ঢাকাই চলচ্চিত্রের ৬১ বছরের ইতিহাসে অনেক চড়াই-উৎরাইয়ের গল্প আছে। রয়েছে নানা বাঁক বদলের কাহিনীও। তেমনি ২০০৬ সালের ১৮ অক্টোবর মুক্তি পাওয়া ‘হৃদয়ের কথা’ নামের ছবিটিও অনেক কিছুর জবাব দিয়েছিলো। মোড় ঘুরেছিলো বাংলা গানের আঙিনায়। অশ্লীলতা আর বিদেশি নগ্ন ছবি কিংবা কুরুচিপূর্ণ কাটপিস যখন অক্টোপাসের মতো আঁকড়ে ধরেছিলো এ দেশীয় চলচ্চিত্র শিল্পকে, তখন রুচিশীল-শিক্ষিত দর্শক মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিলো সিনেমা হল থেকে। সেই সময়টাতে আশীর্বাদের ডাক নিয়ে আসলেন পরিচালক এস এ হক অলিক। তিনি তৎকালীন জনপ্রিয় জুটি রিয়াজ-পূর্ণিমাকে নিয়ে নির্মাণ করলেন ‘হৃদয়ের কথা’ ছবিটি। এর প্রযোজনাও করেছিলেন চিত্রনায়ক রিয়াজ।সময়টা ২০০৬ সাল। সেই বছরের ১৮ অক্টোবর মুক্তি পেলো ‘হৃদয়ের কথা’ ছবিটি। আজ ছবিটি মুক্তির এক দশক পূর্ণ হল। ইন্ডাস্ট্রির উল্লেখযোগ্য এই ছবিটির কলাকুশলীদের অভিনন্দন রইলো।মৌলিক গল্প, রোমান্টিক আমেজ, জনপ্রিয় জুটির নান্দনিক অভিনয়, শ্রুতিমধুর সব গান, নির্মাণের মুন্সিয়ানায় ‘হৃদয়ের কথা’ চমকে দিলো ইন্ডাস্ট্রিকে। সব শ্রেণির মানুষ হলে ফিরল উৎসব আমেজে। এই ছবির সাফল্যে অনুপ্রাণীত হয়ে চলচ্চিত্রে ফিরলেন অশ্লীলতার জন্য অভিমানে চলচ্চিত্র ছেড়ে দেয়া অনেক নির্মাতা ও শিল্পী। বিশেষ করে বাংলা গানের ভুবনে তখন ভীষণ খরা। আধুনিক গানের যে জনপ্রিয়তা সেটি প্রায় হারাতে বসেছিলো। ফিতার ক্যাসেট ছেড়ে সিডিতে ধাবমান হওয়া ইন্ডাস্ট্রি ভুগছিলো নতুন কিছু গ্রহণের সিদ্ধান্তহীনতায়। সেইসাথে পাইরেসিও ছিলো মাথাব্যথার কারণ। সেই সময়টাতে হাবিব ওয়াহিদ যেন জাদুর পরশ নিয়ে এলেন ‘হৃদয়ের কথা’ ছবিতে ‘ভালোবাসবো বাসবো রে বন্ধু’ গানটি নিয়ে। কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের তরুণদের কাছে তো বটেই, ভিন্ন আমেজ আর হৃদয় ছোঁয়া সুরের কাছে মন সঁপেছিলেন সব বয়সের শ্রোতাই। তখন প্রায় সবখানেই বেজেছে এই গানটি। পাশাপাশি এসআই টুটুলের কণ্ঠে ‘যায় দিন যায় একাকী’ গানটিও তুমুল জনপ্রিয়তা পেয়েছিলো। এই গানগুলো বাংলা ছবির গানে নতুন মাত্রা যোগ করে দিলো। সেই থেকে আজ অবধি চলচ্চিত্রের গানে একটা ভিন্নতা লক্ষ করা যাচ্ছে। দীর্ঘ পথ পেরিয়ে এসে অনেক কিছুই বদলে গেছে সেদিনের