পৃথিবীর সবচেয়ে জনপ্রিয় ফুটবল টুর্নামেন্ট ‘দ্য গ্রেটেস্ট শো অন আর্থ’- অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে আর মাত্র কয়েকদিন পরেই। ব্রাজিল, আর্জেন্টিনা, ইংল্যান্ড, স্পেন, জার্মানি, ফ্রান্সের মতো জনপ্রিয় ও নামধারী দলগুলোর সাথে চমকে দেয়া কিছু দল যেমন আছে তেমনি বিশ্বকাপের বাছাইপর্ব থেকেই বিদায় নিতে হয়েছে ৪বারের শিরোপা জয়ী ইতালিকেও।
Advertisement
গত দুই-তিনটি বিশ্বকাপজুড়ে দেখা গেছে বড় দলগুলোকে জিততেও কত ঘাম ঝরাতে হয়েছে। ৯০ মিনিটের খেলায় একটি পাস বা একটি দুর্দান্ত ফ্রি কিক, সামান্য ভুলে পাওয়া পেনাল্টি কিংবা দুর্দান্ত একটি কাউন্টার অ্যাটাক বা গোলরক্ষকের সেভ বা ভুল ম্যাচের মোড় এক নিমিষেই ঘুরিয়ে দিতে পারে।
এতে যেমন নামি-ধামি দলগুলোর শিরোপা মিশন গুঁড়িয়ে যেতে পারে, তেমনি ছোটদলগুলোর জন্য হতে পারে একটি দুর্দান্ত ইতিহাস। সেই ইতিহাসের উপর ভর করেই কোনো দেশ তাদের ফুটবলকে নিয়ে যেতে পারে বহুদূর। আবার সেই একটি সামান্য ভুলেই কিংবদন্তী অনেক ফুটবলারের সারা জীবনের বিশ্বকাপ থেকে যায় এক আক্ষেপের নাম হিসেবে। বিশ্বকাপের তেমনই ৫টি ম্যাচের কথা তুলে ধরা হবে, যেগুলো কি না বিশ্বকাপের সেরা অঘটন হিসেবে বিবেচিত...
১৯৫০ : যুক্তরাষ্ট্র ১-০ ইংল্যান্ড ১৯৫০ সালের বিশ্বকাপে ইংল্যান্ডকে হারানোর ম্যাচটি যুক্তরাষ্ট্রের ফুটবল ইতিহাসের সর্বশ্রেষ্ঠ জয়। ম্যাচটি যেন তাদের জন্য স্বর্গের দুয়ারেই অনুষ্ঠিত হয়েছিল। আমেরিকার ফুটবল দল তখনকার সময়ে আনকোরা দলগুলোর বাইরে আর কিছুই নয়। আর ইংল্যান্ড সেই বিশ্বকাপের টপ ফেবারিট হিসেবেই টুর্নামেন্ট শুরু করেছিল।
Advertisement
প্রথম ম্যাচে যুক্তরাষ্ট্রকে ৩-১ গোলে ধরাশায়ী করেছিল স্পেন। যে কারণে বেলো হরাইজন্তের এস্টাডিও ইন্ডেপেন্ডেনসিয়ায় ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে নুন্যতম প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারবে যুক্তরাষ্ট্র- এমন ধারনাও ছিল বাতুলতা মাত্র। হারানোর কথা তো স্বপ্নেরও অতীত। ইংল্যান্ড শুরুও করেছিল তেমন। একের পর এক আক্রমণে যুক্তরাষ্ট্রের রক্ষণভাগকে তটস্থ করে রাখে। কিন্তু বাদ সাধে একজন তিনি হলেন যুক্তরাষ্ট্রের গোলরক্ষক ফ্রাঙ্ক বোরঘি।
তার অসাধারন সেভগুলোই যেন আমেরিকার বাকি খেলোয়াড়দের জন্য অনুপ্রেরণা হয়ে এলো। ৩৭ মিনিটের মাথায় জয় গায়েতজেন্সের গোলে ১-০তে এগিয়ে যায় যুক্তরাষ্ট্র। দ্বিতীয়ার্ধের খেলায় আরও সাহসী হয়ে ওঠে তারা। ইংল্যান্ডের সেরা আক্রমণভাগ এই গোল আর পরিশোধ করতে না পারায় ইতিহাসের অন্যতম সেরা অঘটন ঘটিয়ে জয় তুলে নেয় আমেরিকা।
১৯৫০ : ব্রাজিল ১-২ উরুগুয়ে সাম্বা ফুটবল সৌন্দর্যের অধিকারী ব্রাজিল ১৯৫০ সালের বিশ্বকাপে আক্ষরিক অর্থেই ছিল টপ ফেবারিট। প্রতিপক্ষের জালে ১১টি গোল করে অপ্রতিরোধ্য ব্রাজিল উরুগুয়ের বিপক্ষে ফাইনাল রাউন্ডের শেষ ম্যাচের আগেই শিরোপা উৎসবের প্রস্তুতি গ্রহণ করে।
ফাইনাল রাউন্ডের শেষ ম্যাচে ড্র করলেই শিরোপা নিশ্চিত। অন্যদিকে উরুগুয়ের সামনে জয় ব্যতীত অন্য কোনো উপায় ছিল না। আক্ষরিক অর্থে ফাইনালে পরিণত হওয়া ওই ম্যাচে আক্রমণাত্মক ব্রাজিলের বিপরীতে উরুগুয়ে কিছুটা ডিফেন্সিভ খেলাই শুরু করে।
Advertisement
প্রথমার্ধে কোনো দল গোল না পেলেও দ্বিতীয় অর্ধের প্রথম মিনিটেই স্বাগতিক ব্রাজিল ফ্রিয়াকার গোলে এগিয়ে গেলে মারাকানার ২ লক্ষ দর্শক প্রথম শিরোপা জয়ের উৎসবের আয়োজন প্রায় শুরুই করে দিয়েছিল। কিন্তু নিয়তি যে তখন ভিন্ন কিছুই লিখে রেখেছিল ব্রাজিলিয়ানদের ললাটে!
