২০১৮ সালের ৩ এপ্রিল সড়ক দুর্ঘটনায় বিআরটিসির দুই বাসের মাঝে রাজীবের বিচ্ছিন্ন হাত আটকে থাকার ছবি দেশের মানুষের হৃদয় কাঁদিয়েছিল। একই বছরের ২৯ জুলাই শহীদ রমিজউদ্দিন ক্যান্টনমেন্ট কলেজের দুই শিক্ষার্থী জাবালে নূর পরিবহনের বাসচাপায় নিহত হওয়ায় বিক্ষোভ করেছে সহপাঠীরা। রাজীবের ঝুলে থাকা হাত আর দুই শিক্ষার্থীর মৃত্যু স্পষ্ট করে সড়কে পরিবহনের অব্যবস্থাপনার চিত্র।
Advertisement
নিরাপদ সড়কের দাবিতে শিক্ষার্থীরা দেশব্যাপী আন্দোলন গড়ে তোলে, সড়ক অব্যবস্থাপনা নিয়ে সমালোচনা হয়, হয়েছে নতুন আইন, সরব হয়েছে পুলিশের ট্রাফিক বিভাগসহ সংশ্লিষ্ট দফতরগুলোও। তবুও সড়কে ফিরছে না শৃঙ্খলা। এখনও সড়কে স্পষ্ট অব্যবস্থাপনা।
নতুন বছরেই গত ১৫ জানুয়ারি থেকে রাজধানীতে ট্রাফিক শৃঙ্খলা ফেরাতে ফের ট্রাফিক অভিযান শুরু করেছে ঢাকা মহানগর পুলিশের ট্রাফিক বিভাগ।
চলমান ‘ট্রাফিক শৃঙ্খলা পক্ষ’ শুরু হবার পর সড়কে অব্যবস্থাপনা ও ট্রাফিক বিশৃঙ্খলা যেন নতুন রূপ নিয়েছে। যানজট বেড়েছে, সড়কে কমেছে যানবাহনের গতি। পুলিশের সরব উপস্থিতি ও চেষ্টা সত্ত্বেও পরিবহন, চালক-শ্রমিক ও পথচারীরা মানছেন না ট্রাফিক আইন। নগরবাসীকে আশ্বস্ত করার মতো চিত্র এখনও তৈরি করতে পারেননি সংশ্লিষ্টরা।
Advertisement
আরও পড়ুন >> রাজীব আর নেই
ঢাকা মহানগর পুলিশের ট্রাফিক বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, সড়কে বিশৃঙ্খলা করায় ও ট্রাফিক আইন অমান্যকারীদের বিরুদ্ধে মামলা দেয়া হলেও কোনো কাজে আসছে না। মামলা বেড়েছে, উল্টোপথে গাড়ি চলাচল বন্ধ না হলেও কমেছে। কিন্তু যানজট কমছে না, ওভারটেকিং কমছে না।
গত বুধবার (২৩ জানুয়ারি) রাজধানীতে সরেজমিনে ঘুরে দেখা যায়, মহাখালী থেকে তেজগাঁও ট্রাকস্ট্যান্ড পর্যন্ত যানজট, বাণিজ্য মেলার কারণে মিরপুর, মোহাম্মদপুর, কল্যাণপুর, আসাদগেটে তীব্র যানজট। জট কমলেও বাড়েনি যানবাহনের গতি। অফিস শেষ হবার পর নগরজুড়ে যানজট, পরিবহন সংকটাবস্থা আরও বেড়ে যায়।
পরদিন (বৃহস্পতিবার) সকালে দেখা যায়, মেট্রোরেলের কারণে মানিক মিয়া এভিনিউ সড়ক দিয়ে আসাদগেট থেকে আসা গাড়ি ঘুরিয়ে দেয়া হচ্ছে। ফার্মগেটের দিকে যেতে দেয়া হচ্ছে না। পেছনে বাণিজ্য মেলার কারণে দীর্ঘ যানজট শুরু থেকেই দৃশ্যমান। ঘণ্টার পর ঘণ্টা যানবাহনে বসে থেকে বিরক্ত যাত্রী সাধারণ।
Advertisement
আরও পড়ুন>> বিমানবন্দর সড়কে দুই শিক্ষার্থী নিহতের ঘটনায় মামলা
