সানজানা রহমান যুথী
Advertisement
তীব্র গরম থেকে রক্ষা পেতে অনেকেই এসি ব্যবহার করেন। ভালো কোম্পানির এসি ব্যবহার করলে প্রাকৃতিক বাতাসের মতো আরাম পাওয়া যায়। কিন্তু সমস্যা বাধে এসি পরিষ্কার করতে। অনেকেই এসি পরিষ্কার করার ভয়ে এসি কিনতে চান না।
নগরবাসীর জন্য এসি একটি স্বস্তি নাম হলেও এসি পরিষ্কার করতেও পোহাতে হয় নানা ঝামেলা। এর অন্যতম কারণ হলো সঠিক উপায়ে এসি পরিষ্কার করতে না পারা। আবার অনেকেই খরচের জন্য দক্ষ লোক দিয়ে এসি পরিষ্কার করাতে চান না। তবে কিছু সহজ উপায়ে নিজেই বাড়িতে এসি পরিষ্কার করতে পারবেন।
চলুন জেনে নেওয়া যাক কীভাবে বাড়িতে নিজের এসি পরিষ্কার করবেন-
Advertisement
১. বিদ্যুৎ সংযোগ বন্ধ করুন এয়ার কন্ডিশনার পরিষ্কারের আগে অবশ্যই সেটির বিদ্যুৎ সংযোগ বন্ধ করতে হবে। এজন্য আপনার বাড়ির সার্কিট ব্রেকার বা নির্দিষ্ট পাওয়ার সোর্সে গিয়ে স্প্লিট এসি ইউনিটের বিদ্যুৎ সংযোগ সম্পূর্ণভাবে বন্ধ করুন। বিদ্যুৎ সংযোগ চালু অবস্থায় কখনো এয়ার কন্ডিশনারের ঢাকনা খোলা উচিত নয় এটি বিপজ্জনক হতে পারে।
বিদ্যুৎ বন্ধ করার পর, এসির সামনের প্যানেলটি খুলে নিন। ইউনিটের সামনের অংশে সাধারণত হুক থাকে, সেগুলো সাবধানে খুলে সামনের প্যানেলটি ধীরে ধীরে ওপরে তুলুন। এতে আপনি সহজেই এয়ার কন্ডিশনারের অভ্যন্তরীণ অংশ ভালোভাবে পরিষ্কার করতে পারবেন।
তবে মাথায় রাখবেন যে, বেশিরভাগ স্প্লিট এসি ইউনিটে একটি ইনডোর (ঘরের ভেতরের) এবং একটি আউটডোর (ঘরের বাইরের) অংশ থাকে। তাই শুধু ইনডোর ইউনিটের বিদ্যুৎ বন্ধ করলেই চলবে না পুরো কুলিং সিস্টেমের বিদ্যুৎ সংযোগ সম্পূর্ণভাবে বন্ধ করে নিশ্চিত করুন যে আপনি নিরাপদ অবস্থানে আছেন।
২. স্প্লিট এয়ার কন্ডিশনার ক্লিনিং ব্যাগ ব্যবহার করুন স্প্লিট এয়ার কন্ডিশনার পরিষ্কারের সময় ময়লা যেন ছড়িয়ে না পড়ে, সেজন্য স্প্লিট এয়ার কন্ডিশনার ক্লিনিং ব্যাগ ব্যবহার করুন। এরপর এসির পুরো ইউনিটটি ক্লিনিং ব্যাগ দিয়ে ঢেকে দিন। নতুন একটি ক্লিনিং ব্যাগ দিয়ে এয়ার কন্ডিশনারের চারপাশ ঘিরে ফেলুন, যাতে পরিষ্কার করার সময় কোনো ধুলাবালি বা ময়লা মেঝেতে না পড়ে। আপনি এই ধরনের ব্যাগ অনলাইনে খুবই কম দামে সহজেই কিনতে পারবেন ।
Advertisement
