জাতীয়

শিক্ষার্থীদের ওপর নির্মম হামলা দেখে সশরীরে আন্দোলনে অংশ নিই

শিক্ষার্থীদের ওপর নির্মম হামলা দেখে সশরীরে আন্দোলনে অংশ নিই

জুলাই গণঅভ্যুত্থানে ছাত্রদের পাশাপাশি সাহসী ভূমিকা রেখেছিলেন শিক্ষকরাও। ছাত্ররা যখন বিপদে পড়েছে শিক্ষকরা তখন তাদের উদ্ধার করতে ছুটে এসেছেন। দেশের সবখানেই ছাত্রদের পাশে দাঁড়িয়েছিল সচেতন শিক্ষক সমাজ।

Advertisement

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে (ঢাবি) যখন শিক্ষার্থীরা চরমভাবে আক্রান্ত তখনও সচেতন শিক্ষকরা শিক্ষার্থীদের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন। ৫ আগস্ট সরকার পতনের আগ পর্যন্ত চালিয়ে গেছেন প্রতিবাদ। এমন একজন শিক্ষক ঢাবি গণিত বিভাগের অধ্যাপক ড. শহীদুল ইসলাম। গণঅভ্যুত্থানের পরে তিনি পিরোজপুর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি হিসেবে দায়িত্ব নেন। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন জাগো নিউজের নিজস্ব প্রতিবেদক হাসান আলী ।

জাগো নিউজ: আপনি বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-আন্দোলনে কীভাবে যুক্ত হয়েছিলেন? তখন মনের অবস্থা কেমন ছিল?

ড. শহীদুল ইসলাম: আমি তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিত বিভাগের চেয়ারম্যানের দায়িত্বে ছিলাম। জুলাইয়ের ১৫ তারিখ আমি আমার বিভাগের শিক্ষার্থীদের মধ্যে আমেরিকা ও কানাডায় স্কলারশিপ পাওয়া শিক্ষার্থীদের একটা সংবর্ধনা দিয়েছিলাম। শুরুর দিকে শিক্ষার্থীদের দাবির সঙ্গে একমত পোষণ করলেও সরাসরি সম্পৃক্ত ছিলাম না। আমার ওই প্রোগ্রাম শেষ করে ২টার দিকে যখন বাসায় এসে কাপড় বদলানো শুরু করেছি, তখনই দেখলাম বাইরে চিৎকার চেঁচামেচি শোনা যাচ্ছে।

Advertisement

আমার বাসা ফুলার রোডে, ভিসি চত্বরের সঙ্গেই। দেখলাম ছেলেমেয়েরা দৌড়াদৌড়ি করছে। আমাদের শিক্ষক কোয়ার্টারের গেটে তখন তালা। যে কারণে আমি বাইরে বের হতে না পেরে ফেসবুক লাইভে দেখি, মেয়েরা বাসের মধ্যে লুকিয়েছে সেখানে ঢুকেও তাদের মারা শুরু করেছে। ছেলেমেয়েদের এভাবে লাঠি দিয়ে মারা দেখে আমার অনেক খারাপ লেগেছিল।

বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের ওপর বাইরের লোকজন এসে হামলা করবে, এটা দেখে খুবই খারাপ লেগেছিল। এরপর থেকেই মূলত আমি সশরীরে আন্দোলনে অংশ নেই

আরও পড়ুন

কোটা সংস্কার আন্দোলন থেকে গণঅভ্যুত্থান, স্বপ্ন নতুন বাংলাদেশ জুলাই আন্দোলনে শক্তি-প্রেরণা জুগিয়েছেন নারীরা জুলাই আন্দোলনে দৃষ্টিহীন মাহবুবের পাশে রইলেন না স্ত্রীও

দেখলাম, ভাইস চ্যান্সেলরের বাসার সামনেও মেয়েদের পেটানো হচ্ছে। পরে শুনলাম, এখানে বহিরাগতরা এসে ছেলেমেয়েদের ওপর হামলা করেছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের ওপর বাইরের লোকজন এসে হামলা করবে, এটা দেখে খুবই খারাপ লেগেছিল। এরপর থেকেই মূলত আমি সশরীরে আন্দোলনে অংশ নিই। আমরা মূলত সাদা দল এবং সাধারণ শিক্ষকের ব্যানারেই প্রতিবাদে অংশ নিয়েছিলাম। যখনই সুযোগ পেয়েছি তখনই আমি আন্দোলনে অংশ নিয়েছি।

Advertisement

জাগো নিউজ: আন্দোলনে অংশগ্রহণের কারণে প্রশাসনিক কোনো চাপ ছিল কি?

ড. শহীদুল ইসলাম: পুরো আন্দোলনে প্রশাসনের যা ভূমিকা ছিল, তাতে মনে মনে তো একটু ভয় ছিলই। কথা তো বলতেই পারতাম না, আবার ফেসবুকে কিছু লিখতে গেলেও সব সময় ভয়ে থাকতে হতো। কখন কার নামে মামলা হয়, কাকে বাসা থেকে তুলে নিয়ে যায়। দেশের নাগরিক হিসেবে আমাদের ন্যূনতম কোনো নাগরিক অধিকার ছিল না। তবুও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আমরা হাতেগোনা কয়েকজন শিক্ষক আগে থেকেই তৎকালীন সরকারের কুকর্মের কথাগুলো বলে পরিচিত ছিলাম।

এজন্য চাপ থাকা সত্ত্বেও ভয় পাইনি। আমরা তিনটি টার্মে নির্বাচনে ভোট দিতে পারিনি। বিশ্ববিদ্যালয়ে বিভিন্নভাবে হেনস্তার শিকার হয়েছি। এগুলো তো আগে থেকেই চলমান ছিল, তাই ভয় খুব একটা কাজ করেনি। চাকরি থাকুক বা না থাকুক, আন্দোলনে গিয়েছি। বিশ্বাস করেছি, চাকরি দেওয়ার মালিক আল্লাহ।

জাগো নিউজ: আন্দোলন চলাকালীন বিশেষ কোনো ঘটনা কি আপনার এখনো মাঝেমধ্যে মনে পড়ে?

ড. শহীদুল ইসলাম: শেষের দিন অর্থাৎ ৩৬ জুলাই, যা ঘটেছে সেটা তো একেবারে ভোলার মতো নয়। ওইদিন ১০টায় সাদা দলের একটা প্রোগ্রাম ছিল শহীদ মিনারে। তখন গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি পড়ছিল। আমাদের সবার সেখানে যাওয়ার কথা থাকলেও যেতে পারিনি। হেঁটে আসা দু-একজন মানুষ বলছিলেন, ‘ওইদিকে যাইয়েন না, গোলাগুলি চলতেছে’।

আমরা কারফিউ ভঙ্গ করেছি, আমাদের দাঁড়াতে দেবে না। অনেক তর্ক-বিতর্ক করে আমরা তাদের কাছে পাঁচ মিনিট সময় নেই। কিছুক্ষণ পরে তারা আমাদের ব্যানারটাও ছিঁড়ে ফেলে

তখন ফার্মেসির মেহেদী স্যারের সঙ্গে দেখা হলে তিনিসহ অপরাজেয় বাংলার সামনে গেলাম। সেখানে দেখি সাদা দলের আরও কয়েকজন শিক্ষক আছেন। ওখানে ২০-২৫ জন জড়ো হয়ে আমরা মিছিল নিয়ে রাজু ভাস্কর্যে যাই। আমরা যখন ওখানে দাঁড়িয়েছি, তখন শহীদ মিনার থেকে পুলিশ দৌড়ে চলে আসছে। তারা বলছে, আমরা কারফিউ ভঙ্গ করেছি, আমাদের দাঁড়াতে দেবে না। অনেক তর্ক-বিতর্ক করে আমরা তাদের কাছে পাঁচ মিনিট সময় নেই। কিছুক্ষণ পরে তারা আমাদের ব্যানারটাও ছিঁড়ে ফেলে।

সেখান থেকে যখন আমরা ভাইস চ্যান্সেলরের বাসার সামনে এসে বসলাম, তারা আমাদের সেখানেও বসতে দেবে না। রাজুতে দাঁড়ানোর সময় অনেক ছাত্র আমাদের সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল। পুলিশ মনে হয় এটা দেখেই আমাদের আর দাঁড়াতে দেয়নি। এর বেশ কিছুক্ষণ পরেই খবর পেলাম সেনাবাহিনী প্রধান জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণ দেবেন। তখনই বুঝলাম কিছু একটা হতে যাচ্ছে। আমরা শিক্ষকরা তখন আবার রাজুতে গিয়ে বসে অপেক্ষা করতে লাগলাম। বারবার সময় পেছানো হচ্ছিল, আর অপেক্ষা দীর্ঘ হচ্ছিল। সেই অপেক্ষা করার মুহূর্তটা আমার এখনো মনে পড়ে। কত দীর্ঘ ছিল সেই অপেক্ষা!

