সমাজের সব স্তরের মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণে গড়ে তোলা তীব্র আন্দোলনে পতন হয় আওয়ামী লীগ সরকারের। সেই জুলাই গণঅভ্যুত্থানের এক বছর পূরণ হচ্ছে। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে গত বছরের ৫ আগস্ট প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করে ভারতে পালিয়ে যান শেখ হাসিনা।
Advertisement
রাজধানীর যাত্রাবাড়ী ও এর আশপাশের এলাকা ছিল অভ্যুত্থানের অন্যতম হটস্পট। এক মাসেরও বেশি সময়ের আন্দোলনে পতন হয় শেখ হাসিনা সরকারের। জুলাই মাসে যাত্রাবাড়ীর আন্দোলনের তীব্রতা হাসিনা সরকারকে চরম চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলেছিল। জুলাই অভ্যুত্থানের রক্তের বড় একটি অংশ ঝড়েছে অগ্নিগর্ভ এ যাত্রাবাড়ীতে। অভ্যুত্থানে শহীদদের একটি বড় অংশই এ যাত্রাবাড়ী ও আশপাশের এলাকার। শেষ দিন ৫ আগস্ট পুলিশের নৃশংসতায় অর্ধশতাধিক ছাত্র-জনতা জীবন দিয়েছেন যাত্রাবাড়ীতে। যাত্রাবাড়ীর রায়েরবাগ, শনির আখড়া, কাজলা ও আশপাশের বেশির ভাগ মানুষের কাছে গণঅভ্যুত্থানের স্মৃতি অমলিন।
কোটা সংস্কারের আন্দোলনে ঘোষিত এক দফা কর্মসূচি বাস্তবায়নে ৭ জুলাই থেকে ঢাকাসহ সারাদেশে সকাল-সন্ধ্যা সর্বাত্মক ‘বাংলা ব্লকেড’ কর্মসূচি পালনের ডাক দিয়েছিল বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। আন্দোলনকারীরা সরকারি চাকরির সব গ্রেডে অযৌক্তিক ও বৈষম্যমূলক কোটা বাতিল করে সংবিধানে উল্লেখিত অনগ্রসর গোষ্ঠীর জন্য কোটাকে ন্যূনতম মাত্রায় এনে সংসদে আইন পাস করে কোটাপদ্ধতি সংস্কারের দাবি জানায়। এ কর্মসূচি চলে ১৩ জুলাই পর্যন্ত। এরপর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর মাধ্যমে আন্দোলন দমন ও শিক্ষার্থীদের ওপর আওয়ামী লীগ-ছাত্রলীগের হামলার ঘটনা ঘটলে আন্দোলন ছড়িয়ে পড়তে থাকে।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন, এ সময়ে যাত্রাবাড়ীর ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে শিক্ষার্থীরা নেমে আসেন। প্রথমে ১৬ জুলাই এ মহাসড়ক অবরোধ করেন শিক্ষার্থীরা। পরদিন (১৭ জুলাই) বিকেল থেকে আন্দোলন চরম আকার ধারণ করে। শিক্ষার্থীদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষ বাধে। যাত্রাবাড়ীর কাজলা এলাকায় ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে মেয়র হানিফ ফ্লাইওভারের দুটি টোল প্লাজায় আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেওয়া হয়।
Advertisement
শিক্ষার্থীদের কোটা সংস্কার আন্দোলন ঘিরে পরের দিনগুলো অগ্নিগর্ভ ছিল যাত্রাবাড়ীর ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের এই অংশটি। ১৭ থেকে ২১ জুলাই বিকেল পর্যন্ত এ অংশটি ছিল আন্দোলনকারীদের দখলে। মহাসড়কের বিভিন্ন স্থানে আগুন জ্বালিয়ে সার্বক্ষণিক পাহারায় ছিল ছাত্র-জনতা। বন্ধ ছিল সব ধরনের যান চলাচল।
‘সব ঘটনা চোখের সামনে ঘটেছে। রায়েরবাগের কাছে কদমতলী থানা দখল নেওয়ার চেষ্টার সময় পুলিশ আন্দোলনকারীদের লক্ষ্য করে বিপুল সংখ্যক গুলি ছুড়ে মানুষ মেরেছে। পুলিশ গুলি করতে করতে মেইন রাস্তায় চলে আসতো, টিয়ারশেল মারতো, ছররা গুলি করতো। পুলিশকে আবার হটিয়ে থানার ভেতরে ঢুকিয়ে দিত আন্দোলনকারীরা। টানা দুদিন (১৮ ও ১৯ জুলাই) এ অবস্থা চলেছে।’ - মো. ইলিয়াস হোসেন
