কিছু মানুষ আছেন যাঁদের শারীরিক প্রস্থান মানেই চলে যাওয়া নয়। আওয়ামী লীগ নেতা ও বিজ্ঞ পার্লামেন্টারিয়ান সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত ছিলেন সেই ধরনের মানুষ। যারা চলে যাওয়ার পরও তাঁদের কর্মগুণে বেঁচে থাকেন মানুষের অন্তরে। এ ধরনের মানুষের কোনো মৃত্যু নেই। প্রকৃতির অমোঘ নিয়মে আজ ভোর চারটার দিকে তিনি ইহলোকের মায় ত্যাগ করে চলে যান না ফেরার দেশে। তাঁর এই চলে যাওয়ায় বিরাট শূন্যতা দেখা দিল রাজনৈতিক অঙ্গনে। এক বর্ণাঢ্য অধ্যায়ের অবসান হলো সেই সঙ্গে। এক গৌরবময় জীবনের অধিকারী ছিলেন সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত। সত্তরের প্রাদেশিক পরিষদে সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত ছিলেন অন্যতম কনিষ্ঠ সদস্য। স্বাধীন দেশের প্রথম সংসদসহ চার দশকের প্রায় সব সংসদেই নির্বাচিত হয়েছেন তিনি। ষাটের দশকের উত্তাল রাজনীতি থেকে উঠে আসা বামপন্থী এই নেতা আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য ছিলেন। সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের জন্ম ১৯৪৬ সালে সুনামগঞ্জের আনোয়ারাপুরে। প্রথম জীবনেই বামপন্থী আন্দোলনে জড়িয়ে পড়া সুরঞ্জিত দ্বিতীয়, তৃতীয়, পঞ্চম, সপ্তম, অষ্টম, নবম এবং দশম জাতীয় সংসদসহ মোট সাতবার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। তিনি ১৯৯৬ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সংসদ বিষয়ক উপদেষ্টার দায়িত্বে ছিলেন। ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগ দ্বিতীয়বারের বারের মতো ক্ষমতায় আসার পর তিনি রেলমন্ত্রী হন। তবে সহকারীর অর্থ কেলেঙ্কারির একটি ঘটনার জেরে পদত্যাগ করেন তিনি। কিন্তু পদত্যাগপত্র গ্রহণ না হওয়ায় সেই সময় তাকে দফতরবিহীন মন্ত্রী হিসেবে রাখা হয়।ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর করেন। পরে এলএলবি ডিগ্রি সম্পন্ন করে আইন পেশায় নিযুক্ত হন। ছাত্র জীবনেই তিনি বামপন্থী আন্দোলনের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন। হাওরাঞ্চলের ‘জাল যার জলা তার’ আন্দোলনে দীর্ঘদিন তিনি নেতৃত্ব দিয়েছেন। নব্বই দশকে সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত আওয়ামী লীগে যোগ দেন। এর আগে তিনি ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি ও একতা পার্টির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। সংসদে সব সময় সরব এ সংসদ সদস্য একজন অভিজ্ঞ সংবিধান বিশেষজ্ঞ হিসেবে সুপরিচিত ছিলেন। গত ৩ ফেব্রুয়ারি ফুসফুসের সমস্যার জন্য রাজধানীর ল্যাবএইড হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছিল সুরঞ্জিত সেনগুপ্তকে। ৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৭, শনিবার রাতে শারীরিক অবস্থার অবনতি ঘটায় তাঁকে প্রথমে করোনারি কেয়ার ইউনিটে (সিসিইউ) নেওয়া হয়। পরে রাতেই তাঁকে লাইফ সাপোর্টে রাখা হয়। চিকিৎকদের সব চেষ্ঠা ব্যর্থ করে দিয়ে তিনি আজ ভোর রাত ৪টা ২৪ মিনিটে রাজধানীর ল্যাবএইড হাসপাতালে শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন৷সুরঞ্জিত ছিলেন এমন এক প্রজন্মের প্রতিনিধি যাঁরা শুধু রাজনীতির জন্যই নিজের জীবন উৎসর্গ করেছেন। বঙ্গবন্ধুর অনুপম সান্নিধ্য পেয়েছেন তিনি। অসাম্প্রদায়িক চেতনার এক মূর্ত প্রতীক সুরঞ্জিত গণতন্ত্রের লড়াইয়ে রাজপথের লড়াকু সৈনিক ছিলেন। ২০০৪ সালের একুশে আগস্ট আওয়ামী লীগের জনসভায় নারকীয় গ্রেনেড হামলায় তিনি মারাত্মক আহত হন। কিন্তু জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত থেকেছেন আপোসহীন। রাজনৈতিক জীবনে নানা চড়াই-উৎরাই এসেছে। সেগুলো পার করেছেন নিজস্ব প্রজ্ঞা ও মেধায়। সাধারণ মানুষের কাতারে থেকে আমৃত্যু সংগ্রাম করেছেন তাদের জন্য। জনপ্রতিনিধি হিসেবে বার বার নির্বাচিত হওয়ার মধ্য দিয়েও তাঁর প্রতি মানুষের ভালোবাসাও প্রকাশিত হয়। রাতের তারারা থাকে দিনের আলোয়। সুরঞ্জিতও থাকবেন আলোর দিশারী হয়ে নিরন্তর অনুপ্রেরণার উৎস হিসেবে। আমরা তাঁর বিদেহি আত্মার প্রতি জানাই গভীর শ্রদ্ধা। তাঁর শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি রইলো সমবেদনা। এইচআর/এমএস
Advertisement