ভ্রমণ

কম খরচে মেঘের রাজ্যে

যেসব প্রকৃতিপ্রেমী তুলনামূলক কম খরচে দেশের বাইরে ভ্রমণ করতে আগ্রহী তাদের জন্য আদর্শ পছন্দ হতে পারে মেঘালয়। বাংলাদেশের উত্তর-পূর্ব সীমান্তবর্তী ভারতীয় রাজ্য মেঘালয় ভ্রমণ সম্পর্কে বিস্তারিত জানাচ্ছেন সাইফুর রহমান তুহিন-

Advertisement

চোখ জুড়ানো পাহাড়ি দৃশ্য আর শীতল আবহাওয়ার কারণে এ রাজ্যের রাজধানী শিলং শহরকে বলা হয় ‘প্রাচ্যের স্কটল্যান্ড’। সমুদ্রপৃষ্ট থেকে শহরটির উচ্চতা প্রায় ১,৫০০ মিটার। বিশ্বের সবচেয়ে বৃষ্টিবহুল স্থান চেরাপুঞ্জিও মেঘালয়েই অবস্থিত। এ রাজ্যের ভৌগলিক কাঠামো অনেকটা পশ্চিমবঙ্গের দার্জিলিং, সিকিম ও হিমাচল প্রদেশের মতো। তবে উল্লিখিত তিনটি জায়গার তুলনায় মেঘালয়ে বেড়ানোর খরচ তুলনামূলক কম। পুরোটাই ঘন সবুজ বনানীতে আচ্ছাদিত এ রাজ্যের নয়নাভিরাম পাহাড়ি দৃশ্য, দৃষ্টিনন্দন লেকসমূহ, নদী অববাহিকা, বিচিত্র প্রজাতির পশুপাখি সবকিছুই এককথায় অসাধারণ।

যেভাবে যাবেন মেঘালয়ে যেতে হলে আপনাকে আগে সড়ক, রেল কিংবা আকাশপথে সিলেট শহরে পৌঁছতে হবে। রাত্রিযাপন করার জন্য মানসম্পন্ন আবাসিক হোটেলের কোনো অভাব নেই সিলেটে। তবে হযরত শাহজালালের (র.) মাজারের আশেপাশে পাবেন বিভিন্ন বাজেটের অনেকগুলো হোটেল। শহর থেকে প্রায় ৪৫ কিলোমিটার দূরের তামাবিল সীমান্ত চেকপোস্টে যাওয়ার জন্য কার কিংবা মাইক্রোবাস ভাড়া করতে পারেন হোটেল কর্তৃপক্ষের সহায়তা নিয়েই। সকালে একটু আগে ঘুম থেকে জেগে নাস্তা সেরে গাড়িতে উঠে পড়ুন। তামাবিল পৌঁছতে ৩০-৪০ মিনিট লাগতে পারে। তারপর তাড়াতাড়ি কাস্টমস ও ইমিগ্রেশনের কাজ সেরে ফেলুন। জিরো লাইন অতিক্রম করেই পেয়ে যাবেন ভারতীয় ইমিগ্রেশন অফিস। এরপর ট্যাক্সি ভাড়া করতে পারেন দুই কিলোমিটার দূরের ডাউকি বাজারে যাওয়ার জন্য। এখানে পৌঁছে একটি কার অথবা জিপ ভাড়া করতে হবে নিরাপদে শিলং যাওয়ার জন্য। কারের জন্য আনুমানিক ১,৫০০ রুপি লাগতে পারে। পর্যটকের সংখ্যা বেশি হলে জিপ লাগবে। ১০-১২ জনের একটি জিপের জন্য আনুমানিক ২,৫০০ ভারতীয় রুপি লাগতে পারে। পাবলিক পরিবহনও আছে তবে তা আরামদায়ক হবে না। স্থানীয় সময় দুপুর ১২টার মধ্যেই রওনা হওয়া উচিত। কারণ সূর্যাস্তের পর ডাউকি-শিলং সড়কে যানবাহন প্রায় চলেই না। ডাউকি থেকে শিলংয়ের দূরত্ব প্রায় ৮৩ কিলোমিটার যা অতিক্রম করতে সময় লাগবে আড়াই ঘণ্টার মতো। আকাশ পরিচ্ছন্ন থাকলে এ ভ্রমণ বেশ উপভোগ্য। রাস্তার দু’পাশেই আছে ঘন সবুজ পাহাড়, ঝরনা আর বিশালাকৃতির সব প্রস্তরখণ্ড। যাত্রা শুরুর মিনিট বিশেকের মাথায়ই দেখবেন মেঘ এসে গেছে আপনার সমান্তরালে। গাড়ির জানালা দিয়ে হাত বাড়িয়ে তা ধরতে পারবেন তবে মুঠোর ফাঁক গলে ঠিকই বেরিয়ে যাবে। যাত্রাপথে মাত্র দুটি বাজার পড়বে যার একটি পিনুরসলা আর অপরটি লাইলিংকট। তবে এগুলোতে নেমে কিছু খাওয়া বা পান করা এড়িয়ে যাওয়াই ভালো।

