দেশজুড়ে

পুরো ঘটনার বর্ণনা দিলেন বিউটির নানি

হবিগঞ্জের আলোচিত বিউটি হত্যা মামলা নতুন মোড় নেয়ায় হতবাক হয়েছেন এলাকাবাসী। সেইসঙ্গে বিউটির বাবার আদালতে দেয়া স্বীকারোক্তি নিয়ে এলাকায় তোলপাড় শুরু হয়েছে। সবার মুখে মুখে এখন এই আলোচনা।

Advertisement

মূলত বিউটি হত্যার পুরো ঘটনার বর্ণনা দিয়েছেন তার নানি ফাতেমা বেগম। প্রথমেই বিষয়টি তিনি অনুমান করতে পেরেছিলেন। তাই পুলিশের কাছে পুরো ঘটনা খুলে বলেন।

পুলিশকে তিনি বলেন, আমার কাছ থেকে চেয়ারম্যানের বাড়ি নিয়ে যাওয়ার জন্য বিউটিকে নিয়ে যান তার বাবা সায়েদ আলী। তার সঙ্গে ছিল ময়না মিয়া। হত্যার পরদিন আমাকে বলা হয় বিউটিকে কে নিতে এসেছে সেটি যেন কেউ না জানে। এরপর তাকে নিয়ে হত্যা করে মরদেহ হাওরে ফেলে দেয়া হয়। মূলত এ ঘটনায় তার বাবা জড়িত।

বিউটিকে ধর্ষণ ও হত্যাকাণ্ডের পর তার ছবি ফেসবুকে ভাইরাল হয়। এ নিয়ে তার এলাকাসহ দেশব্যাপী ধর্ষক বাবুলের ফাঁসির দাবি ওঠে। গ্রেফতার করা হয় এ ঘটনায় জড়িতদের।

Advertisement

কিন্তু গতকাল শনিবার আদালতে দেয়া বিউটির বাবার জবানবন্দিতে সব দৃশ্যপট বদলে যায়। কারও বিশ্বাস হচ্ছে না এমন জঘন্য কাজ করেছেন বিউটির বাবা। এলাকায় এ খবর ছড়িয়ে পড়লে হতাশ হন সবাই। যারা আগে বাবুলের ফাঁসির দাবি তুলেছেন এবার তারাই বাবুলের সঙ্গে বিউটির বাবারও ফাঁসি দাবি করেছেন।

অন্য খুনিদের সম্পৃক্ততার বিষয়ে তারা যতটা অবাক হয়েছেন, তার চেয়ে কয়েকগুণ বেশি তাদের মনকে নাড়া দিয়েছে বিউটির বাবার সম্পৃক্ততায়। বাবা কি করে নিজের মেয়েকে খুনিদের হাতে তুলে দিতে পারেন, কি করেই বা তাকে খুনের দৃশ্য দাঁড়িয়ে দেখে সহ্য করতে পারেন? একবারও কি মেয়ের চিৎকার বাবার হৃদয়ে নাড়া দেয়নি? এমন অসংখ্য প্রশ্নই এখন তার প্রতিবেশীসহ স্থানীয়দের মাঝে ঘোরপাক খাচ্ছে।

ইউপি চেয়ারম্যান আদিল হোসেন জজ মিয়া বলেন, এ ঘটনায় আমরা পুরো ইউনিয়নবাসী লজ্জিত, মর্মাহত। একজন সন্তান তার মা-বাবার কাছে নিরাপদ না, বিষয়টি আমাদের অবাক করেছে। হত্যাকারীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চাই।

স্থানীয়রা বলছেন, শায়েস্তাগঞ্জ উপজেলার নবগঠিত ব্রাহ্মণডোরা ইউনিয়নে কখনও এ ঘটনা ঘটেনি। পূর্বে নূরপুর ইউনিয়ন থাকতেও এমন কোনো ঘটনা ঘটেনি। এটি তাদের এলাকার জন্য একটি লজ্জাজনক ঘটনা।

