বিশেষ প্রতিবেদন

অপরিকল্পিত উন্নয়নের খপ্পরে দেশ

ড. সামছুল হক। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) পুরকৌশল বিভাগে অধ্যাপনা করছেন। যুক্তরাজ্যের সাউদাম্পটন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পরিবহন বিষয়ে পিএইচডি ডিগ্রিধারী ড. সামছুল ঢাকা মাস ট্রানজিট কোম্পানি লিমিডেটের পরিচালক হিসেবেও দায়িত্ব পালন করছেন। পরিবহন, যানজট, উন্নয়ন ও পরিকল্পনা নিয়ে সম্প্রতি মুখোমুখি হন জাগো নিউজ’র। তিন পর্বের সাক্ষাৎকারের দ্বিতীয়টি আজ প্রকাশিত হলো।

Advertisement

সাক্ষাৎকার নিয়েছেন জাগো নিউজ’র জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক সায়েম সাবু।

জাগো নিউজ : আগের পর্বে রাজধানীর যানজট নিয়ে নানা হতাশার কথা বলছিলেন। এ থেকে মুক্তির উপায় কী?

সামছুল হক : কয়েক বছর আগে প্রধানমন্ত্রী (শেখ হাসিনা) জাপান যাওয়ার আগে এক জাপানি বিশেষজ্ঞ বাংলাদেশে এসেছিলেন। তিনি আমার সঙ্গে রুদ্ধদ্বার বৈঠকে বসেছিলেন। তার ব্যাপারে জাইকা আগেই আমাকে অবহিত করেছিল। তিনি আমাকে বললেন, ‘প্রফেসর, আমি একটি বিষয় নিয়ে তোমার সঙ্গে আলোচনা করতে চাই। তুমি ঢাকা নিয়ে কী ভাবছ?’ আমি বললাম, ‘ঢাকার মৃত্যু ঘটেছে। মরে যাওয়ার এক সেকেন্ড পর গাছে পানি দিয়ে আর বাঁচানো যায় না। ঢাকা এখন সেই পর্যায়ে। শক্তিশালী ইনজেকশন দিয়ে আইসিইউতে রেখে জীবন কিছুদিন বাঁচিয়ে রাখা যেতে পারে, কিন্তু বসবাসের নগরীতে ঢাকাকে ফিরে আনার আর কোনো সুযোগ আছে বলে মনে করি না।’

Advertisement

তিনি আমার সঙ্গে হাত মিলিয়ে বললেন, ‘প্রফেসর, আমার গবেষণাও তাই বলে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যখন জাপান যাবেন আমি তাকে একটি প্রস্তাব দেব।’ আমি বললাম, ‘কী প্রস্তাব?’ তিনি বললেন, ‘রাজধানী সরিয়ে নেয়ার প্রস্তাব।’

জাগো নিউজ : আপনি কী বললেন?

সামছুল হক : আমি বললাম, ‘এ ভাবনা আমাদেরও গবেষণার ফসল। রাজধানী সরিয়ে নেয়ার জন্য বড় পরিকল্পনা এবং সময় নিতে হয়। সেই হিসেবে বড় একটি জায়গা নির্ধারণ করতে হবে।’ তিনি বললেন, ‘আমি প্রধানমন্ত্রীকে সুনির্দিষ্টভাবে প্রস্তাব দিচ্ছি।’ আমি বললাম, ‘দুঃখিত। আপনি সেই সুযোগটিও পাচ্ছেন না।’

জাগো নিউজ : আপনার এমন ধারণা কেন?