পরিষ্কারের ব্যাগ কেনার সময় চেষ্টা করুন এমন একটি ব্যাগ নিতে যার চারপাশে একটি সিঞ্চ স্ট্র্যাপ থাকে যার মাধ্যমে ব্যাগের মুখ সহজেই ঢিলা বা টাইট করা যায়। এতে ব্যাগটি ইউনিটের সঙ্গে ভালোভাবে ফিট হবে এবং ময়লা বাইরে পড়ার ঝুঁকি কমে যাবে।
যদি আপনার কাছে বিশেষ কোনো ক্লিনিং ব্যাগ না থাকে, তাহলে বিকল্প হিসেব বড় মোটা পলিথিনও ব্যবহার করতে পারেন। এটি সাশ্রয়ী এবং কাজেও কার্যকর হতে পারে । তবে শুধু নিশ্চিত করুন যেন সেটি এয়ার কন্ডিশনারের নিচের অংশ এবং পাশগুলো ভালোভাবে ঢেকে দেয়। এভাবে একটু পরিকল্পনা ও সতর্কতায় এয়ার কন্ডিশনার পরিষ্কার করাটাই হবে সহজ, সুরক্ষিত ও ঝামেলাবিহীন।
৩. স্প্লিট এয়ার কন্ডিশনারের এয়ার ফিল্টারগুলো খুলে ফেলুনএয়ার ফিল্টারগুলো সাধারণত ইউনিটের সামনের দিকে লম্বা আয়তাকার আকারে বসানো থাকে। এগুলো নিয়মিত খুলে ধুয়ে পরিষ্কার করা জরুরি, না হলে এসির কার্যক্ষমতা কমে যায় এবং বাতাসে ধুলাবালি মিশে যায়।
প্রতিটি ফিল্টারের পাশে একটি ছোট ট্যাব বা বোতাম থাকে। সেটি হালকা চাপ দিয়ে ফিল্টারগুলো আলগা করে সাবধানে খুলে ফেলুন। খুলে নেওয়ার পর প্রথমে ফিল্টারগুলো বাইরে নিয়ে গিয়ে ভালোভাবে ঝেড়ে নিন, যাতে উপরিভাগের ধুলাবালি ও ময়লা আগে থেকেই সরে যায়। তারপর ধীরে ধীরে পরিষ্কারের কাজ শুরু করুন।
যদি আপনার স্প্লিট এসিতে কোনো স্পষ্ট ট্যাব বা বোতাম না থাকে যেটি চেপে ফিল্টার খোলা যায়, তাহলে ইউনিটের ম্যানুফ্যাকচারার গাইড বা ব্যবহারবিধি দেখে নিন। অনেক সময় মডেল ভেদে খুলে ফেলার পদ্ধতি ভিন্ন হতে পারে।
৪. খোলা ফিল্টারগুলোকে পরিষ্কার পানি দিয়ে ধুয়ে নিন। যদি আপনার ফিল্টারগুলো খুব একটা ময়লা না হয়ে থাকে, তাহলে শুধু পানি দিয়ে ধুয়ে ফেললেই ধুলাবালি উঠে যাবে। তবে যদি ধুলা বা তেলযুক্ত ময়লা জমে থাকে এবং কেবল পানি দিয়ে পরিষ্কার না হয়, তাহলে একটি নরম স্পঞ্জ বা ক্লিনিং প্যাড ব্যবহার করুন।
হালকা কোনো ক্লিনিং ডিটারজেন্ট (যেমন মাইল্ড লিকুইড সাবান) ফিল্টারের ওপর লাগিয়ে খুবই ধীরে ধীরে ঘষুন। অতিরিক্ত চাপ প্রয়োগ করবেন না, কারণ ফিল্টারের সূক্ষ্ম জাল নষ্ট হয়ে যেতে পারে। এরপর ভালোভাবে আবার পানি দিয়ে ধুয়ে নিন যেন কোনো সাবানের গন্ধ বা অবশিষ্টাংশ না থাকে।
