দেশের অন্যতম প্রাচীন জমিদার বাড়ি হচ্ছে টাঙ্গাইলের ধনবাড়ীর। স্থানীয়দের কাছে ‘নবাব প্যালেস’ বা ‘নবাব মঞ্জিল’ নামে বেশি পরিচিত। কালের স্রোতে এখন আর জমিদারি প্রথা ও জমিদার নেই। কিন্তু চুন-সুরকির নবাব প্যালেস ঐশ্বর্যে ও ঐতিহ্যে ঠিকই আজও মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে। জমিদার বাড়ির শতবর্ষী পুরোনো দেয়ালগুলো আমাদের ইতিহাস আর কালের সাক্ষী। ক্ষয়ে পড়া চুন-সুরকির আস্তরণগুলোয় লুকিয়ে আছে ঐশ্বর্যময় ঐতিহ্য। জমিদারের বিলাসী প্রাসাদে কারুকার্যখচিত ভবনের সমারোহ। ভবনের দেওয়ালের পরতে পরতে সৌন্দর্যের ছোঁয়া। প্রতিদিন দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে ভ্রমণপিয়াসী ও ইতিহাসপ্রেমীরা জমিদার বাড়ি দেখতে ভিড় করছেন। বিশেষ করে শীত মৌসুমের পুরোটাই ভ্রমণপিপাসুদের পদচারণা থাকে।
Advertisement
১৮০০ শতকের মাঝামাঝি জমিদার বাড়িটি প্রতিষ্ঠা করেন খান বাহাদুর সৈয়দ নওয়াব আলী চৌধুরী। তিনি ছিলেন ঢাকা বিশ্বদ্যিালয়ের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা, রাষ্ট্রভাষা বাংলা করার প্রথম প্রস্তাবক এবং ব্রিটিশ সরকারের প্রথম মুসলিম মন্ত্রী। এ জমিদার বাড়ির রয়েছে একটি সুদীর্ঘ ইতিহাস। ধারণা করা হয়, মুঘল সম্রাট জাহাঙ্গীরের আমলে ধনপতি সিংহকে পরাজিত করে সেনাপতি ইস্পিঞ্জর খাঁ ও মনোয়ার খাঁ ধনবাড়ীতে জমিদারি প্রতিষ্ঠা করেন। তাঁদের কয়েক পুরুষ পরের নবাব ছিলেন সৈয়দ জনাব আলী। সৈয়দ জনাব আলী ছিলেন সৈয়দ নওয়াব আলী চৌধুরীর বাবা। নবাব সৈয়দ নওয়াব আলী চৌধুরী বিয়ে করেন বগুড়ার নবাব আবদুস সোবহানের মেয়ে আলতাফুন্নাহারকে।
আলতাফুন্নাহার ছিলেন নিঃসন্তান। তাঁর মৃত্যুর পর নবাব বিয়ে করেন ঈশা খাঁর শেষ বংশধর সৈয়দা আখতার খাতুনকে। নওয়াব আলী চৌধুরীর তৃতীয় স্ত্রীর নাম ছিল সকিনা খাতুন। নওয়াব আলী চৌধুরী ১৯২৯ সালে মৃত্যুবরণ করেন। নবাব ওয়াকফনামায় তাঁর তৃতীয় স্ত্রীর একমাত্র ছেলে সৈয়দ হাসান আলী চৌধুরী এবং মেয়ে উম্মে ফাতেমা হুমায়রা খাতুনের নাম উল্লেখ করে যান। সৈয়দ হাসান আলী চৌধুরী পরবর্তীকালে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের শিল্পমন্ত্রী নির্বাচিত হন। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭৮ সালেও তিনি সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৮১ সালে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। জমিদার বাড়ির বর্তমান উত্তরাধিকারী তাঁর একমাত্র সন্তান সৈয়দা আশিকা আকবর। তার ছেলে আফিফ উদ্দিন আহমাদ বর্তমানে এটি দেখাশোনা করছেন।
১৭ একর জমির ওপর স্থাপিত অপূর্ব স্থাপত্যকর্মের কারণে ক্রমেই জমিদার বাড়িটি পরিণত হতে থাকে পর্যটকদের জন্য আকর্ষণীয় স্থানে। তাই নবাবের উত্তরাধিকারীরা জমিদার বাড়িতে গড়ে তোলেন পিকনিক স্পট। যা নবাব সৈয়দ হাসান আলী রয়্যাল রিসোর্ট হিসেবে বেশ খ্যাতি লাভ করেছে। তবে রিসোর্ট তৈরির পর নবাব প্যালেসে বেড়েছে চাকচিক্য এবং আধুনিকতা। ১৪ গম্বুজবিশিষ্ট অপূর্ব মুঘল স্থাপত্যরীতিতে তৈরি এ শতাব্দী প্রাচীন নবাব প্যালেস। পুরো নবাব মঞ্জিল বা নবাব প্যালেসটি প্রাচীরে ঘেরা। প্রাসাদটি দক্ষিণমুখী এবং দীর্ঘ বারান্দা সংবলিত। ভবনের পূর্বদিকে বড় একটি তোরণ রয়েছে।
Advertisement
