দেশজুড়ে

৬৮ বছরেও থেমে নেই দিনাজপুরের প্রবীণ সাংবাদিক আব্দুর রহমান

সাংবাদিকতা জীবনে মানুষের অধিকার, অন্যায়-অত্যাচার, উন্নয়ন এবং অনিয়ম নিয়ে গঠনমূলক সমালোচনা করতে খুব একটা বিড়ম্বনায় পড়তে হয়নি। বিড়ম্বনায় পড়তে হলো একজন সংবাদকর্মী হয়ে আরেকজন সংবাদকর্মীর জীবন কাহিনি তুলে ধরতে গিয়ে। সাংবাদিকতায় ব্যস্ত থাকার কারণে বেশির ভাগ সংবাদকর্মী আরেক সংবাদকর্মীর খোঁজ-খবর রাখার সুযোগ পান না। আবার একজন সংবাদকর্মী নিজের দুর্বলতাও কখনও তুলে ধরতে চায় না বা পারে না।

Advertisement

সম্প্রতি জাগো নিউজের এ প্রতিবেদক জীবন কাহিনি তুলে ধরেছেন সহকর্মী এক সংবাদকর্মীর। তিনি হলেন, দিনাজপুর সংবাদপত্র জগতের অন্যতম উদ্যোক্তা প্রবীণ সাংবাদিক আব্দুর রহমান। যার হাত ধরে সাংবাদিকতা জগতে বিচরণ ঘটেছে অনেকে। তারা অনেকেই নিজ নিজ জায়গায় খ্যাতি ছড়িয়েছেন।

৬৮ বছর বয়সী আব্দুর রহমানের জন্ম দিনাজপুরের চিরিরবন্দর উপজেলার ৬নং অমরপুর গ্রামের লক্ষিপুর গ্রামের কৃষক মরহুম ধনিবুল্লাহর পরিবারে। পড়ালেখা করার সুবাদে ১৯৬৫ সালে পরিবার নিয়ে দিনাজপুর শহরে বসবাস শুরু করেন তিনি। বর্তমানে শহরের লালবাগ এলাকায় থাকেন।

আব্দুর রহমান ১৯৭২ সালে ঢাকা থেকে প্রকাশিত দৈনিক গণকণ্ঠ পত্রিকায় দিনাজপুর জেলা প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করার মধ্যদিয়ে সাংবাদিকতা শুরু করেন। পরবর্তীতে দিনাজপুর থেকে প্রকাশিত প্রাচীন পত্রিকা দৈনিক উত্তরা ও দৈনিক উত্তর বাংলায় বার্তা সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন তিনি। ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক ছিলেন স্থানীয় পত্রিকা দৈনিক পত্রালাপেরও। তারও আগে কাজ করেছেন রংপুর থেকে প্রকাশিত দৈনিক দাবানল পত্রিকায়। বর্তমানে তিনি দৈনিক আজকের প্রতিভায় বার্তা সম্পাদক হিসেবে কর্মরত আছেন।

Advertisement

সংবাদকর্মীর পাশাপাশি আব্দুর রহমান দৈনিক উত্তর বাংলা, দৈনিক আজকের প্রতিভা ও দৈনিক পত্রালাপসহ একাধিক পত্রিকার প্রকাশনার উদ্যোক্তা ছিলেন। তার হাত ধরেই এসব পত্রিকা প্রথম প্রকাশনা শুরু করেছে বলে দাবি তার। কিন্তু বরাবরই তিনি হয়েছেন মালিক-সম্পাদকের বিরাগভাজন।

কারণ হিসেবে তিনি জানান, সংবাদপত্রে কাজ করার দীর্ঘ সময়ে তিনি এক হাজার টাকার বেশি বেতন কোনো দিনই পাননি। যখনি টাকা চেয়েছেন কিংবা সম্মানি বাড়াতে বলেছেন তখনই মালিক সম্পাদকের কাছে বিরাগভাজন হয়েছেন। অনেকবার চাকরিও হারিয়েছেন। তবে তিনি দমে জাননি। এত কিছুর পরেও সাংবাদিকতায় নিজের ভাগ্যের পরিবর্তন না ঘটাতে পারলেও অনেক মালিক সম্পাদকের ভাগ্যের পরিবর্তন ঘটিয়েছেন তিনি।

