ট্রাফিক আইন লঙ্ঘন, ট্রাফিক পুলিশের নির্দেশনা উপেক্ষা, যত্রতত্র রাস্তা পারাপার ও যানবাহনের বেপরোয়া গতির কারণে বাড়ছে সড়কে দুর্ঘটনা। যত্রতত্র রাস্তা পারাপারে পথচারীর মৃত্যুর সংখ্যাও বাড়ছে। সড়কে দুর্ঘটনা ও যানজটের কারণে বাংলাদেশের ক্ষতির পরিমাণ জিডিপির (মোট দেশজ উৎপাদন) শতকরা ১ দশমিক ৬ ভাগ।
Advertisement
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের দুর্ঘটনা কেন্দ্রের এক গবেষণায় দেখা গেছে, রাজধানী ঢাকায় বছরে চার শতাধিক দুর্ঘটনা ঘটে। যার ২৬ শতাংশ ঘটে পথচারী নিয়ম ভঙ্গ করে রাস্তা পার হতে গিয়ে। গবেষণায় এসব দুর্ঘটনার কারণ হিসেবে পথচারীদের ফুটওভার ব্রিজ ব্যবহার না করার বিষয়টি চিহ্নিত করা হয়।
সড়কে দুর্ঘটনায় পথচারীর মৃত্যুর কারণ হিসেবে পুলিশ বলছে, আইন না মানা ও অসচেতনতাই দায়ী। তবে পথচারীরা বলছেন, দুর্ঘটনায় মৃত্যুতে দায় শুধু পথচারীদের নয়, যত্রতত্র রাস্তা পারাপারে পথচারীদের বাধ্য না করা এবং এ জন্য সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোও দায়ী।
পথচারীদের অভিযোগ, রাজধানীর যেসব ফুটওভার ব্রিজ আছে সেগুলোর উচ্চতা বেশি, নোংরা পরিবেশ, হকার, ভিক্ষুক, বখাটে ও মাদকসেবীদের দখলে। ফলে পথচারীদের মধ্যে এগুলো ব্যবহারে ভীতির সঙ্গে অনীহাও দেখা যায়। আবার সড়কে ঘণ্টার পর ঘণ্টা যানজটের কারণে স্থবিরতা তৈরি হয়। যে কারণে ঝুঁকি নিয়ে রাস্তা পার হতে বাধ্য হন তারা।
Advertisement
পুলিশের ট্রাফিক বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, সম্প্রতি যান চলাচল ও সড়কে শৃঙ্খলা ফেরাতে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের নির্দেশনার পর কঠোর অবস্থানে পুলিশ। ট্রাফিক আইন ভঙ্গকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার বিষয়টিও দৃশ্যমান হয়েছে।
এর মধ্যেও থেমে নেই যত্রতত্র রাস্তা পারাপার। রাজধানীর বাড্ডা, রামপুরা, হাতিরঝিল, গুলশান, মহাখালী, খামারবাড়ি, শ্যামলী ও কল্যাণপুর ঘুরে দেখা গেছে, অনেকেই আগের মতোই ঝুঁকি নিয়ে রাস্তা পার হচ্ছেন।
কল্যাণপুরের বাসযাত্রী আবুল মনসুর বলেন, প্রতিদিন গুলশানে অফিস করি। শেরেবাংলা থানার সামনে আসার পর থেকে শুরু হয় যানজট। আগারগাঁও মোড় পার হতেই সময় যায় কমপক্ষে ২০ মিনিট। এরপর মহাখালী, ওয়্যারলেস গেট ও গুলশান মোড়ের যানজট। সব মিলে অনেক সময় যানবাহন থেকে নেমে সড়ক ধরে হাঁটা শুরু করতে হয়। ব্যস্ততার কারণেই মূলত পথচারীরা ঝুঁকি নিয়ে রাস্তা পারাপার হন।
মুকুল মিয়া নামে বেসরকারি ব্যাংক কর্মকর্তা বলেন, গুলশান মোড় পেরিয়ে ডিএনসিসি মার্কেটের সামনে যেতে অনেকক্ষণ অপেক্ষায় থাকতে হয় পথচারীদের। কারণ, সেখানে নেই কোনো ফুটওভার ব্রিজ কিংবা আন্ডারপাস। অনেকক্ষেত্রেই অন্য পথচারীর সঙ্গে বাধ্য হয়ে ঝুঁকি নিয়ে রাস্তা পার হতে হয়। বিকল্প ব্যবস্থা করা গেলে দুর্ঘটনা কমবে এবং মানুষ আইন মানতে বাধ্য হবে।
