বাংলাদেশ শ্রমিক কল্যাণ ফাউন্ডেশন আইন কার্যকর ঘোষণা করা হয়েছে ২০০৬ সালের ১ অক্টোবর থেকে। কিন্তু আইন অনুযায়ী ফাউন্ডেশনের তহবিলে লভ্যাংশ দিচ্ছে না বেশিরভাগ প্রতিষ্ঠান। দেশে হাজারো লাভজনক শিল্প প্রতিষ্ঠান থাকলেও এখন পর্যন্ত মাত্র ৮৬টি প্রতিষ্ঠান শ্রমিক কল্যাণ ফাউন্ডেশন তহবিল লভ্যাংশ জমা দিয়েছে।
Advertisement
আইন অনুযায়ী যেসব প্রতিষ্ঠান লভ্যাংশ দিচ্ছে না তাদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নিতে শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের কোনো উদ্যোগ নেই।
আইন অনুযায়ী, শিল্প প্রতিষ্ঠানের এক বছরের লভ্যাংশের শূন্য দশমিক পাঁচ (আধা) শতাংশ শ্রমিক কল্যাণ ফাউন্ডেশনের তহবিলে বাধ্যতামূলকভাবে দিতে হবে। এক বছরের লভ্যাংশের পাঁচ শতাংশের মধ্যে চার শতাংশ অর্থ নিজ প্রতিষ্ঠানের শ্রমিকদের কল্যাণে ব্যয় করতে হয়। বাকি এক শতাংশের অর্ধেক প্রতিষ্ঠানের নিজস্ব শ্রমিক কল্যাণ তহবিলে বাকি অর্ধেক শ্রম মন্ত্রণালয়ের অধীনস্ত শ্রমিক কল্যাণ ফাউন্ডেশনের তহবিলে জমা দিতে হয়।
তবে পোশাক কারখানাগুলোকে এ তহবিলের বাইরে রাখা হয়েছে। শ্রম আইনের অধীনে করা বিধিমালায় পোশাক কারখানাগুলোর জন্য আলাদা বিধান রাখা হয়েছে।
Advertisement
শ্রমিক কল্যাণ ফাউন্ডেশন আইন অনুযায়ী, প্রতিষ্ঠানের লভ্যাংশ ঘোষণার ৯০ দিনের মধ্যে নির্ধারিত লভ্যাংশ জমা দিতে হয়। কোনো কোম্পানির অংশগ্রহণ তহবিল ও কল্যাণ তহবিল পরিচালনায় গঠিত ট্রাস্টি বোর্ড এ সময়ের মধ্যে লভ্যাংশ জমা দিতে ব্যর্থ হলে তার বিরুদ্ধে এক লাখ টাকা জরিমানার বিধান রাখা হয়েছে। এছাড়া ট্রাস্টি বোর্ড যদি অব্যাহতভাবে ব্যর্থ হতে থাকে, তবে ব্যর্থতার প্রথম তারিখ হতে প্রত্যেক দিনের জন্য আরও পাঁচ হাজার টাকা করে জরিমানা দিতে হবে। শ্রমিক কল্যাণ ফাউন্ডেশনের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, ফাউন্ডেশন তহবিলে বর্তমানে সোয়া ২০০ কোটি টাকা বেশি জমা রয়েছে। এ তহবিল থেকে এখন পর্যন্ত প্রায় এক হাজার শ্রমিককে সহায়তা করা হয়েছে।
দেশে শিল্প-প্রতিষ্ঠানের সংখ্যার সঠিক কোনো পরিসংখ্যান নেই। তবে ২০০১ সালের পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্যানুযায়ী দেশে শিল্প প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা দুই লাখ ৪২ হাজার ৮১৮টি। গত ১৬ বছরে এ সংখ্যা আরও অনেক বড়েছে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।
এদিকে, এতদিন শ্রমিক কল্যাণ ফাউন্ডেশনের কোনো সুনির্দিষ্ট দফতর ছিল না। ফলে সেভাবে কোনো লোকবলও ছিল না। সম্প্রতি সচিবালয়ে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ভবনের পেছনে কার্যালয় পেয়েছে ফাউন্ডেশন। ফাউন্ডেশনের কর্মকর্তারা বসছেন সেখানে। এরইমধ্যে ফাউন্ডেশনের একটি ওয়েবসাইটও করা হয়েছে।
ফাউন্ডেশনের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জাগো নিউজকে বলেন, ‘এতদিন ফাউন্ডেশনের নিজস্ব কোনো লোকবল ও অফিস না থাকায় এটি সেভাবে কার্যকর করা যায়নি। এর জনবল কাঠামোতে ১৮ জন থাকলেও এখন আটজন কর্মকর্তা-কর্মচারী রয়েছেন।’