জাগো নিউজ: ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের ফলে শিক্ষাঙ্গনে কি কোনো পরিবর্তন এসেছে? আপনার কী মনে হয়?

ড. শহীদুল ইসলাম: প্রথমে যদি বলি ভাইস চ্যান্সেলর নিয়োগের বিষয়ে। অভ্যুত্থানের পরে বিভিন্ন জায়গায় ভাইস চ্যান্সেলররা পদত্যাগ করা শুরু করেন। সেখানে যে নিয়োগগুলো হয়েছে সেগুলোতে কোনো ধরনের রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ ছিল না। আমার যে নিয়োগ হয়েছে, আমার জন্য আমি কারও কাছে তদবির করতে যাইনি। উল্টো আমাকে নিয়োগ দেওয়ার পরে আমি শিক্ষা উপদেষ্টাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, আমাকেই কেন দিলেন? তিনি আমাকে বলেছিলেন, আমরা আপনার ব্যাপারে খোঁজ নিয়েছি, আপনি যোগ্য।

আমাদের রাজনৈতিক সচেতনতা থাকবেই, কিন্তু শিক্ষক হিসেবে প্রকাশ্যে কোনো রাজনীতিতে আমাদের যোগ দেওয়া উচিত না। কারণ আমাদের বিভিন্ন মতাদর্শের শিক্ষার্থী থাকে। তারা যদি মনে করে স্যার ওই দলের, তাহলে তাদের মধ্যে হীনম্মন্যতা সৃষ্টি হবে

আগে যেমন দলীয় লোকজন ছাড়া কাউকে ভিসি নিয়োগ দেওয়া হতো না, এবার কিন্তু যারা রাজনীতিতে অতটা জড়িত না আবার গবেষণা ও পড়াশোনায় ভালো তাদেরই দেওয়া হয়েছে। এই জিনিসটার পরিবর্তন হয়েছে। এরপর আগে নিয়োগের ক্ষেত্রে যেমন তদবির হতো, এখনো তদবির আছে। কিন্তু শিক্ষা উপদেষ্টা আমাকে আমার মতো করেই যোগ্যদের নিয়োগ দিতে বলেছেন। রাজনৈতিক দলের প্রেশার আছে, কিন্তু সরকারের পক্ষ থেকে কোনো প্রেশার নেই। আগে গণরুম, গেস্টরুম ছিল, সেগুলো নেই এখন। সবাই এখন মন খুলে কথা বলে। দলীয় প্রভাব কেউ অতটা দেখানোর সাহস করে না। কারণ বেশিরভাগ ছাত্র এটার বিপক্ষে।

জাগো নিউজ: গণতান্ত্রিক চেতনা সমুন্নত রাখতে শিক্ষকদের কী ধরনের ভূমিকা রাখা উচিত বলে আপনি মনে করেন?

ড. শহীদুল ইসলাম: শিক্ষকদের বলা হয় জাতির মেরুদণ্ড। আমাদের রাজনৈতিক সচেতনতা থাকবেই, কিন্তু শিক্ষক হিসেবে প্রকাশ্যে কোনো রাজনীতিতে আমাদের যোগ দেওয়া উচিত নয়। কারণ আমাদের বিভিন্ন মতাদর্শের শিক্ষার্থী থাকে। তারা যদি মনে করে স্যার ওই দলের, তাহলে তাদের মধ্যে হীনম্মন্যতা সৃষ্টি হবে। এমনটা হলে শিক্ষকদের সম্মানটা কমে যায়।

আমার মতে, আমরা নিজেরা যে আদর্শ ধারণ করি তা আমাদের নিজেদের মধ্যেই রাখা উচিত। তাতে শিক্ষকদের প্রতি ছাত্রদের সম্মান বাড়বে। আমরা শিক্ষার্থীদের উপদেশ দেবো, কিন্তু সেগুলো যদি নিজেরাই না পালন করি তাহলে সেই উপদেশ কোনো কাজে লাগবে না। সরকারের উচিত শিক্ষকরা যাতে স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারে সে ব্যবস্থা নিশ্চিত করা। সে ব্যবস্থা আছে আমাদের, কিন্তু আমাদের মানসিকতার পরিবর্তন দরকার। সামান্য কিছু পরিবর্তন আমাদের এসেছে, এটা যদি আমরা ধরে রাখতে পারি তাহলে আমরা হয়তো ভবিষ্যতে ভালো কিছু করতে পারবো।

এমএইচএ/এএসএ/এমএফএ/এমএস