গ্যালারিতে বসে খেলা দেখতে এসেছিলেন বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড (বিসিবি) সভাপতি নাজমুল হাসান পাপন। টিভি ক্যামেরার লেন্স বার কয়েক ঘুরে এসেছিল তার চেহারার ওপর। বোঝাই যাচ্ছে কতটা ক্রীড়া অন্তঃপ্রাণ তিনি। শুধুমাত্র ক্রিকেটই নয়, বাংলাদেশের ফুটবলও যে তাকে টানে, সেটা বোঝা গেলো বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়ামে তার উপস্থিতি দেখে।
Advertisement
বাংলাদেশের ফুটবলে হঠাৎ করেই আলোড়ন তৈরি করে ফেলেছিল। নারী ফুটবলারদের সঙ্গে পুরুষ ফুটবলাররাও সাফল্য বয়ে আনছিল দেশ-বিদেশের মাটি থেকে। ইন্দোনেশিয়ার জাকার্তায় এশিয়ান গেমসে খেলতে গিয়ে ৯৬ ধাপ সামনে থাকা, আগামী বিশ্বকাপের স্বাগতিক কাতারকে হারিয়ে তোলপাড় ফেলে দিয়েছিল বাংলাদেশের ফুটবলাররা।
নিশ্চিতভাবেই, যে কোনো সাফল্য বাংলাদেশের মানুষকে উদ্বেলিত করে। আশাবাদী করে তোলে। সারাদিনে হাজারও নেতিবাচক সংবাদের ভিড়ে একটি-দুটি ইতিবাচক সংবাদ মানুষকে নতুন করে স্বপ্ন দেখায়। কিশোরী ফুটবলাররা যখন ভুটানের থিম্পুতে গিয়ে পাকিস্তানের জালে গুনে গুনে ১৪বার বল জড়ায়, তখন বাংলাদেশের মানুষ সব দুঃখ-কষ্ট ভুলে গিয়ে সেই কিশোরীদের নিয়েই মেতে ওঠে।
এশিয়ান গেমসে কাতারের মত সেরা দলকে হারিয়ে যে তোলপাড় ফেলে দিয়েছিল ফুটবলাররা, তাতে নতুন করে উন্মাদনা তৈরি হয়েছে বাংলাদেশে। যার ফলশ্রুতিতে দেখা গেলো, নীলফামারীর মত জেলাশহরে আয়োজন করা শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে প্রীতি ম্যাচেও দর্শকের জোয়ার ওঠে। মাত্র ২১ হাজার দর্শক ধারণক্ষমতার স্টেডিয়ামটিতে তিল ধারণের ঠাঁই ছিল না। আয়োজকরা এমনও বলেছিল, লাখের অধিক টিকিট দিলেও হয়তো চাহিদা শেষ হতো না।
Advertisement
ফুটবল নিয়ে দর্শক-সমর্থকদের উন্মাদনা কোন পর্যায়ে রয়েছে, সেটা বোঝা গিয়েছিল নীলফামারীতে। ঢাকায় চলমান সাফ ফুটবল চ্যাম্পিয়নশিপে সেই জোয়ারের ঢেউ আছড়ে পড়বে, এমনটাই ছিল বাংলাদেশের ফুটবল কর্তাদের ধারণা। কিন্তু প্রথম ম্যাচে ভুটানের বিপক্ষে দর্শকের উপস্থিতি তাদেরকে কিছুটা হতাশ করেছিল।
এই ভুটানের কাছেই ২০১৬ সালে এশিয়ান কাপ প্রাক বাছাই পর্বের ম্যাচে হেরে একেবারে তলানীতে গিয়ে ঠেকেছিল বাংলাদেশের ফুটবল। যে ভুটানকে এক সময় বলে-কয়ে হালি-হালি গোল দিতো বাংলাদেশ, সেই ভুটানও হারিয়ে দেয় বাংলাদেশকে! কোথায় গিয়ে ঠেকেছে বাংলাদেশের ফুটবল? তা অনুধাবন করতে বিশেষ ফুটবল বোদ্ধা হওয়ার প্রয়োজন হয় না।
দুই বছর পর সেই ভুটানের বিপক্ষে ২-০ গোলের জয় দিয়ে নতুন করে আশার বীজ বপন করে লাল-সবুজ জার্সিধারী ফুটবলাররা। সুতরাং, তাদের নিয়ে তৈরি হলো নতুন উন্মাদনা। দক্ষিণ এশিয়ার বিশ্বকাপ নামে পরিচিত সাফ চ্যাম্পিয়নশিপে অনেক দুর যাওয়ারও ইঙ্গিত মেলে ওই ম্যাচে দুর্দান্ত জয়ের পর।