শিলংয়ে পৌঁছার পরবাংলাদেশে থাকতেই ইন্টারনেটে শিলংয়ের কোনো হোটেলে অগ্রিম বুকিং দিলে খুবই ভালো হবে। তুলনামূলক সস্তা হোটেলগুলো নগরীর প্রাণকেন্দ্র পুলিশ বাজারে অবস্থিত। হোটেল ব্রডওয়ে, হোটেল সেন্টার পয়েন্ট, হোটেল মিকাসা, হোটেল জে.কে. ইন্টারন্যাশনাল, হোটেল বুলভার্ড, ইডেন রেসিডেন্সি, হোটেল অ্যাম্বাসি, হোটেল পাইনবরো প্রভৃতি হলো পুলিশ বাজারের প্রধান প্রধান হোটেল। পুলিশ বাজারের বাইরে সুপরিচিত হোটেল হচ্ছে হোটেল পাইনউড, হোটেল অর্কিড, হোটেল পলো টাওয়ার্স, হোটেল পেগাসাস ক্রাউন, হোটেল আলপাইন কন্টিনেন্টাল, দ্য ম্যাজেস্টিক হোটেল, আশুতোষ ইন, হোটেল ইয়ালানা প্রভৃতি। আপনার সাথে থাকা ইউএস ডলার ভাঙিয়ে ভারতীয় রুপি করার ব্যাপারে হোটেল রিসেপশনের সাহায্য চাইতে পারেন। অনেক হোটেলেই আছে তুলনামূলক কম খরচে শহরের আকর্ষণীয় স্থানগুলো দেখানোর জন্য প্যাকেজ ট্যুরের সুবিধা। শিলং শহরের ভেতর ও বাইরের সব আকর্ষণীয় স্থান ভালোভাবে দেখতে হলে আপনাকে অন্তত দু’দিন সেখানে অবস্থান করতে হবে।

Advertisement

যা দেখবেনশিলং পিক ও সোহপেতবিনেং পিক: এই দুটি উঁচু জায়গা শিলং শহর থেকে যথাক্রমে ১০ কিলোমিটার ও ২০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। শিলং পিক হচ্ছে সারা মেঘালয় রাজ্যের উচ্চতম জায়গা যা সমুদ্রপৃষ্ট থেকে ১,৯৬১ মিটার উচ্চতায় অবস্থিত। ঘন সবুজ বনানী সৌন্দর্য বাড়িয়ে একে একটি আদর্শ পর্যটন কেন্দ্রে পরিণত করেছে। পাখির চোখে গোটা শিলং শহরকে দেখতে পারবেন এখান থেকে। মন চাইবে পুরো দিনটাই এখানে কাটিয়ে দিতে। সোহপেতবিনেং পিকের উচ্চতা ১,৩৪৩ মিটার। খাসিয়া, জৈন্তিয়া, ভই প্রভৃতি সম্প্রদায়ের কাছে এটি একটি তীর্থস্থান।

ওয়ার্ডস লেক ও উমিয়াম লেক: শিলং শহরের অভ্যন্তরে অবস্থিত ওয়ার্ডস লেক একটি কৃত্রিম লেক। এটি পলক লেক নামেও পরিচিত। বিচিত্র বর্ণের সব ফুল আর পাইন গাছ ১০০ বছরের পুরনো এই লেকের প্রধান আকর্ষণ। চোখজুড়ানো উমিয়াম লেক শিলং শহর থেকে প্রায় ১৭ কিলোমিটার দূরে। এর আরেকটি নাম হচ্ছে বড়পানি লেক। নৌকা বাওয়া, নৌকা চড়া, স্কিয়িংসহ আরও অনেক সুযোগ-সুবিধা থাকায় জলক্রীড়াপ্রেমীদের জন্য এটি একটি চমৎকার স্থান।

