জুনিয়র স্কুল সার্টিফিকেট (জেএসসি) ও সমমান পরীক্ষার ফলাফলে অসন্তোষ লক্ষাধিক পরীক্ষার্থী। যার কারণে এবার বিভিন্ন বিষয়ের খাতা পুনঃনিরীক্ষার আবেদন জমা পড়েছে সবচেয়ে বেশি। পুনঃনিরীক্ষণে ঢাকা শিক্ষাবোর্ডের পরীক্ষার্থীরা বেশি আবেদন করেছে। বিষয়ভিত্তিক আবেদনের র্শীষে রয়েছে গণিত ও ইংরেজি। বিষয়ভিত্তিক ৭৮ বা ৭৯ নম্বর পেয়েও কয়েজ হাজার পরীক্ষার্থী আবেদন করেছে। বিভিন্ন শিক্ষাবোর্ড সূত্রে এমন তথ্যই জানা গেছে।
Advertisement
অভিভাবক ও পরীক্ষার্থীদের ধারণা পুনঃনিরীক্ষণে এক বা দুই নম্বর বাড়লেই ফেল থেকে পাস করবেন। আবার অনেকে জিপিএ-৫ বা সব বিষয়ে জিপিএ-৫ পাবেন। তবে বোর্ড কর্মকর্তাদের দাবি সব বিষয়ে নম্বর দেখার সুযোগ করে দেয়ার কারণেই আবেদনের সংখ্যা বেড়েছে। তবে বিষয় প্রতি পরীক্ষার্থীদের ১২৫ টাকা করে ফি দিতে হয়েছে। এতে বোর্ডগুলোর অন্তত সোয়া দুই কোটি টাকা বাড়তি আয় হয়েছে।
সূত্র জানায়, জেএসসি ও সমমান পরীক্ষার ফল পুনরায় মূল্যায়নে ঢাকা বোর্ডে ৩৭ হাজার পরীক্ষার্থীর ৭৮ হাজার ৪০০ আবেদন জমা পড়েছে। আবেদনের শীর্ষে রয়েছে গণিত ও ইংরেজি বিষয়। কুমিল্লা বোর্ডে ১২ হাজার ১৮৮ পরীক্ষার্থী ২৪ হাজার ৪০৪টি আবেদন করেছে। এর মধ্যে ইংরেজিতে ছয় হাজার ১৩৩টি ও গণিতে তিন হাজার ১৮৩টি। রাজশাহী বোর্ডে ৪ হাজার ৫৬৩ পরীক্ষার্থী ৮ হাজার ৯০২টি আবেদন করেছে। এ বোর্ডে ইংরেজিতে এক হাজার ৬৫৯টি আবেদন জমা পড়েছে। যশোর বোর্ডে ৯ হাজার ৪০৮ পরীক্ষার্থী ১৬ হাজার ৩৭০টিতে আবেদন করেছে। এর মধ্যে গণিতে তিন হাজার ৪৩৬টি আবেদন। চট্টগ্রাম বোর্ডে ১০ হাজার ৫৩১ পরীক্ষার্থী ২০ হাজার ৫২১টিতে আবেদন করেছে। এ বোর্ডেও গণিতে সর্বোচ্চ আবেদন। এ সংখ্যা চার হাজার ৫৫টি। সিলেট বোর্ডে তিন হাজার ২৪৭ পরীক্ষার্থী ছয় হাজার ৪৭৬টি আবেদন করেছে। এর মধ্যে গণিতে এক হাজার ১৯০টি আবেদন। দিনাজপুর বোর্ডে ছয় হাজার ৭৩৮ জন পরীক্ষার্থী ১২ হাজার ২৭৪টিতে আবেদন করেছে। সব মিলিয়ে চ্যালেঞ্জ করা শিক্ষার্থীর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১ লাখ তিন হাজার ৭০৫ জনে।
অন্যান্য বোর্ডে গণিত ও ইংরেজিতে আবেদনের সংখ্যা বেশি হলেও দিনাজপুর বোর্ডে ঘটেছে উল্টো। এ বোর্ডে সমাজ বিজ্ঞান বিষয়ে সর্বোচ্চ আবেদন। এ সংখ্যা দুই হাজার ২৬৪টি। বরিশাল বোর্ডে ছয় হাজার ২১৪ জন আবদেন করেছে। এ বোর্ডে আবেদনের শীর্ষে গণিত।
Advertisement
মাদরাসা বোর্ডের অধীন জেডিসিতে ১৩ হাজার ৮২০ পরীক্ষার্থী আবেদন করেছে। এ বোর্ডে গণিত ও আরবি বিষয়ে আবেদনের সংখ্যা বেশি। বরিশাল ও মাদরাসা বোর্ডে বিষয়ভিত্তিক আবেদনের সংখ্যা জানা যায়নি। তবে অন্য বোর্ডগুলোতে সব মিলিয়ে এক লাখ ৬৭ হাজার ৩৪৭টি আবেদন জমা হয়েছে।
ঢাকা শিক্ষাবোর্ডের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক তপুন কুমার সরকার জাগো নিউজকে বলেন, যারা প্রত্যাশা অনুযায়ী জিপিএ-৫ পায়নি বা ফেল করেছে তারাই আবেদন করেছে। বিগত বছরের তুলনায় ঢাকা বোর্ডে আবেদনের সংখ্যা বেশি নয়।
তিনি আরও বলেন, প্রথা অনুযায়ী ফল প্রকাশের ৩০ দিনের মধ্যে পুনঃনিরীক্ষণের ফলাফল প্রকাশিত হয়। সে অনুযায়ী আগামী ২৯ জানুয়ারির মধ্যে পুনঃনিরীক্ষণের ফলাফল প্রকাশ করা হবে।