দ্বিতীয় ম্যাচে বাংলাদেশের প্রতিপক্ষ চির প্রতিদ্বন্দ্বী পাকিস্তান। এবার বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামে প্রাণের জোয়ার। দর্শকের উপচে পড়া ভিড়। ফুটবল নিয়ে নতুন করে আশায় কোমর বাধা বাংলাদেশের সমর্থকরা মুখ ফিরে তাকাত বাংলাদেশের ফুটবলের দিকে। দর্শকজোয়ারকে পূর্ণতা দেন তপু বর্মণ। শেষ মুহূর্তে দুর্দান্ত এক গোলে হারিয়ে দেন পাকিস্তানকে। এরপর মুক্তিযুদ্ধের ভঙ্গিতে উদযাপন দর্শক গ্যালারিতেও নতুন আনন্দের ঢেউ তোলে।
Advertisement
বাংলাদেশের ফুটবলকে যে মানুষ ভুলে যায়নি এই দুটি জয়ের পর দর্শকদের উল্লাস-উন্মাদনাই সেটা প্রমাণ করে। নেপালের বিপক্ষে গ্রুপের শেষ ম্যাচে ড্র করলেও বাংলাদেশ উঠে যাবে সেমিফাইনালে। দক্ষিণ এশিয়ান ফুটবলের শ্রেষ্ঠত্বের আসরে সেরা চারে ওঠাও যে এখন বাংলাদেশের জন্য অনেক বড় পাওয়ার! সেই লক্ষ্যের পথে অনেকটাই এগিয়েছিল প্রথম দুটি ম্যাচে জয়ের কারণে।
নেপালের বিপক্ষে এই ম্যাচ দেখার জন্যও গ্যালারিতে তাই উপচে পড়া ভিড়। দর্শকে ঠাসা পুরো বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়াম। ৫ গুণ দাম বাড়িয়েও দর্শকদের রুখতে পারেনি টিকিট বিক্রেতারা। ২০ টাকার টিকিট ২০০ টাকায়ও কিনে গ্যালারিতে প্রবেশ করেছে দর্শকরা। শুধু লাল-সবুজের বিজয়ের সঙ্গী হতে। ভুটান, পাকিস্তানকে যেভাবে হারিয়ে দিয়েছিল, সেভাবে না হোক, নেপালকে রুখে দিয়ে অন্তত এক পয়েন্ট নিয়ে বিজয় উল্লাসের সঙ্গী হতে।
কিন্তু সাধারণ মানুষের এই আবেগ-উচ্ছাসকে পুঁজি করে ফুটবলকে এগিয়ে নেয়ার যে সুবর্ণ সুযোগ তৈরি হয়েছিল সেটা গ্রহণ করতে পারলো না বাংলাদেশের ফুটবল কর্মকর্তারা। আগের দুই ম্যাচে দারুণ জয়ের পর দর্শকদের মধ্যে যে উন্মাদনা তৈরি হয়েছিল, বাফুফে কর্মকর্তারা সেখান থেকে সঠিক বার্তাটা নিতে পারলেন না।
যার ফলশ্রুতিতে নতুনভাবে ফুটবল নিয়ে যে সম্ভাবনার অঙ্কুরোদগম হয়েছিল, তাকে নিজেদের হাতেই গলাটিপে হত্যা করলো এ দেশের ফুটবল কর্মকর্তারা। এক গোলরক্ষক শহিদুল আলম সোহেলকে দলে অন্তর্ভূক্ত করা নিয়েই যে ইঁদুর-বিড়াল খেলা দেখিয়েছে, তাতে করেই ফুটবলের নতুন সম্ভাবনাকে ধুলায় মিশিয়ে দিলো তারা।
ইংলিশ কোচ জেমি ডে দায়িত্ব নেয়ার পর থেকেই বাংলাদেশ ফুটবল দলকে ঢেলে সাজানো চেষ্টা করছিলেন। এশিয়ান গেমস, সাফ চ্যাম্পিয়নশিপ এবং বঙ্গবন্ধু গোল্ডকাপ- গুরুত্বপূর্ণ তিনটি টুর্নামেন্ট এবং আসরকে সামনে রেখে শুরু করা হয় প্রস্তুতি।
কোচ জেমি ডে যে প্রস্তুতি ক্যাম্প পরিচালনা করেন, শহিদুল আলম সোহেল ছিলেন সেই ক্যাম্পেরই বাইরে। বাংলাদেশ জাতীয় ফুটবল দলের কাতার, দক্ষিণ কোরিয়া ও ইন্দোনেশিয়া পরিচালিত ক্যাম্পে জেমি ডে রাখেননি গোলরক্ষক শহিদুল আলমকে।