৬৬ মিনিটের মাথায় উরুগুয়েকে সমতায় ফেরান শিয়াফিনো। সমতায় ফেরার পর উদ্যমি উরুগুয়ে ৭৯ মিনিটের মাথায় ঘিগিয়ার গোলে ২-১ ব্যবধানে এগিয়ে যায়। শেষ সময় পর্যন্ত ব্রাজিল তাদের আধিপত্য দেখানোর চেষ্টা করলেও আর গোল করতে পারেনি।
ব্রাজিলের ইতিহাসে প্রথমবার শিরোপা জয়ের তুমুল সম্ভাবনা হাত ছাড়া হওয়ার পর অনেকেই বলেন, স্টেডিয়ামেই আত্মহত্যা করেছিল ৫০ জনের বেশি মানুষ। কেউ কেউ বলেন হার্ট অ্যাটাকে শতাধিক সমর্থক মারা গিয়েছিলেন। যেটাকে মারাকানা ট্রাজেডি হিসেবেই চেনে সবাই।
১৯৫৪ : পশ্চিম জার্মানি ৩-২ হাঙ্গেরি ১৯৫৪ বিশ্বকাপে হাঙ্গেরির যে দলটি খেলেছিল, তাদেরকে বলা হয় বিশ্বকাপের ইতিহাসে অন্যতম সেরা দল। ফেরেঞ্চ পুসকাস, স্যান্ডর ককসিস কিংবা হিদেকুটিদের মত সর্বকালের সেরা ফুটবলাররা ছিলেন হাঙ্গেরির তখনকার দলটিতে। গ্রুপ পর্বে পশ্চিম জার্মানিকে ৮-৩ গোলে হারিয়েছিল পুসকাস-ককসিসদের হাঙ্গেরি।
সেই পশ্চিম জার্মানির বিরুদ্ধে ফাইনালে হেরে বসলো হাঙ্গেরি। ফুটবল ইতিহাসে অতি আশ্চর্যজনক চমকগুলোর মধ্যে নিশ্চিতভাবেই এটা থাকবে শীর্ষে। হাঙ্গেরির এই পরাজয় দুটি দিক থেকে তাৎপর্যপূর্ণ। এই একটি ম্যাচ জিতলে পুসকাসের নাম নেয়া হত পেলে-ম্যারাডোনা-ডি স্টেফানোদের সাথে। দ্বিতীয়ত, এই একটি শিরোপা জয় হয়তো হাঙ্গেরির ফুটবল ইতিহাসকেই পাল্টে দিত। হয়তো বা এই সময়ে জার্মানি, ব্রাজিল, আর্জেন্টিনা কিংবা ইতালির সঙ্গে উচ্চারিত হতো তাদের নামও।
টপ ফেবারিট হাঙ্গেরি ৪ বছর অপরাজিত থেকে বিশ্বকাপে অংশ নেয়। গ্রুপ পর্বের পশ্চিম জার্মানিকে ৮-৩ গোলে বিধ্বস্ত করার পর ফাইনালেও সবাই ভেবেছিল জার্মানরা উড়ে যাবে হাঙ্গেরির সামনে। শুরুর দিকেও প্রায় একইরকম বিধ্বস্ত করার ইঙ্গিতও দিচ্ছিল তারা। প্রথম ১০ মিনিটে পুসকাস আর জিবোরের গোলে ২-০ ব্যবধানে এগিয়ে গিয়েছিল হাঙ্গেরি।
যখন শিরোপার সুবাস পেতে শুরু করেছিল হাঙ্গেরিয়ানরা, ঠিক তার ১০ মিনিট পরই সব হিসাব পাল্টে দিয়ে সমতা আনে পশ্চিম জার্মানি। ১৬ মিনিটে প্রথম গোল করে জার্মানি। ১৮ মিনিটে দ্বিতীয় গোল করেন হেলমুট রান। সেই রানই শেষ পর্যন্ত ৮৪ মিনিটের মাথায় জয়সূচক গোল করে পশ্চিম জার্মানিকে শিরোপার আনন্দে ভাসিয়ে তোলেন। একই সঙ্গে ইতিহাসের পাতা থেকে মুছে দেয় পুসকাস এবং তার দল হাঙ্গেরির নাম।