বিভিন্ন শিক্ষাবোর্ডের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রকরা জানান, পুনঃনিরীক্ষণে সাধারণত চারটি বিষয় দেখা হয়। এগুলো হলো- উত্তরপত্রে সব প্রশ্নের সঠিকভাবে নম্বর দেয়া হয়েছে কি-না, প্রাপ্ত নম্বর গণনা ঠিক হয়েছে কি-না, প্রাপ্ত নম্বর ওএমআর শিটে উঠানো হয়েছে কি-না এবং প্রাপ্ত নম্বর অনুযায়ী ওএমআর শিটে বৃত্ত ভরাট সঠিকভাবে করা হয়েছে কি-না। এসব বিষয় পরীক্ষা করেই পুনঃনিরীক্ষার ফল দেয়া হয়।
Advertisement
বোর্ড কর্মকর্তারা বলেন, কোনো শিক্ষার্থীর উত্তরপত্র পুনরায় মূল্যায়ন হয় না। পুনঃনিরীক্ষণে যেসব ফল পরিবর্তন হয় তা মূলত; পরীক্ষকদের ভুলের কারণে। দেখা গেছে, একজন পরীক্ষার্থী ৮২ নম্বর পেয়েছে সেটাকে পরীক্ষক ওএমআর শিটে ২৮ পূরণ করেছে। ফলে শিক্ষার্থী ফেল করে।
তবে পরীক্ষক ও প্রধানপরীক্ষকদের অনেক উদাসীনতা রয়েছে। অনেক পরীক্ষক রয়েছে নিজেরা উত্তরপত্র মূল্যায়ন না করে অন্যদের দিয়ে মূল্যায়ন করান। ২০১৬ সালের এসএসসি পরীক্ষায় বরিশাল শিক্ষাবোর্ডের দুই প্রধান পরীক্ষকের ভুলের কারণে হিন্দু ধর্ম ও নৈতিক শিক্ষা বিষয়ে এক হাজার ১৪১ জন ফেল করে। নৈর্ব্যক্তিক উত্তরপত্র মূল্যায়নের সময় দুই প্রধান পরীক্ষক ‘খ’ ও ‘গ’ সেট গুলিয়ে ফেলেন। তারা ‘খ’ সেট প্রশ্নের মূল্যায়ন করেন ‘গ’ সেটের উত্তরপত্রের মাধ্যমে আর ‘গ’ সেটের মূল্যায়ন করেন ‘খ’ সেটের উত্তরপত্রের মাধ্যমে। ফলে ‘খ’ সেটে যারা পরীক্ষা দিয়েছিলেন তাদের উত্তরের সঙ্গে প্রধান পরীক্ষকের ভুল উত্তরমালার সমন্বয় হয়নি। যার খেসারত দিতে হয় পরীক্ষার্থীদের।
কুমিল্লা শিক্ষাবোর্ডের চেয়ারম্যান অধ্যাপক আব্দুল খালেক বলেন, অন্য বোর্ডের তুলনায় আমাদের বোর্ডে জেএসসি পরীক্ষায় পাসের হার কম ছিল। ইংরেজি ও গণিত বিষয়ে শিক্ষার্থী ফেল করেছে বেশি। অভিভাবকরা ভাবছেন আবেদন করলে হয়তো ফল পরিবর্তন হবে। আসলে বিষয়টি তা নয়। পুনঃনিরীক্ষণে নতুন করে নম্বর দেয়া হয় না। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, অনেক শিক্ষার্থীরা ৭৯ নম্বর পেয়েছে সত্য। তাদের ৮০ নম্বর দেয়ার সুযোগ নেই পরীক্ষকদের।
চট্টগ্রাম শিক্ষাবোর্ডের চেয়ারম্যান অধ্যাপক শাহেদা ইসলাম বলেন, আমাদের বোর্ডে এবার গণিতের প্রশ্ন একটু কঠিন ছিল। সেজন্য গণিতে ফেলের সংখ্যাও বেশি। এ বিষয়ে ফেল করা শিক্ষার্থীদের আবেদনের সংখ্যাও বেশি। পরীক্ষকদের কোনো অবহেলা ছিল কি-না জানতে চাইলে বিষয়টি অস্বীকার করে তিনি বলেন, একজন পরীক্ষার্থী ভাবতেই পারেন তার আরও বেশি নম্বর পাওয়া উচিত ছিল। তবে শিক্ষার্থী যা ভাবে তার চেয়ে অভিভাবকরা বেশি ভাবেন। আদালতের আদেশের ফলে এখন প্রাপ্ত নম্বর দেখা যায়।
তারা ভাবেন, আবেদন করলে হয়তো নম্বর বেড়ে জিপিএ পরিবর্তন হবে। এ কারণেই আবেদনের সংখ্যা বাড়ছে। গত বছর ২০ হাজার আবেদন করলেও মাত্র ২২৬ জনের ফল পরিবর্তন হয়েছিল। এ সংখ্যা খুবই কম বলে তিনি মন্তব্য করেন।
প্রসঙ্গত, গত ৩০ ডিসেম্বর জেএসসি ও জেডিসির ফলাফল প্রকাশিত হয়। উভয় পরীক্ষার ফলাফলের সবগুলো সূচকেই গতবারের তুলনায় খারাপ হয়েছে। দুই পরীক্ষায় ২৪ লাখ ৮২ হাজার ৩৪২ জন ছাত্র-ছাত্রী অংশ নেয়। গড় পাসের হার ৮৩ দশমিক ৬৫ ভাগ। গত বছর ছিল ৯৩ দশমিক শূন্য ছয় ভাগ। কমেছে ৯ দশমিক ৪১ ভাগ।
এমএইচএম/জেএইচ/আইআই