মতামত

বাংলা ভাষা ও বাঙালি সংস্কৃতি মুছে দিতে চেয়েছিল

 

"নানান দেশের নানান ভাষা।বিনে স্বদেশীয় ভাষা, পুরে কি আশা?কত নদী সরোবর কিবা ফল চাতকীরধারাজল বিনা কভু ঘুচে কি তৃষা?"

Advertisement

রামনিধি গুপ্ত মনের কথা বলেছেন প্রাণের ভাষায়। আর দ্বি জাতিতত্ত্বের মাধ্যমে জন্ম নেয়া পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী প্রথমেই আঘাত হানে আমাদের মাতৃভাষার উপর।

পাকিস্তানীরা শুধু বাংলা ভাষা নয়, অক্ষরও মুছে দেওয়ার চেষ্টা করেছিল। ১৯৪৭ সালে আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর ড. জিয়াউদ্দিন আহমদ উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার সুপারিশ করেন। এর প্রতিবাদে প্রথম লেখনি শুরু করেন ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ।

এরপর পাকিস্তানের সংবিধানের খসড়ায় বলা হয় যে, 'উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা'। এর সমর্থনে করাচীতে ১৯৪৮ সালে আয়োজিত শিক্ষা সম্মেলনে উর্দুকে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার প্রস্তাব নেয়া হলে সভাপতির অভিভাষণে ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ বিরুদ্ধাচরণ করে বলেন, “আমরা হিন্দু বা মুসলমান যেমন সত্য, তার চেয়ে বেশি সত্য আমরা বাঙালি। এটি কোন আদর্শের কথা নয়; এটি একটি বাস্তব কথা।”

Advertisement

মায়ের মুখের ভাষা, বাংলা ভাষা রক্ষার জন্য ১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ শেখ মুজিব গ্রেফতার হন। তারপর ১৯৪৯ সালের অক্টোবর মাসে ঢাকায় একটা ভুখা মিছিলের আয়োজন করা হলে ওই মিছিল থেকেই ভাসানী, শামসুল হক ও শেখ মুজিবকে পুনরায় জননিরাপত্তা আইনে গ্রেফতার করা হয়। বলা বাহুল্য, বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের সময় যখন একদল বাঙালি 'অন্যতম রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই'। তখন কিন্তু শেখ মুজিব শ্লোগান দিলেন, "রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই"।

যৌক্তিক প্রেক্ষাপটে পাকিস্তান রাষ্ট্রের মোট জনসংখ্যার শতকরা ৬১ ভাগেরও অধিক পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালি এবং তাহাদের শতকরা ৯৯ জনেরও অধিক বাংলাভাষী। তথাপি পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খাঁ বলেছিলেন, "পাকিস্তান হচ্ছে মুসলিম রাষ্ট্র এবং মুসলমানের জাতীয় ভাষা উর্দুই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা।"

তার সাথে সুর মিলিয়ে পাকিস্তানের জনক মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ১৯৪৮ সালে ১১ মার্চে ঢাকার রেসকোর্স মায়দানে ঘোষনা দিলেন, “Urdu and only Urdu shall be the state language of Pakistan.” পুনরায় ২৪ মার্চ তারিখে সেই একই ঘোষণার পুনরাবৃত্তি করলেন কার্জন হল সমাবর্তন অনুষ্ঠানে; ছাত্রদের “নো” “নো” প্রতিবাদ উচ্চারিত হলে থমকে যান জিন্নাহ! ইত্যবসরে ১৯৫০ সালে গণপরিষদে আরবি হরফে বাংলা লেখার প্রস্তাব উপস্থাপিত হলে শ্রীযুক্ত ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত প্রতিবাদ করে বাংলা ভাষাকে পাক-পরিষদের অন্যান্য ভাষার সহিত সমানাধিকার দানের প্রস্তাব উত্থাপন করেন।

পরবর্তীতে ১৯৫২ সালের ২৬ জানুয়ারি ঢাকায় পল্টন ময়দানে আয়োজিত মুসলিম লীগের এক জনসভায় প্রধানমন্ত্রী নাজিম আবারো উচ্চারণ করেন "একমাত্র উর্দুই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা"। এরই ফলশ্রুতিতে পূর্ববঙ্গে শুরু হলো দ্বিতীয় দফায় বাংলা ভাষা আন্দোলন। এর চরম পর্যায় হচ্ছে, ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় ছাত্র মিছিলের উপর পুলিশের গুলিবর্ষণ।

Advertisement

বুলেটের আঘাতে ভাষাবীর সালাম, বরকত, রফিক, জব্বার, শফিকসহ শহীদের রক্তে রঞ্জিত হলো রাজপথ। গণদাবির মুখে পাকিস্তানের রাষ্ট্রতন্ত্র ১৯৫৬ সালে শাসনতন্ত্রে বাংলাকে ভাষাকে অন্যতম রাষ্ট্র ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। শেষ পর্যন্ত বিজয় হলো চেতনার, বাংলা ভাষা পেল রাষ্ট্রীয় মর্যাদা।

