জাতীয়

একটা অটোরিকশায় সচল হতে পারে জুলাই আহত শাহ আলমের জীবন

একটা অটোরিকশায় সচল হতে পারে জুলাই আহত শাহ আলমের জীবন

শাহ আলম গাজী। পেশায় টাইলস মিস্ত্রি। থাকেন ঢাকার শনির আখড়ায়। প্রতিদিনই কাজে যান। অভাবের সংসার আন্দোলন-সংগ্রাম মানে না। গত বছরের জুলাই মাসেও কাজে যেতেন। তখন লোকমুখে কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনের গল্প শুনেছেন। কিন্তু কর্ণপাত করার ফুরসত ছিল না।

Advertisement

আর ১০ দিনের মতো ১৯ জুলাই সন্ধ্যায় কাজ শেষে রায়েরবাগ থেকে বাসায় ফিরছিলেন শাহ আলম গাজী। পথে আন্দোলনকারীদের ওপর মুহুর্মুহু গুলি ছুড়তে দেখেন পুলিশকে। তার বিশ্বাস ছিল তিনি তো আন্দোলনকারী নন, দিনমজুর। তাকে পুলিশ গুলি করবে না। তাই রাস্তার পাশ ধরে হাঁটা দেন। কিন্তু না, তাকে লক্ষ্য করেও গুলি ছুড়ে পুলিশ। লুটিয়ে পড়েন সড়কে। কিছু বুঝে ওঠার আগেই রক্তাক্ত শরীর দেখে আঁতকে উঠেন।

এরপর স্থানীয়রা ধরাধরি করে শাহ আলম গাজীকে প্রথমে মিটফোর্ড হাসপাতাল, পরে ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে নেন। অভিভাবক না থাকায় সিদ্ধান্তের অভাবে অস্ত্রোপচার করেননি চিকিৎসক। পড়ে থাকেন হাসপাতালের বেডে। পরদিন পরিবার আসে। কিন্তু ততক্ষণে বেশ ক্ষতি হয়ে যায়। তার বাঁ পা কেটে ফেলতে হয়।

আন্দোলনকারী না হয়েও পুলিশের মারমুখী ও অপেশাদার আচরণে পঙ্গুত্বের ক্ষতের পাশাপাশি মানসিক ট্রমা এখনো বয়ে বেড়াচ্ছেন শাহ আলম গাজী। সম্প্রতি জাগো নিউজের সঙ্গে আলাপকালে তিনি জানান, চাঁদপুর জেলার পুরান বাজারে তার স্থায়ী নিবাস। জীবিকার প্রয়োজনে ঢাকায় এসে এভাবে পঙ্গু হয়ে যাবেন ভাবতেই পারেননি।

Advertisement

আরও পড়ুন জুলাই বিপ্লবে আহত আরও ৬ জন যাচ্ছেন ব্যাংকক অভ্যুত্থানে নিহতরা জুলাই শহীদ, আহতরা জুলাই যোদ্ধা জুলাই গণঅভ্যুত্থানে আহতদের চিকিৎসায় ১৫০ কোটি টাকা অনুদান আরও ৭৭২ জন ‘জুলাই যোদ্ধা’র তালিকার গেজেট প্রকাশ

শাহ আলম গাজী বলেন, কাজ থেকে ফেরার পথে ১৯ জুলাই সন্ধ্যায় গুলিবিদ্ধ হই রায়েরবাগে। বাঁ পায়ের হাঁটুর ওপরে গুলি লেগে রগ কেটে মাংস পেশি ছিদ্র হয়ে গেছে। প্রথমে মিটফোর্ড হাসপাতালে নেওয়া হয়। তারা বলছে, গুলি বের হয়ে গেছে। রগ ছিঁড়ে গেছে। ঢাকা মেডিকেলে নিতে হবে। চিকিৎসা দেয়নি। রাত ১টায় সেখান থেকে ঢামেকে নেওয়া হয়। তারাও চিকিৎসা দেয়নি, ফেলে রাখছে। অভিভাবক না পাওয়ায় ঢাকা মেডিকেলের চিকিৎসকরা কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারেননি। পরদিন দুপুর ২টায় অভিভাবক আসে। অভিভাবক স্বাক্ষর দেওয়ার পর চিকিৎসা শুরু হয়। ততক্ষণে পায়ে পচন ধরেছে। তখন ধানমন্ডি পাঠিয়েছে, চেক করার জন্য পায়ে বোধ আছে কি না। কিন্তু বোধ পায়নি। পরে ফের ঢামেকে পা কেটে ফেলার সিদ্ধান্ত হয়। ২১ জুলাই পা কেটে ফেলা হয়।

