কলকাতার ঠাকুরপুকুরের লোহারপুলের ৩৪ বছর বয়সী দেবরাজ মণ্ডল। শরীরচর্চাই ছিল তার কাছে সাধনা। পরিশ্রমের ফলও পেয়েছিলেন এ তরুণ। ২০১৩ থেকে ২০১৬ টানা চার বছর ‘মিস্টার ইন্ডিয়া’ সরকারি খেতাবও জেতেন তিনি।
Advertisement
সেই দেবরাজই এখন আয়নার সামনে দাঁড়াতে ভয় পান। কারণ তার সেই বডি এখন ভেঙে তছনছ। যে শরীর দেবরাজের গর্ব ছিল, সেটাই আজ তার প্রাণ সংশয়ের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রচণ্ড অনিশ্চয়তায় দিন কাটছে ভারত কাঁপানো এ বডিবিল্ডারের।
২০০৫ সালে জিমে যাওয়া শুরু করেন দেবরাজ। কিছুদিনের মধ্যে তা নেশায় পরিণত হয়। শরীরচর্চা করতে করতেই কলকাতায় বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় অংশ নেয়া শুরু করেন। কলকাতায় ফল ভাল হওয়ার পরে জেলাস্তরের প্রতিযোগিতাতেও নজর কাড়েন তিনি। তবে শুধু কলকাতায় নয়, জাতীয় স্তরেও বডিবিল্ডিং প্রতিযোগিতায় সাফল্য অর্জন করেন দেবরাজ মণ্ডল।
২০১৩ সালে ৬০ কেজি বিভাগে প্রথম হন দেবরাজ। তারপর ২০১৪, ২০১৫ এবং ২০১৬ সালেও ৬০ কেজি বিভাগে ভারতের কেন্দ্রীয় ক্রীড়া ও যুবকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের অধীনে ‘মিস্টার ইন্ডিয়া’ খেতাব পান তিনি।
Advertisement
সবকিছু ঠিকঠাকই এগোচ্ছিল। কিন্তু সমস্যার সূত্রপাত ২০১৬ সালে। চেন্নাই থেকে ফেরার পর দেবরাজের পা অতিরিক্ত ফোলা রয়েছে বলে লক্ষ্য করেন তার পরিবারের সদস্যরা। পাশাপাশি তার প্রস্রাব ও খাওয়া-দাওয়ার সময়ও বিভিন্ন সমস্যা দেখা যায়।
তখন বাড়ির কাছেই এক চিকিৎসকের কাছে দেবরাজকে নিয়ে যান পরিবারের সদস্যরা। উন্নতি না হওয়ায় দেবরাজকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানেই চিকিৎসকেরা জানান, দেবরাজের দুটি কিডনিই ৯০ শতাংশ বিকল হয়েছে। পাশাপাশি সমস্যা রয়েছে তার ফুসফুসেও। কিডনি প্রতিস্থাপন করতে অন্তত ১০ লাখ টাকা লাগবে বলে জানান চিকিৎসকরা।
দেবরাজের পরিবার আর্থিকভাবে স্বচ্ছল নয়। বাড়িতে একটি মুদি দোকান রয়েছে। সুস্থ অবস্থায় একটি জিম সেন্টার খুলেছিলেন দেবরাজ। কিন্তু তিনিই অসুস্থ হয়ে পড়ায় সেটিও এখন প্রায় বন্ধ হওয়ার মুখে।
দেবরাজের বোন একটি কিডনি দান করতে রাজি হয়েছেন। কিন্তু কিডনি প্রতিস্থাপনের বিপুল খরচ জোগাড় করা দেবরাজের পরিবারের পক্ষে অসম্ভব। বর্তমানে ঠাকুরপুকুরের একটি নার্সিংহোমে তার ডায়ালাইসিস চলছে।
Advertisement
তবে এ অবস্থায় দেবরাজকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন এলাকার বাসিন্দারা ও স্থানীয় একটি ক্লাব।
কেন এমন অবস্থা হল ৩৪ বছরের এই তরুণের? দেবরাজের পরিবারের সদস্যরা বলছেন, পেশিবহুল চেহারা পেতে প্রায়ই অনিয়ন্ত্রিত পরিমাণে সাপ্লিমেন্টারি প্রোটিন নিতেন দেবরাজ। শরীরে প্রোটিনের পরিমাণ মাত্রাতিরিক্ত হওয়ার কারণেই মূলত সমস্যার সূত্রপাত।
পেশাদারি বডি বিল্ডিং না করলেও তরুণ প্রজন্মের অনেকেই এখন আকর্ষণীয় চেহারা পেতে জিমে যান। কোনও বিশেষজ্ঞের পরামর্শ ছাড়াই অনিয়ন্ত্রিত পরিমাণে সাপ্লিমেন্টারি ফুডও গ্রহণ করেন অনেকে। কিন্তু তার পরিণতি যে কতটা মারাত্মক হতে পারে, তার জ্বলজ্যান্ত উদাহরণ দেবরাজ।
ভারতের বিশিষ্ট স্পোর্টস মেডিসিন বিশেষজ্ঞ পুষ্পকেতু কোনার বলেন, বডি বিল্ডিংয়ের অনেকগুলো বিষয় আছে। খেলার ধরনের ওপরে শরীরের শক্তি, গঠন নির্ভর করে। শুধুমাত্র প্রোটিন সাপ্লিমেন্ট খেলেই যে পেশিবহুল চেহারা হবে, এমনটা নয়। প্রোটিন সাপ্লিমেন্ট ব্যবহার করলে শরীরের গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গে কোনও কুপ্রভাব পড়বে কি না, তা আগেই দেখা দরকার।
পুষ্পকেতু কোনারের পরামর্শ, ‘প্রথমে শরীরের বায়ো-কেমিস্ট্রি পরীক্ষা এবং তার পরে মাসল অ্যানালাইসিস করা প্রয়োজন। এছাড়াও মাংসপেশি, হৃৎপিণ্ড, পাকস্থলী এবং কিডনির পরীক্ষা করা উচিত।’
তিনি আরো বলেন, অতিরিক্ত প্রোটিন সাপ্লিমেন্ট গ্রহণ করার পর শরীর থেকে ঘন ঘন তা বেরিয়ে গেলে কিডনির উপরে চাপ পড়ে। দেবরাজের দাবি, ‘তিনি প্রচুর পরিমাণে মাংস ও ডিম খেতেন। একটু হাঁটলেই এখন আমি হাঁপিয়ে যাই। চিকিৎসার এত টাকা কোথা থেকে আসবে, এই অবস্থা থেকে কীভাবে বেরিয়ে আসব, তা মাথায় ঢুকছে না।’
জাতীয় স্তরে একাধিক সম্মাননা জয়ী দেবরাজ, রাজ্য সরকারের কাছ থেকে এখনও পর্যন্ত কোনো আর্থিক সহায়তা পাননি বলে দেশটির একটি বাংলা দৈনিককে জানিয়েছেন। আপাতত সেই আশাতেই দিন কাটছে তার।
এসআইএস/আরআইপি