শিরোনামের সঙ্গে নিজেই একটু দ্বিমত পোষণ করছি। নারীর প্রতি বৈরিতা তো মনে হয় চলছে, চলবে ধরনের একটা বিষয়। নারীর প্রতি বৈরিতা বন্ধ, নারীর উপর নির্যাতন বন্ধের কোনো শুভ লক্ষণ তো আপাতত চোখে পড়ছে না। নারীর জন্য শুভ থাকে কোন বছর? প্রতি বছরই তো ধর্ষণ নিপীড়নের শিকার হতে হয় নারীকে। সেই সংখ্যা দিন দিনই বাড়ছে। প্রতি বছরই বাড়ছে। বৈরী এক বিশ্বেই বাস করছি আমরা। নারী হিসেবে প্রতিদিনই যুদ্ধের ভিতর দিয়েই পথ চলতে হয় আমাদের। এ যুদ্ধ নারীর একান্ত নিজস্ব যুদ্ধ। ভুক্তভোগী ছাড়া এর তিক্ততা, বিড়ম্বনা, যন্ত্রণা কেউই উপলব্ধি করতে পারবে না। তারপরও বলতে হয়, ২০১৬ সালটি ছিল নারী নির্যাতনের জন্য বিশেষভাবে ঘটনাবহুল। প্রথমত, বীভৎস সব হত্যাকাণ্ডের শিকার হতে হয়েছে এবার নারীকে। তনু, মিতু, রিশা, নিতু, এমন একসারি নাম ভেসে ওঠে চোখে। ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে তাদের কাউকে। কাউকে প্রাণ দিতে হয়েছে বখাটের লাম্পট্যের প্রস্তাবে ‘না’ শব্দটি উচ্চারণ করায়। এ বছর পাঁচ বছরের ছোট শিশুর উপর বীভৎস নির্যাতনের খবর কাঁদিয়েছে দেশবাসীকে। তবে সেখানেই যে এমন নির্যাতন বন্ধ হয়ে গেছে তা নয়। বরং এ ঘটনার পরপরই আড়াই বছর, তিন বছর, ১১ বছরের শিশু ধর্ষণের খবর প্রকাশিত হয়েছে। স্কুলছাত্রী রিশাকে বখাটের ছুরিকাঘাতে হত্যার পর পরই নিতু মণ্ডলসহ আরও কয়েকটি মেয়েকে প্রাণ দিতে হয়েছে একইভাবে। খাদিজার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে তাকে চাপাতি দিয়ে কোপানোর দৃশ্যও ভাইরাল হয়েছে ফেসবুকে। মেয়ের উপর বখাটেদের উৎপাতের প্রতিবাদ করায় বাবাকে হারাতে হয়েছে দুই পা এমন সংবাদও স্তম্ভিত করেছে পাঠককে। উত্ত্যক্তের প্রতিবাদ করায় মিরপুরে প্রকাশ্যে দুই যমজ বোনকে পিটিয়ে আহত করেছে বখাটেরা। আর বাল্যবিবাহ প্রতিরোধের নামে শিশু মেয়েদের বিয়ের বৈধতা দেওয়ার সরকারি কৃতিত্বও ঘটেছে এ বছরই। পারিবারিক ও সামাজিক নির্যাতন এবং মানসিক চাপ সহ্য করতে না পেরে আত্মহত্যা করতে বাধ্য হয়েছেন অনেক নারী। কিছুদিন আগেই ধর্ষণের শিকার এক কিশোরীর আত্মহত্যার খবর বেশ গুরুত্ব দিয়েই প্রকাশিত হয়েছে একাধিক জাতীয় দৈনিকে। আত্মহত্যার তালিকায় সমাজের নিন্মতম পর্যায় থেকে রয়েছে মডেল ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকের নামও। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক আখতার জাহান জলির আত্মহত্যাকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন ব্লগ ও সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে তার দুঃখময় পারিবারিক জীবনের কাহিনীও চলে আসে সামনে। প্রশ্ন হলো এভাবে আর কতকাল নারীর উপর চলবে নিপীড়ন? জানি না আগামী বছর আর কত নারীর উপর নেমে আসবে নির্যাতনের খড়গ। পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্র যতদিন পর্যন্ত