তোরণটি জমিদার নওয়াব আলী চৌধুরী ব্রিটিশ গভর্নরকে অভ্যর্থনা জানানোর জন্য নির্মাণ করেন। প্রাচীরঘেরা চত্বর অংশে আবাসিক ভবন দুটি ছাড়া আরও আছে ফুলের বাগান, বৈঠকখানা, নায়েবঘর, কাচারিঘর, পাইকপেয়াদা বসতি এবং দাস-দাসি চত্বর। প্যালেসটির পাশেই রয়েছে ৩০ বিঘার বিশালাকার দিঘি। দিঘিতে সুন্দর ও মনোরম শান বাঁধানো ঘাট রয়েছে। ইচ্ছে করলে সৌখিন ভ্রমণপ্রেমীরা এখানে নৌকা ভ্রমণ ও মাছ ধরতে পারেন। আরেকটি আকর্ষণ নবাব মসজিদ। স্থানীয়রা জানান, জমিদার বাড়ির ঠিক পাশেই রয়েছে প্রায় ৭শ বছরের পুরোনো একটি মসজিদ। মুঘল স্থাপত্যের নিদর্শন এ মসজিদের মোজাইকগুলো এবং মেঝেতে মার্বেল পাথরে নিপুণ কারুকার্য অসাধারণ। পুরোনো মসজিদটি দেড়শ বছর আগে সংস্কার করে নবাব পরিবার।
আরও পড়ুন
নেত্রকোনায় চন্দ্রডিঙ্গার ছায়ায় একদিন মাদারীপুরের ‘খালিয়া’ হতে পারে পর্যটন এলাকাসরেজমিনে জানা যায়, ১০০ টাকায় টিকিট কেটে ভেতরে প্রবেশ করামাত্রই চোখে পড়বে নয়নাভিরাম সবুজ-শোভিত বাগান। বাগানে বিভিন্ন প্রজাতির গাছ রয়েছে। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে পর্যটকেরা এটি দেখতে ভিড় করছেন। অনেককেই পরিবার-পরিজন নিয়ে আসতে দেখা গেছে। সিরাজগঞ্জ থেকে আসা দর্শনার্থী নাঈম হোসেন জাগো নিউজকে বলেন, ‘সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে জমিদার বাড়ি অনেক দেখেছি। আজকে প্রথম ধনবাড়ী জমিদার বাড়ি দেখতে এসেছি। জমিদার বাড়ি দেখে আমার খুব ভালো লেগেছে। ছবি থেকেও সুন্দর জমিদার বাড়ি।’
গাজীপুর থেকে আসা দর্শনার্থী শাহেদ জাগো নিউজকে বলেন, ‘ইউটিউব দেখে আমি বন্ধুদের সাথে জমিদার বাড়ি দেখতে এসেছি। এখানে ঘোরার মতো অনেক জায়গা আছে। ভেতরের পরিবেশ অনেক ভালো। এখানে এলে যে কারও ভালো লাগবে। পরবর্তীতে আমি পরিবার নিয়ে ঘুরতে আসবো।’
Advertisement
নবাব বাড়ির কেয়ারটেকার মোহাম্মদ ইছাক জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমি ৫০ বছর ধরে এটি দেখাশোনা করছি। এতে আমার খুব ভালো লাগে। বৃহস্পতিবার, শুক্রবার ও শনিবার সমাগম বেশি হয়।’
ধনবাড়ী জমিদার বাড়ির ম্যানেজার শরীফ উদ্দিন জাগো নিউজকে বলেন, ‘এ ঐতিহ্য আমাদের টাঙ্গাইল তথা সারাদেশের জন্য গর্বের। আমরা চেষ্টা করি স্থাপনাগুলো তরুণ প্রজন্মের মধ্যে তুলে ধরার জন্য। জমিদার বাড়ির পাশেই আছে ৬ গম্বুজ বিশিষ্ট জমিদারের থাকার বাসভবন। সুন্দর কারুকাজের মাধ্যমে ঐতিহ্যগুলো তুলে ধরা হয়েছে। এটি ব্যক্তি মালিকানায় পরিচালিত হচ্ছে। এটি প্রায় ২শ বছরের পুরোনো।
যাতায়াত ব্যবস্থারাজধানীর মহাখালী থেকে ঢাকা-ধনবাড়ী সরাসরি বাস সার্ভিস চালু আছে। বিনিময়, মহানগর কিংবা শুভেচ্ছা পরিবহনে পৌঁছাতে পারবেন ধনবাড়ী। এ ছাড়া আজমপুর, আবদুল্লাহপুর ও সায়েদাবাদ থেকেও বিভিন্ন পরিবহনের বাসে চড়ে যাওয়া যাবে। ধনবাড়ী বাসস্ট্যান্ড থেকে অদূরেই জমিদার বাড়ি। ইচ্ছে করলে হেঁটে কিংবা রিকশায় পৌঁছাতে পারবেন সেখানে।
থাকার ব্যবস্থাজমিদার বাড়িতে আছে তিন ধরনের আবাসনব্যবস্থা। প্যালেস (কাচারিঘর), ভিলা (২শ বছরের পুরোনো টিনশেড ভবন) এবং কটেজ (সম্প্রতি নির্মিত টিনশেড বাংলো)। প্যালেসের খাট, সোফাসহ সব আসবাবপত্র সেই প্রাচীন আমলের। যা নবাবরা ব্যবহার করতেন। কিন্তু ভিলা এবং কটেজে নবাবদের আসবাবপত্র পাওয়া যাবে না। ভাড়া দুই থেকে পাঁচ হাজার টাকা। ফলে এখানে থাকবেন আপনি নবাবি স্টাইলে।
এসইউ/এমএস