চলচ্চিত্রে। রিয়াজ আর চলচ্চিত্রে নিয়মিত নন। গেল বছর হুমায়ূন আহমেদের উপন্যাস অবলম্বনে মেহের আফরোজ শাওনের পরিচালনায় ‘কৃষ্ণপক্ষ’ ছবি দিয়ে বহুদিন পর বড় পর্দায় ফিরেছিলেন রিয়াজ। ছবিটিতে তার বিপরীতে অভিনয় করেছেন মাহিয়া মাহি। গেল বছরের শেষ দিকে তিনি আরো একটি ছবিতে অভিনয় করেছিলেন। ওয়াজেদ আলী সুমন পরিচালিত সেই ছবির নাম ‘সুইটহার্ট’। অন্যদিকে পূর্ণিমাও সংসারে মনোযোগী হয়েছেন। কালেভদ্রে তার দেখা মেলে নাটকে। একটি ছবিতে তার কাজের কথা শোনা গিয়েছিলো মাঝখানে। তবে পূর্ণিমা নিজেই জাগো নিউজের এক সাক্ষাৎকারে সেই খবরটিকে উড়িয়ে দিয়েছিলেন। এদিকে এতগুলো বছর শেষে অতীত স্মরণ করলেন হৃদয়ের কথা ছবির নির্মাতা এস এ হক অলিক, প্রযোজক ও নায়ক রিয়াজ এবং নায়িকা পূর্ণিমা। রিয়াজ বলেন, ‘হৃদয়ের কথা ছবিটি ছিলো তৎকালীন সময়ে অশ্লীল ছবির যুগের বিরুদ্ধে একটি নীরব প্রতিবাদ। আমরা চেষ্টা করেছিলাম প্রমাণ করে দিতে, ছবি ব্যবসা করাতে কাটপিস বা অশ্লীলতা লাগে না। একটি সুন্দর গল্প ও নির্মাণ প্রয়োজন। সেই প্রতিবাদের জায়গায় আমরা সফল ছিলাম। আমার স্পষ্ট মনে আছে, হৃদয়ের কথা চলছিলো এমন একটি এলাকার তিনটি হলে তখন বিদেশি নগ্ন ছবি ও বাংলাদেশি অশ্লীল ছবিও চলছিলো। সেই হলগুলোতে দর্শক ছিলো না। সেই দৃশ্য দেখে অদ্ভুত এক ভালো লাগা কাজ করেছিলো মনের মধ্যে। মনে হয়েছিলো, আমরা পেরেছি। হৃদয়ের কথার সাফল্যের পর থেকেই অশ্লীল ছবির নির্মাণ বন্ধ হতে শুরু করে। এই ছবিটি ভালো ছবি নির্মাণে সবাইকে উৎসাহিত করেছিলো, শ্রুতিমধুর গানের যে একটা চল ছিলো সিনেমায় বহুদিন পর সেটিও ফিরিয়ে এনেছিলো।’রিয়াজ আরো বলেন, ‘দেখতে দেখতে দশ বছর কেটে গেল। আজ একটা বিষয় খুব অনুধাবন করছি, পরিকল্পনা করে কাজ করতে পারলে সাফল্য খুব কঠিন হয় না। আমরা ছবিটি নির্মাণের আগে অনেক পরিকল্পনা করেছিলাম। আমরা চেয়েছিলাম, ছবিতে এমন কিছু গান করবো যেগুলো শহরের প্রাইভেটকারগুলোতে বাজবে। এর কারণ হলো তখন বাংলা ছবি নিয়ে একটু শিক্ষিত মানুষগুলোর মধ্যে নেতিবাচক একটা ধারণা ছিলো। আমরা সেটি করতে পেরেছিলাম। প্রাইভেটকার তো বটেই, সকল শ্রেণির মানুষের কাছেই পৌঁছেছিলো হাবিব ওয়াহিদের গানটি। অন্য গানগুলোরও জনপ্রিয়তা ছিলো আকাশছোঁয়া।’