Advertisement

সামছুল হক : রাজধানীর জন্য এমন জায়গা নির্ধারণ করতে হবে যেটা প্রাকৃতিকভাবে উঁচু, বন্যামুক্ত। দ্বিতীয়ত, মাটি ভরাট করতে হবে না- এমন জায়গা নিতে হবে। ঢাকায় এখন জলাশয় ভরাট ছাড়া আর কোনো জায়গা পাবেন না। বসুন্ধরা সিটিতে জায়গা কিনে আপনি খুশি হতে পারেন কিন্তু বাড়ি নির্মাণ করতে গিয়ে আপনার সেই খুশি আর থাকবে না। মাটির নিচে অধিক টাকা আগে বিনিয়োগ করতে হবে। রাজধানী শহরের উন্নয়নে বড় একটি অংশ মাটির নিচে চলে গেলে তাকে অর্থনীতিবান্ধব কোনো শহর বলা যায় না।

সামান্য বৃষ্টিতেই ঢাকার রাস্তাঘাট ডুবে যাচ্ছে। হাজার হাজার কোটি টাকা ব্যয় করে পানি নিষ্কাশন করা হচ্ছে। রাজধানী হতে হবে স্টেডিয়ামের মতো। সবাই যেন সমান দূরত্ব অনুভব করে। আমি বুয়েট থেকে বাংলাদেশ ব্যাংকে যাব, আর উত্তরা থেকে আরেকজন বাংলাদেশ ব্যাংকে আসবে, তা কখনও সমান হতে পারে না। সব প্রশাসনিক কার্যালয়, অফিস হবে দক্ষিণে আর সব আবাসিক এলাকা হবে উত্তরে- এমনটি কোনো নগরের বৈশিষ্ট্য হতে পারে না।

জাগো নিউজ : রাজধানী সরানোর ব্যাপারে কী বললেন?

সামছুল হক : বাংলাদেশ হচ্ছে ব-দ্বীপ। যাকে প্লাবনভূমি বলা যতে পারে। বাংলাদেশের অধিকাংশ ভূমিই প্লাবিত হয়। আমি তাকে বললাম, ‘রাজধানী সরানোর উপযোগী একমাত্র জায়গা ছিল সাভার, পূর্বাচল ও ভাওয়ালের গড় এলাকা। কারণ সেখানে লালমাটি আছে। টিলা আছে। কিন্তু সেই জায়গাও আবাসিকতার জন্য দখল হয়ে গেছে।’

মাহাথির মোহাম্মদ পুত্রজায়ায় রাজধানী করেছেন সাত হাজার একর জমির ওপর। আর আমাদের পূর্বাচলের জমির পরিমাণ ছিল সাড়ে ছয় হাজার একর। পূর্বাচলেই রাজধানী হতো। শুধু পরিকল্পনার দরকার ছিল। কিন্তু তা না করে গুটিকয়েক মানুষকে কোটিপতি বানিয়ে দেয়া হলো। এক মহা তুঘলকি কারবার।

জাগো নিউজ : এজন্য কোনটিকে দায়ী করা যেতে পারে?

সামছুল হক : রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) কাজ হচ্ছে রাজধানীর উন্নয়ন। কিন্ত প্রতিষ্ঠানটি এখন ব্যক্তির উন্নয়নে কাজ করছে। প্রতিষ্ঠানগুলোর দায়ের পরিবর্তে ব্যবহারে রূপ নিচ্ছে। সরকারগুলো এসে পরিকল্পনা ছাড়াই চাপিয়ে দিয়ে কাজ করিয়ে নিচ্ছে।

জাগো নিউজ : তাহলে এজন্য প্রধানত রাজনীতিকেই দায়ী করতে হয়?

সামছুল হক : অবশ্যই। পলিসি তো একটি রাজনৈতিক সরকারই নিয়ে থাকে। রাজনীতি আর ব্যুরোক্রেসিই আজকের এ পরস্থিতির জন্য দায়ী বলে মনে করি। রাজউকের চেয়ারম্যান হওয়ার কথা প্ল্যানিং ডিপার্টমেন্ট থেকে। আজ পর্যন্ত কোনো পরিকল্পনাবিদ এ প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান পদে নিয়োগ পাননি। প্রেষণে পাঠানো লোক দিয়ে রাজউকের মতো প্রতিষ্ঠান চলছে। পরিকল্পনার জন্য ধ্যান লাগে, জ্ঞান লাগে। রাজধানী সরালে ৫০ বছর পর কী রূপ নিতে পারে তার জন্য ধ্যান করতে হয়।