পাকিস্তানীরা শুরু থেকেই 'বাংলা ভাষা, সাহিত্যে ও সংস্কৃতির হাজার বছরের ঐতিহ্যকে নানাভাবে মুছে ফেলার চেষ্টা করে। এর একমাত্র নিয়ামক শক্তি হিসেবে সামনে তুলে ধরে ধর্মকে। রবীন্দ্রনাথ ও তাঁর সাহিত্যের ওপর আসে সাম্প্রদায়িক আঘাত; তাঁকে চিহ্নিত করা হয় হিন্দু কবি রুপে। এই ‘হিন্দুয়ানী’র অভিযোগ তুলে নজরুলের কবিতা থেকেও ‘হিন্দুয়ানী’ শব্দ বাদ দেয়ার উদ্যোগ নেয়া হয়।

রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে পূর্ব পাকিস্তানে বড় রকম বিতর্ক দেখা দিয়েছিলো ১৯৬১ সালে। সারা বিশ্বব্যাপী রবীন্দ্রশতবর্ষের আয়োজন হচ্ছে, কিন্তু পাকিস্তানের সামরিক শাসকেরা স্বদেশে তা করতে দেয়নি। তখন দৈনিক আজাদ পত্রিকায় লেখা হয়, 'রবীন্দ্রনাথ হিন্দুদের কবি, বলা হলো পাকিস্তানকে নির্মূল করে দুই বাঙলাকে একীভূত করার ষড়যন্ত্র চলছে'।

১৯৬৫ সালের পাক-ভারত যুদ্ধের সময়ে রেডিও পাকিস্তান এবং পাকিস্তান টেলিভিশন থেকে রবীন্দ্রনাথের সৃষ্টিকর্মগুলোর প্রচার রহিত করা হয়। ১৯৬৭ সালের জুন মাসে, পাকিস্তানের তথ্য ও বেতার মন্ত্রী খাজা শাহাবউদ্দিন জাতীয় পরিষদকে জানান যে, 'রবীন্দ্রনাথের গান পাকিস্তানের আদর্শবিরোধী, তা প্রচার বেতার ও টেলিভিশনে নিষিদ্ধ করা হয়েছে'।

এবার ১৯৬৭ সালের আগস্ট মাসে সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি হামুদূর রহমান আরবি হরফে বাংলা ও উর্দু লেখার সুপারিশ করলে সেটার তীব্র প্রতিবাদ জানান বুদ্ধিজীবীরা। পাকিস্তানের দুই অঞ্চলের সংহতি বৃদ্ধির অজুহাতে রোমান হরফে বাংলা লেখার প্রস্তাব করা হলে ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ তৎক্ষণাত এই ভাষা সংস্কারের কঠোর প্রতিবাদ জানান। এরই ফলশ্রুতিতে বাঙালির মনে ক্ষোভ পুঞ্জিভূত হতে থাকে এবং এই অবিচারের বিরুদ্ধে সাংস্কৃতিক আন্দোলন শুরু করে।

সরকারি বাধা উপেক্ষা করে কবি সুফিয়া কামালের নেতৃত্বে রবীন্দ্রশতবর্ষ উদযাপন, রবীন্দ্রসংগীত শিল্পী সনজিদা খাতুন ও ওয়াহিদুল হকের উদ্যোগে ‘ছায়ানট’ গঠন, মুনীর চৌধুরীর কবর নাটক কারাগারের অভ্যন্তরে মঞ্চায়ন, বিশেষ করে প্রত্যেক রাজনৈতিক অনুষ্ঠানে বঙ্গবন্ধুর প্রত্যক্ষ নির্দেশে 'আমার সোনার বাংলা' সংগীত পরিবেশন, জাতীয়তাবাদী চিন্তার বিকাশে সাহায্য করেছিল তুমুল ভাবে। তাদের সাংস্কৃতিক আন্দোলনের ফলেই জনগণ ধীরে ধীরে নিজেদের দাবি ও অধিকার সম্পর্কে সচেতন হয়ে উঠতে থাকে যা পরবর্তীতে রাজনৈতিক আন্দোলনে একীভূত হয়। রুপ নেয় মুক্তি সংগ্রামের, অর্জিত হয় স্বাধীনতা!

সমগ্র পৃথিবীতে মাতৃভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠিত করতে বাঙালিরা যে সংগ্রাম করে এসেছে, তার স্বীকৃতি স্বরুপ ২১ ফেব্রুয়ারি সেই রক্তস্বাক্ষরিত দিনটি আজ ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’। এই গৌরব বাঙালির ছাড়া পৃথিবীর অন্যকারো নেই। বাংলাভাষা ও সাহিত্য চর্চার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ বিশ্বের বুকে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছে। প্রযুক্তির আগ্রাসনে– মাতৃভাষা ও সাহিত্যচর্চা যেন হারিয়ে না যায়– সেদিকে সজাগ থাকতে হবে।

লেখক: ব্যারিস্টার ,ডেপুটি এটর্নি জেনারেল, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ ও আইনজীবী, বাংলাদেশ সুপ্রিমকোর্ট।

এইচআর/এমএস