Advertisement
তিনি বলেন, ‘দেশে অনেক মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানি আছে, যারা লাভ করছে। কিন্তু ফাউন্ডেশনের তহবিলে লভ্যাংশ দিচ্ছে না। এদের বিরুদ্ধে আমরা ফাইল প্রসেস করছি। তাদের কাছে লভ্যাংশ না দেওয়ার কারণ জানতে চাওয়া হবে।’
ফাউন্ডেশনের মহাপরিচালক এ এম এম আনিসুল আওয়াল বর্তমানে হজ পালনের জন্য সৌদি আরবে আছেন। মহাপরিচালকের দায়িত্বে রয়েছেন শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের যুগ্মসচিব মো. রেজাউল হক। তিনি জাগো নিউজকে বলেন, ‘আইনটি পুরনো হলেও শ্রমিক কল্যাণ ফাউন্ডেশন ফাংশনাল হয়েছে কয়েক বছর আগে থেকে। কাজটি কেবল আমরা শুরু করেছি। এটিকে আরও সফল করতে বিভিন্ন উদ্যোগ নেওয়া হবে।’
তিনি আরও বলেন, ‘কেউ লভ্যাংশ না দিলে ধরা মুশকিল। কারণ সে যদি বলে লাভে নেই, তবে সে যে লাভে আছে সেটা আমাকে প্রমাণ করতে হবে। সেজন্য কিছু সমন্বয়ের প্রয়োজন আছে। ধীরে ধীরে সবই আমরা করব।’
ফাউন্ডেশন আইনটি ২০১৩ সালে সংশোধন করা হয়। তার আগে ২০১০ সালে আইনটির বিধিমালা করা হয়, ২০১৫ সালে সংশোধিত হয় এই বিধিমালা।
বাংলাদেশের প্রাতিষ্ঠানিক ও অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে নিয়োজিত শ্রমিক ও তাদের পরিবারের কল্যাণ সাধনের জন্য আইনটি করা হয়েছে। অসুস্থ বা অক্ষম বা অসমর্থ শ্রমিকদের আর্থিক সাহায্য, দুর্ঘটনায় নিহত শ্রমিকের পরিবারকে সাহায্য, শ্রমিকদের জীবন বীমার জন্য যৌথ বীমা ব্যবস্থার প্রবর্তন করাসহ শ্রমিকের পরিবারের মেধাবী সদস্যদের শিক্ষাবৃত্তি দেওয়া ফাউন্ডেশনের মূল উদ্দেশ্য বলে শ্রম মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।
জানা গেছে, শ্রমিক কল্যাণ ফাউন্ডেশনের তহবিল থেকে ইতোমধ্যে তাজরিন ফ্যাশনে অগ্নিদগ্ধ হয়ে মারা যাওয়া ৯৯ জনকে এক লাখ টাকা করে সহায়তা দেওয়া হয়েছে।
এছাড়া ফাউন্ডেশনের তহবিলের আওতায় নির্মাণ শ্রমিকদের জন্য একটি গোষ্ঠী বীমা স্কিম চালু করা হয়েছে। মোটরযান মেকানিক বা শ্রমিক গোষ্ঠী বীমার আওতায় এসেছে বলেও জানিয়েছেন ফাউন্ডেশনের এক কর্মকর্তা।
এছাড়া চলতি অর্থবছরে মৃত শ্রমিকের পরিবারসহ শ্রমিকদের চিকিৎসা ও সন্তানদের উচ্চশিক্ষার জন্য আরও ২১১ জনকে আর্থিক সহায়তা দেওয়া হবে। এদের মোট এক কোটি ২ লাখ ৭৫ হাজার টাকা দেওয়া হবে।
যারা লভ্যাংশ দিয়েছেফাউন্ডেশন সূত্রে জানা গেছে, ৩১ আগস্ট পর্যন্ত ফাউন্ডেশনের তহবিলে লভ্যাংশ জমা দেওয়া প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে রয়েছে- প্রাণ-আরএফএল গ্রুপ, কোটস বাংলাদেশ লিমিটেড, রেনেটা এগ্রো ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড, রেনেটা লিমিটেড, ফুওয়াং সিরামিক, নেক্সাস সুয়েটার ইন্ডান্ট্রিজ (প্রা.) লিমিটেড, নেক্সাস ফ্যাশন লিমিটেড, বেঙ্গল গ্লাস ওয়ার্কস লিমিটেড, দি বেঙ্গল প্যাকেজ, এসিএস টেক্সটাইল (বাংলাদেশ) লিমিটেড, ব্রিটিশ আমেরিকান ট্যোবাকো, নেসলে বাংলাদেশ লিমিটেড, লাফার্জ সুরমা লিমিটেড, টিএম টেক্সটাইল অ্যান্ড গার্মেন্টস লিমিটেড, ইউনিলিভার বাংলাদেশ লিমিটেড, সিঙ্গার বাংলাদেশ লিমিটেড, রবি আজিয়াটা লিমিটেড, রেকিট বেনকিজার (বাংলাদেশ) লিমিটেড, আরএকে সিরামিক বাংলাদেশ লিমিটেড, গ্রামীণফোন, হুয়াই টেকনোলজিস (বাংলাদেশ) লিমিটেড, লিন্ডে বাংলাদেশ লিমিটেড, ক্রাউন সিমেন্ট লিমিটেড, অ্যাসেনশিয়াল ড্রাগ কোম্পানি লিমিটেড, বার্জার পেইন্ট বাংলাদেশ লিমিটেড, জেনসন অ্যান্ড নিকোলসন (বাংলাদেশ)লিমিটেড, বার্জার-বেকার বাংলাদেশ লিমিটেড, বাটা সু কোম্পানি (বাংলাদেশ)লিমিটেড, হেইডেলবার্গ সিমেন্ট বাংলাদেশ লিমিটেড ও সিনজেনটা বাংলাদেশ লিমিটেড।
এছাড়া কর্ণফুলী ফার্টিলাইজার কোম্পানি লিমিটেড, ম্যারিকো বাংলাদেশ লিমিটেড, স্যামসাং আর অ্যান্ড ডি ইনস্টিটিউট বিডি লিমিটেড, এপিএম গ্লোবাল লজিস্টিকস বাংলাদেশ লিমিটেড, এসিআই-গোদরেজ অ্যাগ্রোভেট, দেশবন্ধু পলিমার লিমিটেড, সান ফার্মাসিউটিক্যালস বিডি লিমিটেড, জুয়েলিং ফার্মা বিডি লিমিটেড, এইচডব্লিউএ ওয়েল টেক্সটাইল বিডি লিমিটেড, হোলসিম সিমেন্ট (বাংলাদেশ) লিমিটেড, এশিয়ান কনজুমার্স কেয়ার (প্রাঃ) লিমিটেড, এনডিবি ক্যাপিটাল লিমিটেড, মাইরস্ক বাংলাদেশ লিমিটেড, অ্যাসেঞ্চার কমিউনিকেশন ইনফ্রাস্টট্রু সল্যুশন লিমিটেড, প্রিমিয়ার এলপি গ্যাস লিমিটেড, মতিন স্পিনিং মিলস লিমিটেড, পেডিলাইট স্পেশালিটি কেমিক্যাল বাংলাদেশ প্রাইভেট লিমিটেড, দি অ্যাকমি ল্যাবরেটরিজ লিমিটেড, রহিমা আফরোজ ব্যা টারি লিমিটেড, রহিমা আফরোজ অ্যাকমুলেটর লিমিটেড, বাংলাদেশ কেবল শিল্প লিমিটেড খুলনা, রেনউইক যজ্ঞেশ্বর অ্যান্ড কোং (বিডি) লিমিটেড কুষ্টিয়া, জিই হেলথ কেয়ার বাংলাদেশ লিমিটেড, আমেরিকান লাইফ ইন্সুরেন্স কোম্পানি লিমিটেড, ইস্টার্ন হাউজিং লিমিটেড, আইটি কনসালটেন্টস লিমিটেড, ডিএইচএল গ্লোবাল ফরোয়ার্ডিং (বিডি) লিমিটেড, পদ্মা অয়েল কোম্পানি লিমিটেড, বিকাশ লিমিটেড, স্টার সিরামিকস লিমিটেড লভ্যাংশ জমা দিয়েছে।
লভ্যাংশ জমা দেওয়া কোম্পানির মধ্যে আরও রয়েছে- পারফেট্টি ভ্যা ন মেলে বিডি প্রা. লিমিটেড, এপিএল বাংলাদেশ (প্রা.)লিমিটেড, পপুলার ফার্মা লিমিটেড, আমেরিকান অ্যান্ড ইফার্ড বাংলাদেশ লিমিটেড, ইফাদ অটোস লিমিটেড, ওয়ালটন গ্রুপ, চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জ লিমিটেড, বেক্সিমকো ফার্মা লিমিটেড, ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ লিমিটেড, প্যা রামাউন্ট টেক্সটাইলস লিমিটেড, লালবাগ কেমিক্যা ল অ্যান্ড পারফিউম ওয়ার্কস, মেঘনা পেট্রলিয়াম লিমিটেড, এডিএন টেলিকম লিমিটেড, ইস্টার্ন রিফাইনারি লিমিটেড, এলপি গ্যা স লিমিটেড, যমুনা ওয়েল কোম্পানি লিমিটেড, ইবনে সিনা ফার্মা ইন্ডা. লিমিটেড, নুভিস্তা ফার্মা লিমিটেড, এনওয়াইকে লাইন (বাংলাদেশ)লিমিটেড, টিএসপি কমপ্লেক্স লিমিটেড (টিএসপি সার উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান), কোহনী-নাজেল লিমিটেড, ল্যা বএইড হাসপাতাল লিমিটেড, ইস্টার্ন লুব্রিক্যান্টস ব্লেন্ডারস লিমিটেড, গ্ল্যাক্সো স্মিথ ক্লেইন বাংলাদেশ, আলহাজ টেক্সটাইল মিলস লিমিটেড ও মোবিজোন টেলিকমিউনিকেশন লিমিটেড।
আরএমএম/এসআর/এমএস