আন্তর্জাতিক

চীনে বন্দিশিবিরে আটকে মুসলিমদের ‘ব্রেনওয়াশ’

চীনে ২ কোটি মুসলিমের বসবাস রয়েছে। ইসলামি চরমপন্থা কমাতে মুসলমানদের ইসলামের পথ থেকে সরিয়ে চীনের রীতিনীতিতে অভ্যস্ত করার জন্য দেশটিতে খোলা হয়েছে বন্দিশিবির। শিবিরে অন্তত ৯ লাখ মানুষকে মানসিক ও শারীরিক নির্যাতনের শিকার হতে হচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে।

Advertisement

গত কয়েক বছরে চীনে ইসলামি সন্ত্রাসবাদ বেড়ে গেছে। কট্টরপন্থি উইঘুর মুসলমানদের হামলায় গত কয়েক বছরে মারা গেছে কয়েকশ’ মানুষ। এ কারণেই উইঘুর ও অন্যান্য সম্প্রদায়ের মানুষকে আটক করে তাদের মতাদর্শ পরিবর্তনের জন্য বন্দিশিবির খোলা হয়েছে।

আরও পড়ুন : সৌদিতে অভ্যুত্থানের ডাক : ক্ষমতা নিতে চাচাত ভাইকে যুবরাজের অনুরোধ

যেসব শিবিরে মুসলমানদের রাখা হচ্ছে, সেটাকে বলা হচ্ছে ‘ইনডকট্রিনেশন ক্যাম্প’ বা ‘দীক্ষাদান শিবির’। যদিও এটি মুসলমানদের কাছে ‘ব্রেইন ওয়াশ’ কেন্দ্র হিসেবেই বেশি পরিচিত। বন্দি শিবিরের একজন ওমির বেকালি তিনি নিজের দুঃসহ স্মৃতি বর্ণনা করেছেন বার্তাসংস্থা এপি’র কাছে।

Advertisement

কয়েক বছর আগে চীন থেকে কাজাখস্তানে চলে গিয়েছিলেন বেকালি। ২০১৭ সালে পরিবারের সঙ্গে দেখা করতে চীনে আসেন আসার পরই পুলিশ তাকে গ্রেফতার করে ইনডকট্রিনেশন ক্যাম্পে নিয়ে যায়। এপিকে দেয়া সাক্ষাৎকারে বেকালি সেই বন্দি শিবিরে তার উপর চলা অকথ্য নির্যাতনের বর্ণনা দিয়েছেন।

বেকালি জানান, আটকের এক সপ্তাহ পরে তাকে একটি অন্ধকার ঘরে বন্দি করে রাখা হয়। ২৪ ঘণ্টার মধ্যে কোনো খাবার বা পানি দেয়া হয়নি। যখন তিনি তাদের নির্দেশ মানতেন না, তখন দেয়ালের সামনে ৫ ঘণ্টা টানা দাঁড়িয়ে থাকতে হতো। টানা ২০ দিন ধরে তার উপর যে পাশবিক নির্যাতন চালানো হয়, তারপর তিনি আত্মহত্যা করতে চেয়েছিলেন।

আরও পড়ুন : ফিনল্যান্ড এত সুখী কেন?

তিনি বলেন, এই বন্দিশিবিরে যারা থাকেন, তাদের নিজেদের চিন্তাভাবনা অর্থাৎ ধর্মীয় চিন্তা পরিবর্তন করতে হয়। নিজেদের সম্প্রদায়কে ত্যাগের কথা ভাবতে বাধ্য করা হয়। মুসলমান ছাড়াও এ শিবিরে বিদেশি কয়েকজনকেও রাখা হয়েছে। ওই বন্দি শিবিরে যারা নির্দেশক ছিলেন, তারা কট্টরপন্থি এবং জঙ্গি সংগঠনগুলোর দৃষ্টান্ত দিয়ে ‘ইসলামের খারাপ দিক’ এবং ইসলামের কী কী ঝুঁকি রয়েছে, তা বলতেন।