ঝরনাসমূহ: হ্যাপি ভ্যালি এলাকায় অবস্থিত সুইট ফলস হচ্ছে মেঘালয়ের সবচেয়ে আকর্ষণীয় ঝরনাগুলোর একটি। শিলং শহর থেকে প্রায় ১৫ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত রেংথিয়াম ফলস আরেকটি ফিতাসদৃশ ঝরনা। সুনা ভ্যালিতে অবস্থিত বিশপ ও বিডেন ফলস হচ্ছে আরও দুটি নজরকাড়া ঝরনা। এলিফ্যান্ট ফলস ও স্প্রেড ঈগল ফলসও সৌন্দর্যের বিচারে পিছিয়ে নেই। তবে সবগুলো দেখার মতো সময় না থাকলে বেছে নিন এলিফ্যান্ট ফলসকেই।

পার্কসমূহ: সারা মেঘালয় রাজ্যেই ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে চমৎকার সব পার্ক। তবে সবচেয়ে বেশি পর্যটকের সমাবেশ ঘটে শিলং শহরে অবস্থিত লেডি হায়দারি পার্কেই। রাজ্যের প্রথম লেডি এবং আসামের গভর্নরের স্ত্রী হায়দারির নামেই নামকরণ হয়েছে পার্কটির। এক কিলোমিটারেরও বেশি জায়গাজুড়ে বিস্তৃত পার্কটিতে রয়েছে একটি মিনি চিড়িয়াখানা, যেখানে দেখা মিলবে ৭৩ প্রজাতির পাখি, ১৪০ প্রজাতির সরীসৃপ, ভালুক, লোপার্ডসহ আরও বন্যপ্রাণীর। এর পাশাপাশি বিপুল প্রজাতির ফুল আর আকর্ষণীয় বৃক্ষরাজি তো আছেই। মেঘালয়ের অন্যান্য উল্লেখযোগ্য পার্কগুলো হচ্ছে চেরাপুঞ্জির থাংখারাং পার্ক ও ইকো পার্ক, রি ভই জেলার নেহেরু পার্ক, খারসাতি পার্ক ও থ্রিলস ফান পার্ক এবং জৈন্তিয়া হিল জেলার লালং পার্ক ও লুকসি (কুলপি) পার্ক।

Advertisement

শিলং গলফ কোর্স: ছবির মতো সুন্দর শিলং গলফ কোর্স ভারতের মধ্যে তৃতীয় প্রাচীনতম। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের গলফ অ্যাসোসিয়েশন ও জাদুঘর একে ‘গ্লেনঈগল অব দ্য ইস্ট’ হিসেবে গণ্য করে। ১৮৮৯ সালে নয় হোলের গলফ কোর্স হিসেবে যাত্রা করলেও ১৯২৪ সালে ক্যাপ্টেন জ্যাকসন ও সি.কে. রোডস এটিকে ১৮ হোলে রূপান্তর করেন। পাইন ও রডোডেনড্রন গাছে আচ্ছাদিত এক উঁচু-নিচু উপত্যকায় অবস্থিত গলফ কোর্সটি সমুদ্রপৃষ্ট থেকে ৫,৩০০ ফুট উচ্চতায় অবস্থিত।