আব্দুর রহমান দিনাজপুর সাংবাদিক ইউনিয়নের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য। মানুষের অধিকার নিয়ে কথা বলা এই মানুষটি এখনও স্বপ্ন দেখেন দিনাজপুরের সাংবাদিকরা ঐক্যবদ্ধ হয়ে নিজেদের ভবিষ্যতের কথা মাথায় রেখে কল্যাণ তহবিল গঠন করবে। যাতে করে সারাজীবন সাংবাদিককে বেতন না দেয়া সম্পাদক মা মালিক দাফনের জন্য টাকা দিয়ে মহান না বনে যান।

স্বাধীনচেতা এই মানুষটি তার জীবনের চলার পথে স্ত্রী শাহানাজ বেগমকে সবচেয়ে সহযোগী ও অনুপ্রেরণার উৎস হিসেবে পেয়েছেন উল্লেখ করে বলেন, এই পেশায় এসেছিলেন দুঃখী, অসহায়, দরিদ্র ও অধিকার বঞ্চিত মানুষের কথা বলার জন্য। তা কতটুকু হয়েছে বলতে না পারলেও জীবনের পড়ন্ত বেলায় এসে বুঝেছেন স্ত্রী, সন্তানসহ পরিবারের লোকজনদের জন্য তিনি কিছুই করতে পারেননি।

Advertisement

তিনি বলেন, ১৯৮৪ সালে এরশাদের মার্শা ল'র সময় দৈনিক উত্তরায় ‘স্বাস্থ্য কর্মীদের সাইকেল ব্যবহার করছে সিভিল সার্জনের ছেলে’ শিরোনামে সংবাদ করে বিড়ম্বনায় পড়ি। ওই সময় দিনাজপুরের দায়িত্বে থাকা আর্মি অফিসার লে ক দেলোয়ার হোসেন তাকে চিঠি দিয়ে ডেকে পাঠান। সম্পাদক ভয় পেয়ে বলেন, রহমান আমি কিন্তু তোমার এই সংবাদের দায়-দায়িত্ব নেব না, তুমি সংবাদ করেছো, তুমিই সামলাও। যদিও পরিস্থিতি সামাল দিয়ে পরে আব্দুর রহমান সেই আর্মি অফিসারের কাছ থেকে সংবাদটি করার জন্য অভিনন্দনপত্র পেয়েছিলেন ।

সৃজনশীল নেশা থেকে সাংবাদিকতা পেশায় আসা আব্দুর রহমানের জীবন সঙ্গী শাহানাজ বেগম সব সময় চেয়েছেন স্বামীর সম্মান। এই দম্পতি সংসার জীবনে দুই ছেলে দুই মেয়ের জনক-জননী। ছেলে-মেয়ে সবাইকে উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত করেছেন। বড় ছেলে সাইদুর রহমান একটি ওষুধ কোম্পানিতে কর্মকর্তা পদে কর্মরত আছেন।

স্ত্রী শাহানাজ বেগম বলেন, ১৯৭০ সালে দিনাজপুর সরকারি কলেজ থেকে ডিগ্রি পাস করা স্বামী আব্দুর রহমানের সঙ্গে বিয়ে হয় ষষ্ঠ শ্রেড়িতে পড়ার সময়। সেই থেকে দেখে আসছেন স্বামীর সাংবাদিকতা। স্বামী ফেরেন মধ্যরাতে, কখনও বা শেষ রাতে। যা জীবনের সঙ্গে মানিয়ে নিয়েছেন। তবে চমকে উঠার বিষয় হচ্ছে সেই শিশু বয়সে স্বামীর সংসারে এসে এখনও তিনি স্বামী ঘরে না ফেরা পর্যন্ত রাতের খাবার খান না।

তিনি বলেন, সংসারে অভাব থাকলেও ভালোবাসার কমতি নেই। তাই তিনি স্ত্রী সন্তান ও শ্বশুরবাড়ির লোকজনদের নিয়ে বেশ সুখী। তিনি আরও খুশি, দিনাজপুরের সাংবাদিকরা তার হাতের চা খেতে খুব ভালোবাসেন। তাই তিনি অভাবের মধ্যেও চুলার ওপর সব সময় চায়ের পাতিল চাপিয়ে রাখেন।

কথা হয় বড় ছেলে মো. সাইদুর রহমানের সঙ্গে। তিনি বলেন, আমার বাবা একজন সাংবাদিক। এ জন্য আমরা গর্ববোধ করি। আরও গর্ববোধ করি যে, অনেক অভাব-অনটনের মধ্যেও তিনি নীতিতে অবিচল থেকে আমাদেরকে শিক্ষিত করে গড়ে তুলেছেন। নিজের আদর্শের সঙ্গে আপোস করেননি কোনো দিন।

এমদাদুল হক মিলন/এমএএস/পিআর