Advertisement
দুই সিটি কর্পোরেশন সূত্রে জানা গেছে, বর্তমানে রাজধানীতে ৮৭টি ফুটওভার ব্রিজ রয়েছে। এর মধ্যে ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের আওতায় ৩২টি ও ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের আওতায় ৪৯টি ফুটওভার ব্রিজ রয়েছে। রোড অ্যান্ড হাইওয়ের ৫টি এবং রাজউকের একটি ফুটওভার ব্রিজ আছে।
তবে নির্জন এলাকার ফুটওভার ব্রিজগুলোর অধিকাংশই পথচারীরা ব্যবহার করেন না।
জানতে চাইলে ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা পুলিশের একার পক্ষে সুশৃঙ্খল করা সম্ভব নয় উল্লেখ করেন ঢাকা মহানগর পুলিশের ট্রাফিক পশ্চিম বিভাগের উপ-কমিশনার (ডিসি) লিটন কুমার সাহা। জাগো নিউজকে তিনি বলেন, ট্রাফিকিং বিষয়টি বিশাল ব্যাপার। আমাদের সবাইকে আইনটা জানতে হবে, মানতে হবে। আইন মানার জন্য ধৈর্যের দরকারও বটে।
‘এখন যেখানে ফুটওভার ব্রিজ নেই সেখানে জেব্রা ক্রসিং চালু করা হয়েছে। বর্ডার লাইন দেয়া হয়েছে। নির্দেশনা ছাড়া সেই লাইন কোনো যানবাহন পেরিয়ে যেতে পারবে না। কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রেই পথচারীরা জেব্রা ক্রসিং মানছেন না। ফুটওভার ব্রিজে উঠছেন না। প্রতিটা মানুষকেই সহযোগিতা করতে হবে। পুলিশ ট্রাফিক এডুকেশনও করে না, ফুটওভার ব্রিজও তৈরি করে না। আমরা আইন মানাতে চেষ্টা করছি। সবাই সহযোগিতা না করলে আমাদের চেষ্টা সফল হবে না,’- বলেন এই উপ-কমিশনার।
পথচারীদের রাস্তা পারাপারে বিকল্প ব্যবস্থার জন্য ভৌত অবকাঠামোগত উদ্যোগ নেয়া জরুরি বলে মনে করেন নগর পরিকল্পনাবিদরা।
বাংলাদেশ প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক মো. মোসলেহ উদ্দিন হাসান জাগো নিউজকে বলেন, আমাদের সমন্বিত পরিকল্পনা হতে হবে। যেসব জায়গায় পথচারীদের সংখ্যা বেশি, যেমন- শাহবাগ, সেখানে একটা ফুটওভার ব্রিজে তো সম্ভব না। সেক্ষেত্রে তো পথচারীদের চাপ আপনি সামাল দিতে পারবেন না। বাধাও দিতে পারবেন না। এ ক্ষেত্রে চলাচলকারী যানবাহনের চাপ কমাতে কিছু কিছু ক্ষেত্রে রুট নির্ধারণ করে আলাদা সড়কে ডাইভার্ট করে দিতে হবে।
এ ব্যাপারে যোগাযোগ করা হলে ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের ভারপ্রাপ্ত মেয়র মো. ওসমান গণি জাগো নিউজকে বলেন, পথচারীর মৃত্যু আমাদের কাম্য নয়। কিন্তু আইন না মানলে তো দুর্ঘটনা ঘটবেই। পরিস্থিতি বিবেচনায় পথচারীরা যাতে আইন মানতে বাধ্য হয়, সেজন্য আমাদের পরিকল্পনা রয়েছে ঢাকায় আরও একডজন আন্ডারপাস নির্মাণ করা, অবস্থা বুঝে আরও বেশ কটি চলন্ত সিঁড়িযুক্ত ফুটওভার ব্রিজ করা। এর বাইরে দুই সিটি মিলে আরও অর্ধশত ফুটওভার ব্রিজ নির্মাণ করা হবে।
জেইউ/জেডএ/জেআইএম