কিন্তু এশিয়ান গেমসের পর সেই কোচ জেমি ডে’রই সুর পরিবর্তন! তিনি গোলরক্ষক সোহেলকে সরাসরি একাদশে নিয়ে আসলেন। নীলফামারীতে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে ফিফা ফেন্ডলি ম্যাচে একাদশে রাখা হয় তাকে। ওই ম্যাচেই দুর্বল শ্রীলঙ্কার কাছে জঘন্য এক গোল খাওয়ার পর একাদশে সোহেলকে খেলানো নিয়ে সমালোচনার ঝড় ওঠে।
তবুও কোচ নিজের সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসতে পারেননি। কেন সরে আসতে পারেননি? এটা এখন বড় একটা প্রশ্ন। এখানে জাতীয় দলের চেয়ে ক্লাব প্রীতি প্রাধান্য পেয়েছে কি না চলছে সেই আলোচনা। সোহেল যে আবাহনীর গোলরক্ষক! জাতীয় দলের ম্যানেজারের দায়িত্বেও আবাহনীর ম্যানেজার সত্যজিৎ দাস রুপু।
অতীতের মত ক্লাব নীতির কারণেই জাতীয় দলের সর্বনাশ ডেকে আনা হচ্ছে কি না- এখন সেই প্রশ্নই উঠে গেছে সাফের গ্রুপ পর্ব থেকে বিদায় নেয়ার পর। যেখানে কোচ জেমি ডে’ই হয়তো হয়ে পড়বেন বলির পাঁঠা। নিজের পছন্দের সেরা দল তিনি স্বাধীনভাবে বাছাই করতে পেরেছিলেন কি না, নাকি পর্দার অন্তরালের চাপের কারণে আশরাফুল ইসলাম রানাকে বাদ দিয়ে দলে নিয়েছেন সোহেলকে- সেটাও এখন নাড়া দিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশের ফুটবল অঙ্গনকে।
বাংলাদেশ দল নিয়েও কম খেলা দেখানো হচ্ছে না। পছন্দের ফুটবলারকে দলে নিয়ে পারফরমারকে বসিয়ে রাখার ঘৃণ্য সিদ্ধান্তেই বাংলাদেশ ফুটবল দলকে বারবার পেছনের ঠেলে দিচ্ছে। জাফর ইকবাল যখন ভূটানে খেলতে গিয়েছিল, ওখানে তাকে সবাই ‘বাংলাদেশের মেসি’ বলে সম্বোধন করতো। অথচ তাকে রাখা হয়নি দলে। রাখা হয়নি মতিন মিয়া, রুবেল মিয়াদেরও।
রাখা হয়েছে প্রস্তুতি ম্যাচে একটাও শটস অন টার্গেট না করা শাখাওয়াত রনিকে। নেপালের বিপক্ষেও বার বার সহজ সুযোগ মিস করেছেন রনি। এশিয়ান গেমসে যারা কাতারকে হারালো, তাদেরকেও রাখা হলো না স্কোয়াডে। নীলফামারীতে দলীয় ম্যানেজার সত্যজিত দাস রূপু দলকে ফেলে রেখে ঢাকায় চলে এসেছিলেন। যা নিয়ে সমালোচনা শুরু হয়, তাকে আবার রাখা হয় সাফে দলীয় ম্যানজোর হিসেবে। ক্লাবপ্রীতির অভিযোগ বাফুফে সভাপতি কাজী সালাউদ্দিনের বিরুদ্ধেও প্রবল। যে কারণে, এশিয়ান গেমসে জয়ের নায়ক আশরাফুল ইসলাম রানাকে বাদ দিয়ে দলে নেয়া হয় শহিদুল আলম সোহেলকে। তিনি তো আবাহনীর গোলরক্ষক!
যে দলটি আবারও সাফল্যের উন্মাদনায় ভাসিয়ে দিচ্ছিল বাংলাদেশের মানুষকে, সেই দলটিকেই দলীয় প্রীতির মোড়কে ডুবিয়ে, অঙ্কুরেই গলা টিপে হত্যা করা হলো। কবে বাংলাদেশ ফুটবল এই ব্যক্তি এবং দল প্রীতি থেকে বেরিয়ে আসতে পারবে? যতদিন এই অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসতে না পারবে, ততদিন বাংলাদেশের ফুটবল কেবল তলানীর দিকেই নামতে থাকবে। উপরে উঠতে পারবে না কখনো।
আইএইচএস/আরআইপি