>> উন্নয়ন খাতে বরাদ্দ হচ্ছে ১ লাখ ৭৫ হাজার কোটি টাকা>> ১০ মেগা প্রকল্পের দ্রুত বাস্তবায়ন, রেকর্ড সংখ্যক নতুন প্রকল্প>> সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর আওতায় আসছে এক কোটি মানুষ>> সর্বজনীন পেনশন ইন্স্যুরেন্স স্কিমের রূপরেখা প্রণয়নের উদ্যোগ
Advertisement
প্রতি বছরই বাজেট প্রণয়ন হয়, বাড়ে বরাদ্দ। তবে নির্বাচনী বছর হওয়ায় এবার বাজেট প্রণয়নে জনবান্ধব বেশকিছু উদ্যোগ গ্রহণ করছে সরকার। উন্নয়ন খাতে রেকর্ড পরিমাণ অর্থাৎ প্রায় এক লাখ ৭৫ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হচ্ছে। এছাড়া নতুন করে কর না বাড়িয়ে এর আওতা ও করমুক্ত আয়সীমা বাড়ানো, সর্বজনীন পেনশন ইন্স্যুরেন্স স্কিমের রূপরেখা প্রণয়ন, প্রায় এক কোটি মানুষকে সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর আওতায় আনা উল্লেখযোগ্য।
এছাড়া বাজেটে সরকারের নির্বাচনী ইশতেহারের প্রতিশ্রুত প্রকল্পগুলো গুরুত্ব পাচ্ছে। এসব উন্নয়ন খাতকে গুরুত্ব দিয়ে ২০১৮-১৯ অর্থবছরের জন্য আগামী ৭ জুন জাতীয় সংসদে চার লাখ ৬৮ হাজার কোটি টাকার বাজেট প্রস্তাব করতে পারেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
প্রতি বছরই বাজেটের আকার বাড়ছে কিন্তু বাস্তবায়ন কতটুকু হচ্ছে তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ড. এ বি মির্জা আজিজুল ইসলাম। তিনি বলেন, ‘২০১১-১২ অর্থবছরে বাজেটের বাস্তবায়নের হার ছিল ৯২ শতাংশ। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে এটা কমে দাঁড়ায় ৭২ শতাংশে। কাজেই শুধু বরাদ্দ রাখলে হবে না। বাস্তবায়ন কতটুকু হলো সেটাই উল্লেখযোগ্য। বাস্তবায়নহীন বরাদ্দ বাড়ানো আমি অর্থহীন বলে মনে করি।’
Advertisement
অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, মধ্য আয়ের দেশে উন্নীত করতে বিনিয়োগ ও ব্যবসাবান্ধব কর্মসূচি গ্রহণ করা হবে আগামী বাজেটে। সুদের হার নামিয়ে আনা হবে সিঙ্গেল ডিজিটে। সাধারণ মানুষের কথা বিবেচনায় রেখে সঞ্চয়পত্রের সুদের হার কমানো হচ্ছে না। দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে মূল্যস্ফীতির লাগাম টেনে ধরার উদ্যোগ থাকছে। চলতি অর্থবছর লক্ষ্যমাত্রা অতিক্রম করায় আগামী অর্থবছরে জিডিপি প্রবৃদ্ধি নির্ধারণ করা হতে পারে আট শতাংশ। ভর্তুকির পরিমাণ বাড়ানো হবে।
এমপিও’র মতো বন্ধ অনেক কর্মসূচি ফের চালুর বিষয় বিবেচনায় নেয়া হচ্ছে। ঢাকা শহর যানজটমুক্ত করতে দ্রুত মেট্রোরেল প্রকল্পের বাস্তবায়নসহ নতুন কর্মসূচি গ্রহণ করা হবে। এছাড়া নির্বাচন সামনে রেখে ১০ মেগা প্রকল্প দ্রুত বাস্তবায়নসহ বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি এডিপিতে রেকর্ড সংখ্যক নতুন প্রকল্প নেয়া হবে। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের এসব নির্দেশনা নিয়েই অর্থ মন্ত্রণালয় ২০১৮-১৯ সালের বাজেট প্রণয়নের কাজ এগিয়ে নিচ্ছে।
গরিব মানুষের সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ভাতার পরিমাণ বৃদ্ধি এবং আওতা সম্প্রসারণেরও উদ্যোগ থাকছে এবারের বাজেটে।
২০১৮-১৯ অর্থবছরে প্রায় এক কোটি মানুষকে সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর আওতায় নিয়ে আসার পরিকল্পনা করা হচ্ছে। কর্মসূচির আওতায় দেশের দুস্থ, অবহেলিত, সমস্যাগ্রস্ত ও পশ্চাৎপদ জনগোষ্ঠীর কল্যাণ নিশ্চিত করা হবে। চলতি বাজেটে ৬৭ লাখ উপকারভোগী সামাজিক নিরাপত্তার আওতায় বিভিন্ন ধরনের ভাতা পাচ্ছেন। পাশাপাশি আগামী বাজেটে সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর আওতায় অন্যান্য ভাতাসমূহ ১০ ভাগ বৃদ্ধিও করা হতে পারে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে।