Advertisement

সবচেয়ে অবাক করার মতো বিষয় হচ্ছে, যে বাবা মেয়েকে খুনিদের হাতে এনে তুলে দেয়, আবার পাশে দাঁড়িয়ে মেয়েকে খুনের দৃশ্য দেখতে পারে তার চেয়ে বড় পাপী আর কে হতে পারে। হয়তো সামান্য স্বার্থ ছিল। কিন্ত কি এমন স্বার্থ ছিল যার জন্য মেয়েকে খুন করে ফেলতে পারে। সে বাবা নামের কলঙ্ক। তার বেঁচে থাকার দরকার নেই। তার এখন সবার সামনেই বিচার হওয়া উচিত। আর যে ময়নাকে জন্মের পর থেকেই চাচা বলে ডেকে আসছে বিউটিকে মারতে কি একটুও হাত কাঁপেনি তার? একবারও কি সে চিন্তা করেনি বিউটি কি, আর তার নিজের মেয়ে কি? এসব জানোয়ারদের জনমক্ষে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেয়া প্রয়োজন। যা দেখে অন্য কেউ এমন অপরাধে জড়ানোর সাহস না পায়। অসহায় মেয়েটিকে হত্যার সঙ্গে অন্য যারা জড়িত তাদের সবার মৃত্যুদণ্ড চান এলাকাবাসী।

গত ১৬ মার্চ রাতে লাখাই উপজেলা গুনিপুর গ্রামে নানার বাড়ি থেকে নিখোঁজ হয় শায়েস্তাগঞ্জ উপজেলার ব্রাহ্মণডোরা গ্রামের সায়েদ আলীর মেয়ে বিউটি আক্তার।

১৭ মার্চ হাওর থেকে তার ক্ষতবিক্ষত মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ। এ হত্যার সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগ ওঠে বিউটির কথিত প্রেমিক বাবুল মিয়ার বিরুদ্ধে। বিষয়টি ফেসবুকে ভাইরাল হয়। দেশ-বিদেশে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করে।

১৮ মার্চ বিউটির বাবা সায়েদ আলী বাদী হয়ে বাবুল মিয়া ও তার মা কলম চান বিবির বিরুদ্ধে শায়েস্তাগঞ্জ থানায় মামলা করেন। গ্রেফতার হয় বাবুল ও তার মা কলম চান বিবিসহ তিনজন।

হত্যাকাণ্ডের পর থেকেই আনমনা হয়ে থাকতেন বিউটির বাবা মামলার বাদী সায়েদ আলী। মেয়ে হারানোর ছাপ তার চেহারায় ছিল না। পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদেও তিনি অস্বাভাবিক আচরণ করেন।

একই আচরণ করেন তার আত্মীয় সম্পর্কের ভাই ময়না মিয়াও। এতেই পুলিশের মনে সন্দেহের সৃষ্টি হয়। তারা খোঁজেন বিউটির নিখোঁজ হওয়ার স্থান তার নানার বাড়ি। তার নানি ফাতেমা বেগমকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ডাকে পুলিশ।

তিনি শুরুতেই সব বলে দেন। তার কাছ থেকে চেয়ারম্যানের বাড়ি নিয়ে যাওয়ার জন্য বিউটিকে নিয়ে যান বাবা সায়েদ আলী। তার সঙ্গে ছিল ময়না মিয়া। হত্যার পরদিন তাকে বলা হয় কে বিউটিকে নিয়ে এসেছে সেটি যেন কেউ না জানে।

এসব শোনার পর অবাক হয় পুলিশও। চমকে ওঠে সবাই। তার সামনে এনে হাজির করা হয় ময়না মিয়াকে। ফাতেমা বেগমকে দেখে অবাক হয়। এ সময় উভয়কে সামনা-সামনি জিজ্ঞাসাবাদ করা হলে ময়না সব স্বীকার করে নেয়। নিয়ে আসা হয় বিউটির বাবা সায়েদ মিয়াকেও। তিনি শাশুড়িকে দেখে চমকে উঠলেও প্রথমে অস্বীকার করে। পরে স্বীকার করে।

একপর্যায়ে সব স্বীকার করে মেয়ে হত্যার জন্য অনুতপ্ত হয়। একে একে সায়েদ আলী ও ময়না মিয়া আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়ে হত্যাকাণ্ডের রোমহর্ষক বর্ণনা দেয়।

হত্যাকাণ্ডে সরাসরি অংশ নেয় দুইজন। ময়না মিয়া ছুরি চালায় এবং পলাতক খুনি বিউটিকে ধরে রাখে। তাকে গ্রেফতারে মরিয়া পুলিশ। খুব দ্রুত তাকে গ্রেফতার করা সম্ভব হবে বলে জানায় পুলিশ।

সৈয়দ এখলাছুর রহমান খোকন/এএম/আরআইপি