মহাসড়কের দক্ষিণ পাশে রায়েরবাগ বাসস্ট্যান্ড থেকে একটি সড়ক চলে গেছে মেরাজনগর-মোহাম্মদবাগের দিকে। এ সড়কটি ধরে কিছুটা এগিয়ে দুটি বাঁকের পর আরও কিছুটা এগিয়ে কদমতলী থানা। ১৯ জুলাই এ থানার নিয়ন্ত্রণ নিতে মরিয়া ছিল আন্দোলনকারীরা। পুলিশও প্রতিরোধ গড়ে তুললে রণক্ষেত্রে পরিণত হয় পুরো এলাকা। ব্যাপক হতাহতের ঘটনা ঘটে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কয়েক দফা আন্দোলনকারীদের মহাসড়ক থেকে সরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করলেও বারবারই ব্যর্থ হয়।
আরও পড়ুনজুলাইয়ে প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহারের নির্দেশ দিয়েছিলেন শেখ হাসিনা হাসিনার পতনের পরও যাত্রাবাড়ীতে ৫২ জনকে হত্যা করে পুলিশ ফাঁস হওয়া অডিও রেকর্ডিং যেভাবে যাচাই করেছে বিবিসি হাসিনার নির্দেশেই গুলি, বিবিসির ভেরিফিকেশন বিচারে স্বচ্ছতা বাড়াবেআইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বাড়াবাড়িতে মারমুখী জনতা দুই পুলিশ সদস্যকে মেরে রায়েরবাগ ওভারব্রিজের ওপর ঝুলিয়ে রেখেছিল। র্যাবের হেলিকপ্টার থেকে যাত্রাবাড়ী এলাকায় টিয়ারশেল নিক্ষেপ এবং গুলিও করা হয় ছাত্র-জনতার ওপর।
Advertisement
উত্তর রায়েরবাগের বাসিন্দা মো. ইলিয়াস হোসেন একটি কোম্পানির পণ্য বাজারজাতকরণ বিভাগে কাজ করেন। তীব্র আন্দোলনের দিনগুলো তিনি সামনে থেকে দেখেছেন। তিনি বলেন, ‘সব ঘটনা চোখের সামনে ঘটেছে। রায়েরবাগের কাছে কদমতলী থানা দখল নেওয়ার চেষ্টার সময় পুলিশ আন্দোলনকারীদের লক্ষ্য করে বিপুল সংখ্যক গুলি ছুড়ে মানুষ মেরেছে। পুলিশ গুলি করতে করতে মেইন রাস্তায় চলে আসতো, টিয়ারশেল মারতো, ছররা গুলি করতো। পুলিশকে আবার হটিয়ে থানার ভেতরে ঢুকিয়ে দিত আন্দোলনকারীরা। টানা দুদিন (১৮ ও ১৯ জুলাই) এ অবস্থা চলে। পাশের মসজিদের মাইক থেকে আন্দোলনকারীরা বারবার পুলিশকে আত্মসমর্পণের জন্য বলেছে। পুলিশ তা না করে গুলি চালিয়েছে। তখন এমন অবস্থা যে পুলিশের নাম শুনলেই মানুষ ব্যাপক মারমুখী হয়ে উঠছিল। দুই পুলিশ সদস্যকে মেরে রায়েরবাগ ওভার ব্রিজের ওপর ঝুলিয়ে রাখতে দেখেছি।’
যাত্রাবাড়ী থানাও দখলে নেওয়ার চেষ্টা করেন আন্দোলনকারীরা। কিন্তু পুলিশের ব্যাপক গুলিবর্ষণের মুখে সেখানেও ব্যর্থ হন তারা।
আন্দোলন তীব্র আকার ধারণ করলে ১৯ জুলাই মধ্যরাত থেকে দেশব্যাপী কারফিউ জারি করে সরকার। এরপরও যাত্রাবাড়ী এলাকায় মহাসড়ক ছাড়েনি আন্দোলনকারীরা। আন্দোলনকারীদের সরিয়ে বন্ধ থাকা মহাসড়ক খুলে দিতে ২০ জুলাই বিকেল থেকে এ এলাকায় র্যাব, পুলিশ ও বিজিবির সমন্বয়ে অভিযান শুরু হয়। যাত্রাবাড়ী চৌরাস্তা থেকে সাইনবোর্ড পর্যন্ত মহাসড়ক এলাকায় আন্দোলনকারীদের ওপর নির্বিচারে গুলি চালায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। সাউন্ড গ্রেনেড, ছররা গুলি এবং টিয়ারশেলও নিক্ষেপ করা হয়। এতে ব্যাপক হতাহতের ঘটনা ঘটে। ২২ জুলাই থেকে মোটামুটি স্বাভাবিক হয় এ এলাকা।
‘২০ জুলাই এ এলাকার চারদিকে শুধু গুলির শব্দ ছিল। আমার চোখের সামনে বাগানবাড়ি রাস্তার ঢালে ট্রান্সমিটারটি গুলিতে ফুটো হয়ে যায়। আকাশে হেলিকপ্টার থেকেও গুলি করা হয়েছে। কত মানুষ যে জীবন দিয়েছে; আর কত মানুষ হাত-পা, চোখ হারিয়েছে তার শেষ নেই।’ -শাহরিয়ার হোসেন