অন্যদিকে মিরপুর-১০ থেকে আগারগাঁও মোড় পর্যন্ত সড়কে মেট্রোরেলের কাজ বেশ এগিয়ে গেলেও ফেরেনি শৃঙ্খলা। বরং কাজীপাড়া, শেওড়াপাড়ার সড়ক আগের তুলনায় সংকুচিত হয়েছে। চীনমৈত্রী সম্মেলন কেন্দ্রের সামনের সড়ক বাণিজ্য মেলার কারণে ডাইভারশন করা হয়েছে, যান চলাচল নিয়ন্ত্রণ করছে পুলিশ।
বাণিজ্য মেলা শুরুর পর থেকে ঢাকা-ময়মনসিংহ সড়কে বেড়েছে যানজট। কমেছে যানবাহনের গতি। বিজয় সরণি মোড়ে ভিআইপি প্রটেকশন, মন্ত্রী এমপিদের যাতায়াত, মেলায় গমনেচ্ছু যানবাহন, আর রাজধানীর সঙ্গে উত্তরা সড়কে অত্যাধিক গাড়ির চাপের কারণে তেজগাঁও সড়কে সিগন্যালে কমপক্ষে আধাঘণ্টা করে দাঁড়িয়ে থাকতে হচ্ছে যাত্রীদের।
অন্যদিকে ফার্মগেইট, কারওয়ানবাজার, বাংলামোটর, শাহবাগ, মতিঝিল, মহাখালী, বাড্ডা, তেজগাঁও, মিরপুরে দেখা যায় বাসের বেপরোয়া চলাচল। এক বাসকে আটকে রেখে আরেক বাসের গতির ঝড়। এমন চিত্র কমবেশি পুরো রাজধানীতে।
সড়কে কেন ফিরছে না শৃঙ্খলা-জানতে চাইলে নিরাপদ সড়ক চাই (নিসচা)-এর চেয়ারম্যান ইলিয়াস কাঞ্চন বলেন, ফিরবে কীভাবে? আমার তো মনে হয় আইন মান্যকারী কমেছে বরং অমান্যকারী বেড়েছে! আইন সবার জন্যই। দায় চালক কিংবা পরিবহন সেক্টরের মানুষদের বেশি, কিন্তু পথচারী বা যাত্রীদের কি কোনো দায় নেই? ফুটওভার ব্রিজ থাকা সত্ত্বেও ঝুঁকি নিয়ে পার হয়ে যাচ্ছি। উল্টোপথে এখনও ভিআইপিরা যাচ্ছে।
জোরালো প্রচারণার কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘এতদিনেও সড়কে কেউ আইন মেনে চলেনি। এখন মানুষকে আইন মানাতে হলে কিছু পদ্ধতি ব্যবহার করতে হবে। স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়সহ সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এবং বিভিন্ন কমিউনিটিতে গিয়ে ট্রাফিক সচেতনতামূলক প্রচারণা চালাতে হবে।
আরও পড়ুন>> বাস থেকে ফেলে যাত্রী হত্যা : চালক দিদার গ্রেফতার
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ও স্রোতার আহ্বায়ক ড. হোসেন জিল্লুর রহমান জাগো নিউজকে বলেন, পরিবহন খাতে জবাবদিহি নিশ্চিত না করতে পারায় সড়কে মৃত্যুর মিছিল থামানো যাচ্ছে না। পরিবহন খাতের দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থার লোকজন, পুলিশ, পরিবহন মালিক, শ্রমিকদের নিয়ে দুর্নীতির দুষ্টু চক্র গড়ে উঠেছে। এই চক্র চায় না পরিবহন খাতে শৃঙ্খলা ফিরে আসুক। এই প্রেক্ষাপটে সড়কে সুশাসন প্রতিষ্ঠা নতুন সরকারের বড় চ্যালেঞ্জ।