চেরাপুঞ্জি: চেরাপুঞ্জির অবস্থান শিলং শহর থেকে প্রায় ৬০ কিলোমিটার দূরে। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ৪,৫০০ ফুট উচ্চতায় অবস্থিত চেরাপুঞ্জি বিশ্বের সবচেয়ে আর্দ্র স্থান হিসেবে পরিচিত। এক বছরে সবচেয়ে বেশি বৃষ্টিপাতের হিসেবে চেরাপুঞ্জি ‘গিনেস বুক অব ওয়ার্ল্ড রেকর্ডসে’ অন্তর্ভুক্ত। দারুণ সব উপত্যকা ও নদী চেরাপুঞ্জির সৌন্দর্য অনেকখানি বাড়িয়ে দিয়েছে। সারা বছরই ভ্রমণ করা যায় জায়গাটিতে। শিলং থেকে কার অথবা পাবলিক বাসে করে সকালে চেরাপুঞ্জি গিয়ে আবার বিকেলে ফেরা সম্ভব। আর যদি সব আকর্ষণীয় জায়গা খুব ভালোভাবে ঘুরে দেখতে চান তাহলে একরাত থাকতে পারেন। চেরাপুঞ্জি হলিডে রিসোর্ট, কনিফেরাস রিসোর্ট, পলো অর্কিড রিসোর্ট, সোহরা প্লাজা, হালারি রেস্টুরেন্ট অ্যান্ড লজিং প্রভৃতি সদা প্রস্তুত আপনাকে উষ্ণ আতিথেয়তা দিতে।

কেভস বা গুহাসমূহ: খাসি হিলস, জৈন্তিয়া হিলস ও গারো হিলসের গুহাগুলো মেঘালয়ে যাওয়া পর্যটকদের জন্য এক বিশেষ আকর্ষণ। মৌসুমাই কেভ, ক্রেম মৌমলুহ ও ক্রেম ডেম খাসি হিলসের প্রধান প্রধান গুহা। জৈন্তিয়া হিলসের গুহাগুলো হলো ক্রেম কটসাটি ও দ্য কেভ অব ইওসিন এজ যেগুলো অন্ধকার ও ভীতিকর। বক-বাক দোবাকল, সিজু-দোবাকল ও তেরেংকল-বালওয়াকল হলো গারো হিলসের দীর্ঘতম ও দুর্গম কিছু গুহা।

সময়মার্চ থেকে অক্টোবর বিশেষ করে মার্চ-এপ্রিল ও সেপ্টেম্বর-অক্টোবর হলো মেঘালয় ভ্রমণের জন্য আদর্শ সময়।

প্রয়োজনীয় তথ্যমেঘালয়ে আপনি নিজস্ব ব্যবস্থাপনায়ও যেতে পারেন আবার সহায়তা নিতে পারেন নির্ভরযোগ্য কোনো ট্যুর অপারেটরের। দ্বিতীয়টি বেছে নিলে আপনাকে ভিসার আনুষ্ঠানিকতা, যাতায়াত ও থাকা-খাওয়া নিয়ে কোনো চিন্তা করতে হবে না। যদিও এতে খরচটা একটু বেশি পড়বে তবে আপনার ভ্রমণ হবে অনেক নিরাপদ এবং দক্ষ ট্যুরিস্ট গাইডের সঙ্গও পাবেন। তবে নিজ ব্যবস্থাপনায় গেলে একটু সতর্ক থাকতে হবে। ভালো ইংরেজি জানলে তা খুব কাজে লাগবে কারণ মেঘালয়ে এই ভাষার ব্যাপক প্রচলন রয়েছে। অবশ্য শিলং শহরে অনেক বাংলাভাষী লোকজনও পাবেন। হোটেল ও ড্রাইভার দুটির ক্ষেত্রেই বাঙালি কিংবা নেপালিদের বেছে নেওয়ার এবং খাসিয়াদের এড়িয়ে চলার চেষ্টা করুন। হোটেল রুম এবং ট্যাক্সি রিজার্ভের সময় সুনিপুণভাবে দরদাম করতে ভুলবেন না। জরুরি প্রয়োজন ছাড়া রাতে বাইরে ঘোরাঘুরি এড়িয়ে চলুন। কারণ রাতের শিলং কিন্তু দিনের মতো নিরাপদ নয়। তামাবিল সীমান্তে যাওয়ার আগেই খেয়াল করে সোনালী ব্যাংকে ভ্রমণ কর পরিশোধ করুন। ডাউকি বাজারে মানি এক্সচেঞ্জ আছে যেগুলো থেকে আপনার যাত্রাপথের খরচের জন্য প্রয়োজনীয় ভারতীয় রুপির ব্যবস্থা করতে পারবেন।

লেখক: নির্বাহী পরিচালক, গ্রীণ সিলেট ট্যুরস ও সাবেক সহ-সভাপতি, সিলেট ট্যুরিস্ট ক্লাব।

এসইউ/আরআইপি