শনির আখড়া বাগানবাড়ী এলাকার বাসিন্দা শাহরিয়ার হোসেন বলেন, ‘২০ জুলাই এ এলাকার চারদিকে শুধু গুলির শব্দ ছিল। আমার চোখের সামনে বাগানবাড়ি রাস্তার ঢালে ট্রান্সমিটারটি গুলিতে ফুটো হয়ে যায়। আকাশে হেলিকপ্টার থেকেও গুলি করা হয়েছে। কত মানুষ যে জীবন দিয়েছে; আর কত মানুষ হাত-পা, চোখ হারিয়েছে তার শেষ নেই।’
আরও পড়ুনকল রেকর্ড ট্রেলার মাত্র, অনেক কিছু এখনো বাকি: চিফ প্রসিকিউটর জুলাই গণঅভ্যুত্থানে শহীদ পরিবার ও আহতরা যেসব সুবিধা পাবেন ৬০০ কোটি টাকার হাসপাতাল এখন জুলাই আহতদের ‘আবাসিক হোটেল’ শহীদ পরিবার-গুরুতর আহতদের ফ্ল্যাট দেবে সরকারশনির আখড়ার গোবিন্দপুর বাজারের সুবর্ণা মিষ্টান্ন ভান্ডারের মালিক সুজিত দত্ত এসব ঘটনার একজন প্রত্যক্ষদর্শী। তিনি বলেন, ‘আন্দোলন দমাতে ২০ ও ২১ জুলাই পুলিশ, র্যাব ও বিজিবি এখানে ব্যাপক গুলি চালিয়েছে। শনির আখড়া আন্ডারপাসের ওপর থেকে গোবিন্দপুর বাজারের দিকে ব্যাপক গুলি চালানো হয়েছে। এতে অনেকেই মারা গেছেন, আহত হয়েছেন। আমার সামনেই কয়েকজনকে মারা যেতে দেখেছি।’
শনির আখড়া বাজারের একজন মসলা ব্যবসায়ী নাম প্রকাশ না করে বলেন, ‘পুলিশের গুলিতে আমার মসলার অনেকগুলো বৈয়াম ভেঙে গিয়েছিল। ভয়ে অনেক দিন ঠিকভাবে দোকান করতে পারিনি। বাজারের আশপাশে ইন্টারনেটের পোলগুলোতে গুলির চিহ্ন এখনো আছে। কত যে মানুষ মারা গেছে তার হিসাব কোনোদিন পাওয়া যাবে কি না জানি না। তখন এমন অবস্থা যে মারা গেছে চুপি চুপি নিয়ে কবর দিয়ে দিয়েছে।’
কারফিউ জারি ও যৌথ অভিযানের পর যাত্রাবাড়ী এলাকার পরিস্থিতি শান্ত হয়। শুরু হয় গাড়ি চলাচল। এরপর শুরু হয় পুলিশের ধরপাকড়। ধরপাকড়ের নামে দনিয়া, তুষার ধারাসহ যাত্রাবাড়ী থানার বিভিন্ন এলাকায় গুলি করে মানুষ মারার অভিযোগও করেন অনেকে।
আগস্টের শুরুতে শিক্ষার্থীরা পুলিশের গুলিতে নিহতদের বিচারসহ ৯ দফা দাবিতে ফের আন্দোলন শুরু করে। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা শিক্ষার্থীদের আলোচনায় বসার আহ্বান জানান। কিন্তু শিক্ষার্থীরা সেই আহ্বান প্রত্যাখ্যান করে ৩ আগস্ট প্রধানমন্ত্রীর পদত্যাগের এক দফা দাবি ঘোষণা করেন। দাবি আদায়ে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ৪ আগস্ট থেকে সর্বাত্মক অসহযোগ আন্দোলন শুরু করে। ৫ আগস্ট ঘোষণা দেওয়া হয় ‘লংমার্চ টু ঢাকা’ কর্মসূচি।
কর্মসূচির পরিপ্রেক্ষিতে ৪ আগস্ট সন্ধ্যা ৬টা থেকে সারাদেশে কারফিউ জারি করে সরকার। এর পরপরই যাত্রাবাড়ীর ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে ফের নামেন আন্দোলনকারীরা।
৫ আগস্ট বেলা কিছুটা গড়াতেই যাত্রাবাড়ীর এ মহাসড়ক ধরে হাজার হাজার মানুষ রাজধানীতে প্রবেশ করতে শুরু করেন। কিন্তু শেষ মুহূর্তে ফের বাধ সাধে চৌরাস্তার কাছে থাকা যাত্রাবাড়ী থানা পুলিশ। ছাত্র-জনতার ওপর নির্বিচারে গুলি চালায় পুলিশ। বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদ অনুযায়ী, এতে অর্ধশতাধিক মানুষ ওই দিনই মারা যায়।
শেষে উত্তেজিত জনতা যাত্রাবাড়ী থানা দখলে নিয়ে জ্বালিয়ে দেয়। মারমুখী জনতার হাতে ওইদিন কমপক্ষে ছয়জন পুলিশ সদস্য নিহত হন। নিহত এ পুলিশ সদস্যদের লাশ থানার আশপাশের সড়কে পরদিন দুপুর পর্যন্ত পড়েছিল বলে জানিয়েছেন প্রত্যক্ষদর্শীরা।
আরএমএম/এমএমএআর/এমএফএ/জেআইএম