নতুন করে আবার কোনো ‘হৃদয়ের কথা’ কেন নির্মাণ করা গেলো না- এই প্রশ্নের জবাবে রিয়াজ বললেন, ‘আমরা চেষ্টা যে করিনি তা নয়। কিন্তু চাইলেই হৃদয়ের কথা নির্মাণ করা যায় না। তেমন কোনো গল্প এখন পর্যন্ত পাইনি। এই যেমন আয়নাবাজি ছবিটির কথাই ধরুন। এটা এমন একটি গল্প যা খুব সহজেই মানুষকে মুগ্ধ করবে। আমিও মুগ্ধ হয়েছি। আসলে গল্প সার্বজনীন না হলে ‘হৃদয়ের কথা’ বানানো যায় না। আমি এখনো অপেক্ষায় আছি সেই গল্পের দেখা পাবো। আবারো প্রযোজনা করবো। সম্ভব হলে অভিনয়ও করতে চাই।’হৃদয়ের কথা ছবিতে রিয়াজ-পূর্ণিমা জুটির গ্রহণযোগ্যতা অনন্যতায় পৌঁছেছিলো। কিন্তু এই ছবির পর খুব বেশিদিন আর একসঙ্গে দেখা যায়নি এই জুটিকে। এমনকি দুজনই বর্তমানে ছোট পর্দায় কাজ করছেন। তবুও একসঙ্গে দেখা যাচ্ছে না। এ বিষয়ে দর্শকদেরও আক্ষেপ আছে। কিন্তু রিয়াজ সেই আক্ষেপকে সম্মান দিয়েই বললেন, ‘দর্শকরা ভালোবেসেছিলেন বলেই আমরা জুটি হিসেবে জনপ্রিয়তা পেয়েছিলাম। পূর্ণিমার সঙ্গে আমার জুটিটি ছিলো বড় পর্দায়। ছোট পর্দায় এই জুটির ইমেজটি ব্যবহার করতে চাই না। আমার বিশ্বাস পূর্ণিমাও আমার সঙ্গে একমত হবে। যদি কখনো সুযোগ হয়, আবারো বড় পর্দাতেই ফিরবো একসঙ্গে।’এদিকে ‘হৃদয়ের কথা’র দশ বছর পূর্তি উপলক্ষে ছবির পরিচালক, প্রযোজক ও কলাকুশলীদের অভিনন্দন জানিয়েছেন পূর্ণিমা। তিনি বলেন, আমার ক্যারিয়ারে অন্যতম সফল একটি চলচ্চিত্র ‘হৃদয়ের কথা’। আর নিজের প্রথম ছবির এক দশক পূর্তি উপলক্ষে পরিচালক অলিক বলেন, ‘হৃদয়ের কথা- অনেক স্মৃতি কথায় মুড়ানো। এটি ছিলো আমার প্রথম চলচ্চিত্র, বড় পর্দায় আমার প্রথম স্বপ্ন পূরণ। ভালো ছবি নির্মাণের অনেক প্রতিকূলতা ছিলো তখন। সবকিছুকে অতিক্রম করে তখনকার মন্দ সময়টাতে নতুন সুরের গান গেয়েছিলো ‘হৃদয়ের কথা’। সকল শ্রেণির দর্শকদের কাছে ছবিটি তাদের হৃদয়ে জায়গা করে নিতে সক্ষম হয়েছিল। সকলের ভালোবাসায় আমি ছিলাম অভিভূত। আজকের এই দিনে সেই ছবির সকল দর্শক, নায়ক-নায়িকা, কলাকুশলী, শিল্পী ও টেকনিশিয়ানদের অভিনন্দন জানাই। বাংলা ছবির জয় হোক।’ তিনি আরো বলেন, ‘প্রথম ছবির সাফল্যের ধারাবাহিকতায় আমি আরো বেশ কিছু ছবি নির্মাণ করেছি। এ মুহূর্তে মুক্তির অপেক্ষায় আছে ‘এক পৃথিবী প্রেম’ ছবিটি। সবাইকে আমন্ত্রণ রইলো হলে গিয়ে ছবিটি দেখবেন।’এলএ/এমএস
Advertisement