এখানে দায়িত্ব নিয়েই উন্নয়নের কাছে যেতে থাকেন পরিকল্পনাকারীরা। তাকে আলাদা অর্থের উৎস খুঁজতে হয়। কারণ তার সুযোগ-সুবিধা আর দশজনের মতো রাখলে চলে না। তাকে আলাদা করে মূল্যায়ন করতে হয়। অর্থের পেছনে ছুটলে পরিকল্পনা শূন্যের কোঠায় পৌঁছায়। পরিকল্পনাবিদ স্বাধীনভাবে কাজ করবেন। তার কাজে অন্য কেউ প্রভাব ফেলবেন না। এখন পরিকল্পনাকারী যদি প্রেষণে আসা কোনো ব্যক্তি হয়ে থাকেন, তিনি তো নিজের প্লট বরাদ্দ নিয়েই ব্যস্ত থাকবেন। দু’বছরের জন্য এসে নিজের আখের গুছিয়ে চলে যাচ্ছেন।

সরকারের অযাচিত হস্তক্ষেপ এবং প্রতিষ্ঠানগুলোর অক্ষমতার কারণেই এমন হচ্ছে। ‘রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ’ নামেই গলদ রয়েছে। বলা হয়েছে তুমি রাজধানীর উন্নয়ন করবা, কিন্তু তোমাকে অর্থ দেয়া হবে না। কারণ তুমি নিজেই কর্তৃপক্ষ। নিজের বাজেট নিজেকেই করতে হবে। ফলে এখানকার চেয়ারম্যানকে সারাক্ষণ টাকার পেছনে দৌঁড়াতে হয়। ভূমির উন্নয়ন করলে টাকা আসবে, এ চিন্তায় তাকে কাজ করতে হয়। সড়ক বিভাগ, এলজিইডিকে হাজার হাজার কোটি টাকা দেয়া হচ্ছে; অথচ রাজউককে বলা হচ্ছে, তোমার টাকায় উন্নয়ন করো।

এ বৈপরীত্য থাকলে কোনোদিন উন্নয়ন হবে না। উন্নয়ন হতে পারে কিন্তু গুণগত কোনো পরিবর্তন আসবে না। এক বছরের ব্যবধানে একতলা ভবন দশতলা হচ্ছে। পুরো একটি গ্রামের লোক একটি ফ্ল্যাটে বাস করছে। কিন্তু পাকিস্তান আমলে যে রাস্তা সেটাই আছে। বরং অনেক ক্ষেত্রে কমেছে। মূলত অপরিকল্পিত উন্নয়নের খপ্পরে পড়েছে দেশ।

জাগো নিউজ : বাজেট না থাকার কারণ কী?

সামছুল হক : এর দায় সরকার এবং সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের। রেল তো ধীরে ধীরে স্থিমিত হয়ে গেল। সড়ককে অর্থ দেয় সরকার আর রেলকে বলে তোমাকে আয় করতে হবে। সড়ককে হাজার হাজার কোটি টাকা দিয়ে কোনো আয়ের হিসাব দেখে না সরকার; অথচ রেলকে বলছে, তুমি লোকসান করছ। কেন রেলকে লাভ করতে হবে? এ কারণেই আমি মনে করি, আমাদের প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্ম এবং অর্পিত দায়িত্বের মধ্যে সাংঘাতিক রকম বৈপরীত্য আছে। জনবহুল এ দেশে সড়ক যে পরিমাণ জমি নেয়, রেল কিন্তু সেই পরিমাণ জমি নেয় না। সরকারের কৌশল তো এখানেই। বহুমাত্রিক যোগাযোগ ব্যবস্থার মাধ্যমে সরকার কৌশল নিয়ে থাকবে। কারণ শুধু সড়কের উন্নয়ন করে যোগাযোগ নিশ্চিত করা যাবে না। রেলকে জনপ্রিয় করলে জমি যাবে না, অধিক জ্বালানি যাবে না, ভর্তুকি যাবে না। এগুলো হচ্ছে সিদ্ধান্ত নেয়ার ব্যাপার।

এএসএস/এসআর/এমএআর/বিএ