Advertisement
আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে প্রতিটি জেলা ও উপজেলায় একটি করে মডেল মসজিদ ও ইসলামিক সাংস্কৃতিক কেন্দ্র নির্মাণের পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে। এ প্রকল্প বাস্তবায়নে অর্থ মন্ত্রণালয়ের কাছে আসন্ন বাজেটে তিন হাজার ১৮০ কোটি টাকা বরাদ্দ চেয়েছে ধর্ম মন্ত্রণালয়। প্রধানমন্ত্রীর প্রতিশ্রুত এ প্রকল্পে অর্থ বরাদ্দের সুপারিশ করেছে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ও। পাশাপাশি মডেল মসজিদ ও ইসলামিক সাংস্কৃতিক কেন্দ্র নির্মাণে সারা দেশের জনপ্রতিনিধিদের সম্পৃক্ত করতে নির্দেশ দেয়া হয়েছে।
দেশকে বেকারত্বের অভিশাপ থেকে মুক্তি দিতে আগামী বাজেটে মানবসম্পদ উন্নয়নকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে। এজন্য পৃথক স্কিল ডেভেলপমেন্ট ইনস্টিটিউট ও মন্ত্রণালয় গঠনেরও প্রস্তাব করা হবে।
অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্র বলছে, আগামী বাজেটকে সামনে রেখে অর্থ মন্ত্রণালয়ে উন্নয়ন ব্যয় বাড়ানোর অসংখ্য প্রস্তাব পাঠিয়েছে বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও সংস্থা। দুই লাখ ৫২ হাজার ৭৩৮ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব ৭৪টি মন্ত্রণালয় ও সংস্থার কাছ থেকে পেয়েছে অর্থ মন্ত্রণালয়। প্রতিটি প্রস্তাবে গত বছরের তুলনায় বরাদ্দ বেশি চাওয়া হয়েছে। তবে এসব প্রস্তাবের বিপরীতে প্রাথমিকভাবে এক লাখ ৭৫ হাজার ৮৩৫ কোটি টাকা দেয়ার সুপারিশ করেছে মন্ত্রণালয়।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা জানান, অর্থ বরাদ্দের দাবি নিয়ে প্রতিটি মন্ত্রণালয় ও সংস্থার সঙ্গে ধারাবাহিক বৈঠক করা হয়েছে। প্রস্তাবগুলো পর্যালোচনার পর অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে নতুনভাবে বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। তবে আগামীতে এ বরাদ্দের পরিমাণ প্রয়োজনে কিছুটা বাড়তে বা কমতে পারে।
সূত্র মতে, আগামী বাজেটে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে (এডিপি) সম্ভাব্য বরাদ্দ রাখা হচ্ছে এক লাখ ৭৮ হাজার ২৯৬ কোটি টাকা। এ ব্যয়সীমার মধ্যে থেকেই মন্ত্রণালয় ও সংস্থাগুলোর উন্নয়নব্যয় বাড়ানোর প্রস্তাব বিবেচনা করা হবে। জানা গেছে, আসন্ন বাজেটে মন্ত্রণালয়গুলো গুরুত্ব দিচ্ছে স্বল্পমেয়াদি উন্নয়ন প্রকল্পকে- যা নির্বাচনী বছরের মধ্যে সমাপ্ত করা যায়। এসব প্রকল্পের উপকার সরাসরি ভোগ করতে পারবেন ভোটাররা। ফলে এসব প্রকল্পের চাপে বেড়ে যাচ্ছে মন্ত্রণালয়গুলোর ব্যয়।
আগামী বাজেটে উন্নয়ন খাতে ব্যয়ের জন্য ৭৩টি মন্ত্রণালয় ও সংস্থার অনুকূলে এখন পর্যন্ত এক লাখ ৭৫ হাজার ৭৩৮ কোটি টাকা বরাদ্দ চূড়ান্ত করা হয়েছে। এর মধ্যে ২৭ হাজার ৮৫১ কোটি টাকা বরাদ্দ দেয়া হচ্ছে স্থানীয় সরকার বিভাগকে। এক হাজার ৭৬০ কোটি টাকা দেয়া হচ্ছে কৃষি মন্ত্রণালয়কে। পাঁচ হাজার ৭২৬ কোটি টাকা বরাদ্দ দেয়া হচ্ছে পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়কে, ১৩ হাজার ২৫৬ কোটি টাকা দেয়া হচ্ছে সড়ক ও মহাসড়ক বিভাগকে, ১৫ হাজার ৩৩৫ কোটি টাকা বরাদ্দ দেয়া হচ্ছে রেল বিভাগকে এবং বিদ্যুৎ বিভাগকে দেয়া হচ্ছে ৩১ হাজার ৯৫২ কোটি টাকা।