পারিবারিক সঞ্চয় ও সবার সহযোগিতায় চিকিৎসা করেন শাহ আলম গাজী। প্রায় তিন লাখ ৮০ হাজার খরচ হয়েছে তার। ডান পা থাকলেও বাঁ পা ছাড়া তো প্রায় অচল জীবন। এই অচল জীবন কিছুটা সচল করেছে ব্র্যাক লিম্ব অ্যান্ড ব্রেস সেন্টার। তারা প্রায় সাড়ে আট লাখ টাকা মূল্যের একটি কৃত্রিম পা বিনামূল্যে লাগিয়ে দিয়েছে। এখন মোটামুটি হাঁটাচলা করতে পারেন শাহ আলম গাজী। তবে এ অবস্থায় ভারী কাজ করা সম্ভব নয়। বিশেষ করে, তার আগের টাইলসের কাজ করা যাবে না।

বন্ধ হয়ে গেছে সন্তানের পড়াশোনা

স্ত্রী-সন্তানসহ চার সদস্যের পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ছিলেন শাহ আলম গাজী। তার আহত হওয়ার পর ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ুয়া ছেলের পড়ালেখা বন্ধ। এখন একটা মুদি দোকানে কাজে দিয়েছেন। সাত হাজার টাকা বেতন। ছোট ছেলেটাকে দ্বিতীয় শ্রেণিতে ভর্তি করিয়ে দিয়েছেন তার মামা।

শাহ আলম গাজী বলেন, ‘আমার মাসে আয় ছিল ৫০-৬০ হাজার টাকা। টাইলসের কাজে দৈনিক এক হাজার টাকা হাজিরা ছিল। পাশাপাশি সর্দারি করে আরও কিছু আসতো। ছেলেদের পড়াশোনা এবং পরিবারের খরচ চলতো। এখন তো মোটেও আয় নেই। আত্মীয়-স্বজনরা কিছু সহযোগিতা করেন। জীবন তো চলার কথা নয়, আল্লাহ জানে কীভাবে চলে! বাসা ভাড়া দেওয়া, সন্তানদের পড়াশোনা, বাজার খরচ বিশাল চাপ। এরমধ্যে আমার চিকিৎসা। কোনো কূলকিনারা নাই।’

Advertisement

আরও পড়ুন উন্নত চিকিৎসার জন্য তুরস্কে গেলেন ৭ জুলাই আহত জুলাই বিপ্লবে আহত ১৮ ছাত্র-জনতাকে বিজিবির সহায়তা আন্দোলনে নিহতরা ‘জুলাই শহীদ’, আহতরা ‘জুলাইযোদ্ধা’র পরিচিতি পাবেন জুলাই বিপ্লবে আহত আরও ৭ জনকে পাঠানো হলো ব্যাংককে কোনো সরকারি অনুদান মেলেনি

সরকারি সহযোগিতার বিষয়ে জানতে চাইলে শাহ আলম গাজী বলেন, ‘জুলাই ফাউন্ডেশন থেকে এক লাখ টাকা পাইছি। দ্বিতীয় বার কাগজ জমা দিছি। অগ্রগতি নাই। আমি কোন ক্যাটাগরিতে জানি না। স্বাস্থ্য কার্ডের কথা শুনেছি। কিন্তু আমার স্বাস্থ্য কার্ড হয়নি।’

জীবন চালাতে প্রয়োজন সহযোগিতা

জীবনের পরিকল্পনা জানতে চাইলে শাহ আলম গাজী বলেন, ‘যা ক্ষতি হয়ে গেছে, এটা তো ফিরে পাওয়া সম্ভব না। তবে এখন সুস্থ আছি। বেঁচে থাকার জন্য তো কিছু একটা করতে হবে। একটা অটোরিকশা পাইলে চালাতে পারবো। অথবা দোকান করে দিলে ব্যবসা করতে পারবো।’