তিনি বলেন, নির্বাচনের আগে সরকার তড়িঘড়ি করে সড়ক পরিবহন আইন পাস করলেও বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেয়নি। তবে ব্যাপক সমালোচনা এবং গণমাধ্যম কর্মীদের বাধার মুখেও একই দিনে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন পাস ও কার্যকর করা হয়। এ থেকে স্পষ্ট, সরকার ও সরকারের কাঠামো পরিবহন খাতের বিভিন্ন দুষ্টু চক্রে বাধা।
বিআরটিএ’র সাবেক চেয়ারম্যান আইয়ুবুর রহমান বলেন, সড়ক দুর্ঘটনায় এতো মানুষের মৃত্যু তবুও শৃঙ্খলার কোনো চিত্রই আমরা দেখছি না। জাবির উপাচার্য ড. আনোয়ার হোসেনের নেতৃত্বে একটি কমিটি হয়েছিল। সেই কমিটির সদস্য ছিলেন অধ্যাপক জাফর ইকবাল, বুয়েট শিক্ষক সামছুল হক ও চিত্রনায়ক ইলিয়াস কাঞ্চন। সেই কমিটি যে রিপোর্ট জমা দিয়েছিলেন তা আজও প্রতিফলিত হয়নি। সরকারের উচিত অবিলম্বে ওই রিপোর্টের ভিত্তিতে উদ্যোগ নেয়া। পাশাপাশি সড়ক নিরাপত্তা আইন ও সড়ক নিরাপত্তার বিষয়ে নতুন প্রজন্মকে সচেতন করার লক্ষ্যে স্কুল পর্যায়ের পাঠ্যপুস্তকে অন্তর্ভুক্ত করা হোক।
আরও পড়ুন>> মারাই গেল বাসের ধাক্কায় মায়ের বুক থেকে ছিটকে পড়া আকিফা
যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী বলেন, দুইবাসের চাপায় রাজীবের হাত বিচ্ছিন্ন, গৃহকর্মী রোজিনা, শহীদ রমিজউদ্দিন ক্যান্টনমেন্ট কলেজের দুই শিক্ষার্থী, চট্টগ্রামে রেজাউল করিম রনি, শিশু আকিফার মৃত্যু অব্যবস্থাপনার কারণে হয়েছে।
বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র আইনজীবী ব্যারিস্টার জোতির্ময় বড়ুয়া বলেন, সড়কে দুর্ঘটনারোধে কার্যকরী পদক্ষেপ নিলেই শুধু হবে না, সড়কে চাঁদাবাজি-ধান্দাবাজি বন্ধ করতে হবে। নতুন আইন পাশ করা হলেও তা কার্যকর করা হচ্ছে না। তা অতিদ্রুত প্রজ্ঞাপন আকাশে প্রকাশ করে কার্যকর করতে হবে। যদিও নতুন এই আইনের অনেক অসঙ্গতি সংশোধনযোগ্য।
ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) অতিরিক্ত কমিশনার (ট্রাফিক) মীর রেজাউল আলম বলেন, ‘সড়কে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে আমরা চেষ্টা করছি। তবে এটা একদিনেও হবে না। ট্রাফিক আইন সম্পর্কে ব্যাপক প্রচারণার মাধ্যমে মানুষের মধ্যে সচেতনতা তৈরি করতে হবে।
বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির মহাসচিব খন্দকার এনায়েত উল্লাহ বলেন, সড়কে শৃঙ্খলা ফেরাতে পরিবহন মালিক-শ্রমিক, সরকারের বিভিন্ন পক্ষ এবং সাধারণ মানুষের মধ্যে সমন্বয় জরুরি। সমন্বিত কর্মসূচি গ্রহণ না করলে সড়কে শৃঙ্খলা আনা সম্ভব নয়।
জেইউ/জেএইচ/এমএমজেড/এমএস