এছাড়া প্রাথমিক ও শিক্ষা বিভাগ আট হাজার ৫০০ কোটি, মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগ চার হাজার ৮৯০ কোটি, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিভাগ ১৩ হাজার ৮৮০ কোটি, স্বাস্থ্যসেবা বিভাগ আট হাজার ১৮৩ কোটি এবং তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি খাতে এক হাজার ৭৮৫ কোটি টাকা বরাদ্দ দেয়া হচ্ছে।
সাত হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ থাকছে সেতু বিভাগে, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা বিভাগে বরাদ্দ দেয়া হচ্ছে এক হাজার ৫৮৪ কোটি টাকা। অন্যান্য মন্ত্রণালয় ও সংস্থাকেও আগের তুলনায় বেশি অর্থ বরাদ্দ দেয়া হচ্ছে।
এদিকে অর্থ মন্ত্রণালয় বরাদ্দ চূড়ান্ত করলেও বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও সংস্থার প্রস্তাবে অর্থদাবির পরিমাণ অনেক বেশি ছিল। আগামী বাজেটে উন্নয়ন কর্মসূচি বাস্তবায়নের জন্য ৪০ হাজার ৯৯৮ কোটি টাকা বরাদ্দ চায়েছিল স্থানীয় সরকার বিভাগ, দুই হাজার কোটি টাকা চেয়েছিল কৃষি মন্ত্রণালয়, সাত হাজার ৪১ কোটি টাকা চেয়েছিল পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়, ৩৮ হাজার ৪০ কোটি টাকা চেয়েছির সড়ক ও মহাসড়ক বিভাগ, ১৮ হাজার ৮৭০ কোটি টাকা রেল বিভাগ এবং বিদ্যুৎ বিভাগ চেয়েছিল ৩১ হাজার ৬২৭ কোটি টাকা।
এছাড়া প্রাথমিক ও শিক্ষা বিভাগ নয় হাজার ২০০ কোটি, মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগ ১১ হাজার ২৭ কোটি, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিভাগ নয় হাজার ২৪৭ কোটি, স্বাস্থ্যসেবা বিভাগ ১০ হাজার ২৪০ কোটি এবং তথ্য এবং যোগাযোগ প্রযুক্তি মন্ত্রণালয় চেয়েছিল তিন হাজার ৬১১ কোটি টাকা। নয় হাজার ২৪৬ কোটি টাকা চেয়েছিল সেতু বিভাগ, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা বিভাগ চেয়েছিল চার হাজার ৮১৩ কোটি টাকা।
এ প্রসঙ্গে অর্থসচিব মোহাম্মদ মুসলিম চৌধুরী জাগো নিউজকে বলেন, নির্বাচনী বছর অনুযায়ী বাজেট দেয়া হচ্ছে। বাজেটের আকারও বাড়ানো হচ্ছে। ইতিপূর্বে যেসব মেগা প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছিল সেগুলো দ্রুত বাস্তবায়নে কাজ করছে সরকার।
এ বিষয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ড. এ বি মির্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, বরাদ্দ তো সব বছরই বড়ানো হয়, অতিমাত্রায় বড়ানো হয়। কিন্তু বাস্তবায়ন তো হয় না। আমাদের দেশের মূল সমস্যা হলো বাস্তবায়ন। গত পাঁচ বছরে বাজেটে যে পরিমাণ বরাদ্দ থাকছে তার বাস্তবায়ন আনুপাতিক হারে কমে যাচ্ছে।
‘২০১১-১২ অর্থবছরে বাজেট বাস্তবায়নের হার ছিল ৯২ শতাংশ। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে এটা কমে দাঁড়ায় ৭২ শতাংশে। কাজেই শুধু বরাদ্দ রাখলে হবে না। বরাদ্দ দিয়ে মানুষকে তুষ্ট রাখা যেতে পারে যে আমরা এ কাজের জন্য এত টাকা বরাদ্দ দিয়েছি, ওই কাজের জন্য এত বরাদ্দ দিয়েছি। কিন্তু বাস্তবায়ন কতটা হলো সেটার তো কেউ খোঁজ রাখে না। কাজেই বাস্তবায়নহীন বরাদ্দ বাড়ানো আমি অর্থহীন বলেই মনে করি।’
তিনি আরও বলেন, ‘কোন কোন ক্ষেত্রে বরাদ্দ দেয়া হচ্ছে সেটাও দেখতে হবে। এখন তো দেখা যাচ্ছে মাদরাসার জন্য বড় ধরনের বরাদ্দ রাখা হচ্ছে। এটার কতটুকু যৌক্তিকতা, আমি বুঝতে পারলাম না।’
এমইউএইচ/এমবিআর/এমএআর/এমএস