১৯৬৬ : উত্তর কোরিয়া ১-০ ইতালি এশিয়ান মহাদেশ থেকে প্রথম কোনো দল হিসেবে ১৯৬৬ সালের ইংল্যান্ড বিশ্বকাপে অংশ নেয় উত্তর কোরিয়া। বিশ্বকাপে নাম লেখানোর পরই যেন নিজেদের প্রমাণ করার মিশণে নামে উত্তর কোরিয়ানরা। ওই বিশ্বকাপে টপ ফেবারিট হিসেবে শিরোপা জয়ের লক্ষ্য নিয়ে ইংল্যান্ড এসেছিল ইতালি। চিলিকে প্রথম ম্যাচে ২-০ গোলে হারানোর পর উত্তর কোরিয়ার বিপক্ষে ম্যাচটি ড্র হলেই পরের রাউন্ডে উত্তীর্ণ হবে আজ্জুরিরা।
এমন সমীকরণ সামনে রেখেই উত্তর কোরিয়ার মুখোমুখি হয় ইতালি। ইউরোপ মাতানো ইতালির মহাতারকাদের সামনে উত্তর কোরিয়া শুধু অংশগ্রহণ বৈ আর কিছু ছিল না। অনেকেই মনে করেছিল, উত্তর কোরিয়া হয়তো উড়ে যাবেন এই ম্যাচে; কিন্তু এমন ম্যাচেই কি না বিশ্বকাপের ইতিহাসে অন্যতম সেরা অঘটনটির জন্ম দেয় কোরিয়ানরা।
প্রথমার্ধেই (৪২ মিনিটে) প্যাক ডু ইকের একমাত্র গোলে ইতালি পিছিয়ে পড়ে। শেষ পর্যন্ত আর খেলায় ফিরতে পারেনি তারা। প্যাকের সেই একটি গোলই ইতালিকে প্রথম রাউন্ড থেকে ছিটকে দিয়েছিল। প্রথমবার বিশ্বকাপে নাম লিখেই ওই জয়ের কারণে কোয়ার্টার ফাইনালের টিকিট পেয়ে যায় উত্তর কোরিয়া। সোভিয়েত ইউনিয়নের কাছে ৩-০ গোলে হারলেও চিলির সঙ্গে ১-১ গোলে ড্র করেছিল উত্তর কোরিয়া। কোয়ার্টারে অবশ্য ইউসেবিওর হ্যাটট্রিকের সামনে টিকতে পারেনি কোরিয়া উপদ্বীপের এই দেশটি। হেরে গিয়েছিল ৫-৩ গোলে।
১৯৮২: আলজেরিয়া ২-১ পশ্চিম জার্মানি১৯৮২ বিশ্বকাপে আফ্রিকান দেশ আলজেরিয়া মুখোমুখি হয় শক্তিশালী পশ্চিম জার্মানির বিরুদ্ধে। আলজেরিয়া দল হিসেবে মোটামুটি মানের হলেও ঐতিহাসিকভাবে বিখ্যাত জার্মানির বিরুদ্ধে তেমন কোনো প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারবে বলে ফুটবল বোদ্ধারা ধারনা করতে পারেননি। তবে সবাইকে তাক লাগিয়ে আলজেরিয়া জার্মানির বিরুদ্ধে ২-১ এর জয় তুলে নেয়।
পশ্চিম জার্মানির বিরুদ্ধে এমন ঐতিহাসিক জয়ও দ্বিতীয় পর্বে যেতে আলজেরিয়ার জন্য যথেষ্ট হয়নি। গ্রুপ পর্বের শেষ ম্যাচে অস্ট্রিয়া ও পশ্চিম জার্মানির মধ্যকার ম্যাচের সমীকরণ ছিল, পশ্চিম জার্মানির ১ বা ২ গোল ব্যবধানের জয় আলজেরিয়াকে সরিয়ে তাদের দুই দলকেই পরের পর্বে নিয়ে যাবে। আলজেরিয়াকে দ্বিতীয় পর্বে না তুলতে জার্মানি এবং অস্ট্রিয়া কুট কৌশলের আশ্রয় নে।
জার্মানরা প্রথম ১০ মিনিটেই ১-০ গোলে এগিয়ে থাকার পর বাকি ৮০ মিনিটে কোনো দলই কাউকে আক্রমণ না করে ম্যাড়ম্যাড়ে একটি ম্যাচের প্রদর্শনী শুরু করে। দুই দলের এমন কান্ডে ফিফা শেষ পর্যন্ত বিশ্বকাপের নিয়ম পর্যন্ত পরিবর্তন করে ফেলে। গ্রুপ পর্বের শেষ দুই ম্যাচ একই সময়ে করার সিদ্ধান্ত এরপর থেকেই গ্রহণ করা হয় ।
আইএইচএস/এমএস