নারীবান্ধব না হবে ততোদিন ঘরে-বাইরে, সমাজে, প্রতিষ্ঠানে বৈরিতার মুখোমুখি হয়েই পথ চলতে হবে নারীকে। শ্রেষ্ঠত্বের অহংকার, পুরুষতান্ত্রিক ধ্যান ধারণা যতদিন শাসন করবে আমাদের অধিকাংশের মনোজগত ততোদিন বৈরী পরিবেশেই কাটবে নারীর জীবন। কখনও স্বামী ও শ্বশুরপক্ষের আত্মীয়দের নির্যাতনে, কখনও কর্মক্ষেত্রে সহকর্মী ও ঊর্ধ্বতনের নির্যাতনে, কখনও রাস্তাঘাটে ও এলাকার বখাটে ও লম্পটদের আক্রমণে, কখনও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষক ও সহপাঠীদের দৌরাত্ম্যে দুর্বিষহ হয়ে পড়ছে নারীর জীবন। মানসিক নির্যাতন, শারীরিক আক্রমণ, অর্থনৈতিক শোষণ কোনোটারই যেন কোনো প্রতিকার নেই। নারীর প্রতি অশ্রদ্ধা ও বৈষম্যের ভাইরাস রয়েছে সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে। পথচলতি কোনো নারীর প্রতি অশোভন মন্তব্য ছুঁড়ে দিতে, অশ্লীলভাবে স্পর্শ করতে যেন বাঁধছে না কোনো শ্রেণি পেশার পুরুষেরই। স্ত্রীকে নির্যাতন করতে, স্ত্রীর প্রতি ব্যাঙ্গাত্বক উক্তি করতে, তার কাছে যৌতুক চাইতে যেন কিছুই আসে যাচ্ছে না। উচ্চশিক্ষিত সাংবাদিক, চিকিৎসক, প্রকৌশলী নারী থেকে শুরু করে চাষী পরিবারের মেয়েটিও স্বামীর শারীরিক মানসিক যৌন ও আর্থিক নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন একই ভয়াবহ মাত্রায়। মাত্র গতকালই এক উচ্চশিক্ষিত ও কর্মজীবী নারী আমাকে জানালেন তার উপর ক্রমাগত চলা মানসিক নির্যাতনের কথা। তার স্বামীও উচ্চশিক্ষিত। সংসারে অভাব নেই অর্থবিত্তের। শুধু অভাব রয়েছে স্বামীর ভদ্রতা ও সৌজন্যের। কথায় কথায় স্ত্রী ও তার বাবার বাড়ি বিষয়ে কটূক্তি ও অপমানসূচক মন্তব্য করেন তিনি। কারণ নারীকে সম্মান করার পারিবারিক শিক্ষাটিই তিনি সম্ভবত পাননি। সবকিছুর উত্তরে পুরনো বুলিই আবার আওড়াতে বাধ্য হচ্ছি। যতদিন রাষ্ট্র নারীবান্ধব না হবে, যতদিন নারীর উপর সংঘটিত সকল অন্যায়ের দ্রুত, সুষ্ঠু বিচার না হবে, যতদিন জেন্ডার ক্রাইমকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে দেখা না হবে ততোদিন এই বৈরিতা চলতেই থাকবে। নারীর উপর সংঘটিত সকল জুলুম, নির্যাতনকে দেখতে হবে জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু হিসেবে। পাঠ্যপুস্তক থেকে শুরু করে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পলিসি ও শিক্ষকদের আচরণে জেন্ডার সংবেদনশীলতা থাকতে হবে। আইন প্রতিষ্ঠার প্রক্রিয়াকেও হতে হবে নারীবান্ধব। আগামী বছর এবং আগামী সবগুলো বছর যেন হয় নারী নির্যাতন মুক্ত এমন প্রত্যাশা করলেও সেটা যে আকাশ কুসুম কল্পনা তাও তো বুঝি। তবে আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতি আরও উন্নত হোক। অন্তত নিরাপত্তাটুকু পাক নারী। খুব কি বেশি চাওয়া হয়ে গেল? নারী-পুরুষ সব মানুষের জন্যই শুভ হোক আগামী বিশ্ব।লেখক : কবি, সাংবাদিক। এইচআর/পিআর
Advertisement