট জেলা হাসপাতাল। ইতোমধ্যে ভবনের একাংশ ভেঙে ফেলার চেষ্টা করা হয়েছে। এ নিয়ে সিলেটের সচেতন মানুষদের মধ্যে তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে। দাবি উঠেছে ভবনটি না ভেঙে সেখানে মিউজিয়াম তৈরি করার।
ছামির মাহমুদ/এমএএস/এমএস