Advertisement

বেকালির ভাষায়, এটা একটা অবর্ণনীয় যন্ত্রনা, ‘কেননা আমি নিজের ভাবনার সমালোচনা করছি, নিজের সম্প্রদায়কে অস্বীকার করার কথা ভাবছি।’ গত বছরের ডিসেম্বরে ওই বন্দিশিবির থেকে মুক্তি পান তিনি। কিন্তু সেই দুঃসহ স্মৃতি এখনো তাকে তাড়িয়ে বেড়ায়।

বন্দি শিবিরে সবাইকে খুব ভোরে উঠতে হতো। চীনের জাতীয় সংগীত গাইতে হতো। সকাল সাড়ে সাতটায় চীনের পতাকা উত্তোলন করতে হতো। এছাড়া এমন সব গান গাওয়া হতো যেগুলোতে কেবল কম্যুনিস্ট পার্টির প্রশংসা করা হয়েছে। এছাড়া তাদের চীনা ভাষা এবং চীনের ইতিহাস পড়তে হতো।

বেকালি জানান, খাবার হিসেবে প্রতিদিন সবজির স্যুপ আর রুটি দেয়া হয়। মাঝে মাঝে শুকরের মাংস এবং মদ খেতে বাধ্য করা হতো। তবে খাওয়ার আগে বাধ্যতামূলকভাবে কম্যুনিস্ট পার্টিকে ধন্যবাদ জানানোর পাশাপাশি মাতৃভূমি এবং চীনা রাষ্ট্রপতিকেও ধন্যবাদ জানাতে হয়।

আরও পড়ুন : তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ কী শুরু হবে?

চীনের পশ্চিমাঞ্চলের জিনজিয়াং এলাকায় এই বন্দিশিবিরগুলো স্থাপনের লক্ষ্য হলো মানুষের রাজনৈতিক চেতনায় পরিবর্তন আনা। তাদের নিজেদের ধর্মীয় চিন্তাভাবনা পুরোপুরি দূর করা এবং তাদের নতুন রূপে পরিচয় করানো।

জিনজিয়াং থেকে নির্বাসিত মানুষদের দ্বারা পরিচালিত তুরস্ক ভিত্তিক একটি টেলিভিশন জানিয়েছে, তাদের কাছে বেশ কিছু ফাঁস হওয়া সরকারি তথ্য রয়েছে, যার মাধ্যমে জানা গেছে, এসব বন্দিশিবিরে ৯ লাখ মানুষ বন্দি আছে। যুক্তরাষ্ট্রের একটি সংস্থার মতে, সংখ্যালঘুদের এত বিশাল গণ কারাগার বিশ্বে আর কোথাও নেই।

আরও পড়ুন : সেনা অভ্যুত্থানের হুমকিতে ইরান?

চীনা কর্তৃপক্ষ এই বন্দিশিবিরের কথা স্বীকার করে না। তবে রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যম জানিয়েছে, ইসলামি চরমপন্থার বিরুদ্ধে লড়তে মতাদর্শ পরিবর্তন করা দরকার। বার্তাসংস্থা এপি বন্দিশিবিরের বেশ কয়েকজন বন্দি এবং নির্দেশকের সাক্ষাৎকার নিয়েছেন। প্রত্যেকেই নাম প্রকাশ করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছেন। কেননা, তাদের পরিবার রয়েছে চীনে।

বেকালি কাজাখস্তান ফিরে গেছেন। ভেবেছিলেন কারো কাছে কিছু বলবেন না। কিন্তু গত মার্চে চীনা কর্তৃপক্ষ তার বাবা-মা এবং বোনকে ধরে নিয়ে যায়। তাই তিনি সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করে বিশ্বকে তার গল্প বলার সিদ্ধান্ত নেন। বেকালি জানান, তিনি এসব কথা জানাতে চান। কারণ, তার আর হারানোর কিছু নেই। ডিডব্লিউ।

এসআইএস/এমএস