তুরস্কের আর্থিক বাজারে সাম্প্রতিক ঘটনা উদ্বেগ তৈরি করছে। চলতি বছর ডলারের বিপরীতে তুরস্কের মুদ্রা লিরার দাম প্রায় ৩০ শতাংশ কমেছে। দেশটির শেয়ার বাজারের মূল্য পতন হয়েছে ১৭ শতাংশ। যদি সেটিকে ডলারের বিবেচনায় ধরা হয় তাহলে শেয়ার বাজারের দাম পড়ে গেছে ৪০ শতাংশ।
Advertisement
আরেকটি বিষয় হচ্ছে সরকারের ঋণ গ্রহণের খরচ। গত ১০ বছর যাবত প্রতিবছর তুরস্কের মুদ্রায় সরকারের ঋণ হয়েছে ১৮ শতাংশ। তাছাড়া যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে দেশটির সম্পর্ক অবনতি হওয়ার কারণে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে নতুন করে আস্থার সংকট তৈরি হয়েছে।
মার্কিন এক ধর্মযাজককে তুরস্কে আটকের পর দেশটির সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কের অবনতি ঘটে। তাছাড়া সিরিয়ার যুদ্ধ নিয়ে ওয়াশিংটনের সঙ্গে আঙ্কারার মতপার্থক্য রয়েছে। মার্কিন বাজারে তুরস্কের পণ্যের শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকারের বিষয়টিও আটকে আছে।
তাছাড়া মার্কিন কেন্দ্রীয় ব্যাংক ফেডারেল রিজার্ভ সিস্টেম সুদের হার বৃদ্ধি করার কারণে সেটির প্রভাব তুরস্কেও পড়েছে।কারণ মার্কিন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এ সিদ্ধান্তের কারণে বিশ্বের বিভিন্ন উদীয়মান অর্থনীতির দেশ থেকে বিনিয়োগকারীরা অর্থ ফেরত নিয়ে আসছে।
Advertisement
অন্য দেশের জন্য সেটি খুব বেশি প্রভাব তৈরি না করলেও তুরস্কের ভঙ্গুর অর্থনীতির জন্য সেটি খারাপ অবস্থা তৈরি করছে। তবে কিছু কিছু ক্ষেত্রে তুরস্কের অর্থনীতি মোটামুটি ভালো মনে হয়েছে।
২০০১ এবং ২০০৯ সাল ছাড়া গত সতের বছরে তুরস্কের অর্থনীতিতে প্রতি বছর প্রবৃদ্ধি হয়েছে। কয়েক বছর বেশ ভালো অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিও হয়েছে।
দেশটিতে বেকারত্ব বেশ উচ্চহারে অর্থাৎ বর্তমানে প্রায় ১০ শতাংশ। কিন্তু এ সংখ্যা মোটামুটি স্থিতিশীল আছে। ক্রেডিট রেটিং এজেন্সি মুডিস বলছে তুরস্কের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি দীর্ঘমেয়াদে টেকসই হয়নি।
শুধু খরচ বৃদ্ধি এবং করের উপর নির্ভর করে অর্থনীতি এগিয়েছে। ফলে অর্থনীতিতে অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে।একসময় ডলারের বিপরীতে তুরস্কের মুদ্রা লিরার বিনিময় হার দেশটির সরকার নির্ধারণ করে দিয়েছিল। কিন্তু বিনিময় হার নির্ধারিত না থাকায় তুরস্কের মুদ্রা লিরার দরপতন ঠেকানো যায়নি।
Advertisement
ক্রেডিট রেটিং এজেন্সি ফিচ সতর্ক দিয়েছে যে জীবন-যাত্রার ব্যয় বৃদ্ধি এবং বেকারত্বের কারণে তুরস্কের অর্থনীতি নিম্নগামীও হতে পারে।
তুরস্ক আন্তর্জাতিক বাজারে যা রপ্তানি করে তার চেয়ে বেশি আমদানি করে। অর্থাৎ দেশটি যা আয় করে তার চেয়ে বেশি ব্যয় করে। আমদানি এবং রপ্তানির মধ্যে যে ঘাটতি আছে সেটি পূরণ করার জন্য হয়তো বিদেশি বিনিয়োগ প্রয়োজন নতুবা সরকারের ঋণ গ্রহণ প্রয়োজন।
অর্থনীতির জন্য এটি অস্বাভাবিক কিছু নয়। কিন্তু তুরস্কের ঘাটতি অনেক বেশি। জাতীয় আয়ের প্রায় ৫.৪ শতাংশ ঘাটতি হয়েছে গত বছর। তুরস্ক যে বৈদেশিক ঋণ নেয় সেটার দুই ধরণের বৈশিষ্ট্য আছে যা ঝুঁকি তৈরি করে।
তুরস্কের যে বিশাল অংকের বৈদেশিক ঋণের দেনা রয়েছে সেটি অল্প কিছু দিনের মধ্যেই শোধ করতে হবে। এ ঋণ শোধ করার জন্য দেশটির আবার নতুন করে ঋণ করতে হবে। অর্থনীতির ভাষায় ঋণ পরিশোধের জন্য অর্থের জোগান লাগবে।
ক্রেডিট রেটিং এজেন্সি ফিচ-এর হিসাব অনুযায়ী, ঋণ পরিশোধের জন্য তুরস্কের প্রয়োজন প্রায় ২৩০ বিলিয়ন ডলার।দ্বিতীয়ত, তুরস্কের অনেক কোম্পানি বৈদেশিক মুদ্রায় ঋণ নিয়েছে। ডলারের বিপরীতে লিরার দাম পড়ে যাওয়ায় সে ঋণ পরিশোধ এখন ব্যয়বহুল হয়ে গেছে।
তুরস্কের মুদ্রার দাম পড়ে যাওয়ায় দেশে জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়ে গেছে। কারণ আমদানি করতে এখন আগের চেয়ে বেশি অর্থ খরচ করতে হচ্ছে।
দেশটির কেন্দ্রীয় ব্যাংক মূল্যস্ফীতি নির্ধারণ করেছে ৫ শতাংশ। এক বছর আগেও সেটা ছিল ১০ শতাংশের উপরে। সে থেকে এটি অবনতির দিকেই যাচ্ছে। বর্তমানে জীবন-যাত্রার ব্যয় ১৫ শতাংশ হারে বাড়ছে।
তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়্যেপ এরদোয়ানের অর্থনৈতিক নীতি এবং কেন্দ্রীয় ব্যাংকের উপর তার খবরদারির কারণে বিনিয়োগকারীরা অস্বস্তিতে আছেন। সুদের হার কমিয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক মূল্যস্ফীতির লাগাম টেনে ধরার চেষ্টা করতে পারে। সে চেষ্টা তুরস্কের কেন্দ্রীয় ব্যাংক করেছিল কিন্তু দীর্ঘমেয়াদী কোন প্রভাব পড়েনি।
অর্থনীতিবিদরা বলেন, প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান সুদের হার বৃদ্ধি করার বিপক্ষে। তিনি এটিকে শত্রু হিসেবে বিবেচনা করেন। ফলে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। বিনিয়োগকারীরা মনে করেছন বাজার স্থিতিশীল করার জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংক চাইলেও প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে পারবে না।
টিটিএন/এমএস