আরও পড়ুন প্রতারণা করে জুলাই অভ্যুত্থানের সুবিধা নিলে ২ বছরের কারাদণ্ড আরও ১২৪২ জন ‘জুলাই যোদ্ধা’র তালিকার গেজেট প্রকাশ স্কুলে ভর্তিতে ৫% কোটা পাবে অভ্যুত্থানে আহত-নিহতদের সন্তানরা জুলাই-আগস্টের আহত যোদ্ধাদের দেওয়া হবে ইউনিক আইডি কার্ড

শুধু শাহ আলম নন, ১৯ জুলাই গণঅভ্যুত্থানের উত্তাল দিনটিতে ১৪৮ জন মারা যান। আহত হন শাহ আলমের মতো হাজার হাজার নাগরিক।

ইন্টারন্যাশনাল ট্রুথ অ্যান্ড জাস্টিস প্রজেক্ট (আইটিজেপি) এবং টেক গ্লোবাল ইনস্টিটিউটের (টিজিআই) ‘ব্লাডশেড ইন বাংলাদেশ’ শীর্ষক একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে ২০২৪ সালের ১৯ জুলাই একদিনেই নিহত হন ১৪৮ জন। এর মধ্যে ৫৪ জনকে মাথায় বা গলায় গুলি করা হয়েছিল। অধিকাংশেরই বয়স ৪০ বছরের মধ্যে। হতাহতের মাত্রা এত বেশি ছিল যে ঢাকায় একটি হাসপাতালে আক্ষরিক অর্থে গজ এবং ব্যান্ডেজ ফুরিয়ে যায়। ঢাকা একটি যুদ্ধক্ষেত্রের মতো হয়ে ওঠে।

কৃত্রিম পা ও ব্রেসের জন্য ব্র্যাকে যোগাযোগ করুন

২০২৪ সালের আগস্ট থেকে সক্রিয়ভাবে কাজ করছে ব্র্যাক লিম্ব অ্যান্ড ব্রেস সেন্টার (বিএলবিসি)। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, নিটোরসহ দেশের ১৪টির বেশি হাসপাতালে আহতদের শনাক্ত করে সেখান থেকে রোগীদের নিয়ে এসে কাজ করছে বিএলবিসি। এ পর্যন্ত সম্পূর্ণ বিনামূল্যে উন্নতমানের কৃত্রিম অঙ্গ সংযোজন করা হয়েছে ৩৪ জনের শরীরে, চিকিৎসাসেবা দেওয়া হয়েছে আরও ১৮৪ জনকে। আগামী পাঁচ বছর বিনামূল্যে এই সেবা দেবে বিএলবিসি। শুধু কৃত্রিম অঙ্গ প্রতিস্থাপন বা ব্রেস প্রদান নয়, ২৫০ জন আহতকে চিকিৎসা ও পুনর্বাসনের সহায়তাও দেবে বিএলবিসি। এছাড়া জুলাই গণঅভ্যুত্থানে আহত ৪১৬ জনকে প্রাথমিকভাবে ২৫ হাজার টাকা করে আর্থিক সহায়তা দেওয়া হয়েছে। এই পুরো উদ্যোগের বাজেট ১২ কোটি টাকা, যা ব্র্যাক ব্যাংক, অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশ (এবিবি) এবং কিছু ব্যক্তিগত দাতার সহায়তায় চলছে।

আরও পড়ুন পুলিশ ৬টা গুলি করে, এরপর ৩ তলায় পড়ে যাই কার্নিশে ঝুলে থাকা তরুণকে গুলি, এসআই গ্রেফতার জুলাই গণঅভ্যুত্থানে শহীদ পরিবার-আহতদের জন্য ৪০৫ কোটি বরাদ্দ জুলাই বিপ্লবে আহত ১০০ জন পাচ্ছেন সরকারি চাকরি

ব্র্যাকের স্বাস্থ্য কর্মসূচির প্রধান ডা. শাহিনুল হক রিপন জাগো নিউজকে বলেন, ‘এ সহায়তা কর্মসূচি আগস্ট ২০২৯ পর্যন্ত চলবে। এর মধ্যে যে কেউ এই কর্মসূচির অংশ হতে পারবেন।’

এসইউজে/এমএমএআর/এমএফএ/এএসএম