পরিষ্কার হয়ে গেলে ফিল্টারগুলো একটি শুকনো ও বাতাস চলাচল করে এমন জায়গায় রেখে দিন যেন সেগুলো প্রাকৃতিকভাবে শুকিয়ে যায়। কখনোই সরাসরি রোদে বা হেয়ার ড্রায়ার দিয়ে শুকানোর চেষ্টা করবেন না এতে ফিল্টারের গঠন ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে।
তবে স্মরণে রাখবেন, বিশুদ্ধ বাতাস নিশ্চিত করতে প্রতি দুই মাস অন্তর অন্তর ফিল্টার পরিষ্কার করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। নিয়মিত এই অভ্যাস আপনাকে দেবে স্বাস্থ্যকর পরিবেশ ও দীর্ঘস্থায়ী এয়ার কন্ডিশনারের নিশ্চয়তা।
৫. কুলিং ফিন পরিষ্কার করুনএ কাজের জন্য একটি পাতলা ক্যানিস্টার অ্যাটাচমেন্টসহ এয়ার ব্লোয়ার ব্যবহার করুন। ব্লোয়ারটি চালু করে স্প্লিট এসির পেছনের দিকে, যেখানে কুলিং ফিনগুলো থাকে, সেখানে ধীরে ধীরে বাতাস প্রবাহ করুন।
কুলিং ফিন দেখতে অনেকটা পাতলা ধাতব রেখার মতো, যেগুলো একে অপরের খুব কাছে সজ্জিত থাকে। এই ফিনগুলোর মাধ্যমে ঠান্ডা বাতাস তৈরি হয়, তাই সেগুলো পরিষ্কার রাখা অত্যন্ত জরুরি। এয়ার ব্লোয়ার দিয়ে পুরো ফিনের ওপর সমানভাবে বাতাস ছড়িয়ে দিন, যেন প্রতিটি ফাঁকফোকর থেকে ধুলা-ময়লা বেরিয়ে আসে।
যদি আপনার কাছে এয়ার ব্লোয়ার না থাকে, তবে একটি নরম ব্রাশ বা ক্যানিস্টার ভ্যাকুয়মের অ্যাটাচমেন্ট ব্যবহার করেও ধুলা পরিষ্কার করা যায়। তবে যেটিই ব্যবহার করুন না কেন, অবশ্যই সাবধানে করতে হবে কারণ কুলিং ফিনগুলো খুবই পাতলা ও নাজুক, যা সামান্য চাপেও বেঁকে যেতে পারে।
৬. কয়েল পরিষ্কার করতে ব্যবহার করুন নো-রিন্স ইভাপোরেটর স্প্রেএয়ার কন্ডিশনারের কয়েল পরিষ্কার করতে একটি নো-রিন্স ইভাপোরেটর ক্লিনার স্প্রে কিনে আনুন এবং এটি কয়েলগুলোর উপর স্প্রে করুন। কয়েল সাধারণত এয়ার কন্ডিশনারের ইনডোর ইউনিটের মাঝ বরাবর অবস্থান করে এগুলো দেখতে গোলাকার ধাতব অংশের সারি বা মোচড়ানো পাইপের মতো, যা একে অপরের সঙ্গে সংযুক্ত থাকে।
স্প্রে করার পর অন্তত ২০ মিনিট অপেক্ষা করুন, যাতে ক্লিনারটি ধুলা, ময়লা ও জীবাণুগুলোকে ভেঙে ফেলতে পারে এবং শুকিয়ে যায়। এই ক্লিনারের বিশেষত্ব হলো এটি ধোয়ার প্রয়োজন পড়ে না, অর্থাৎ স্প্রে করলেই পরিষ্কারের কাজ সম্পন্ন হয়। নো-রিন্স ইভাপোরেটর ক্লিনার আপনি অনলাইনেই সহজে কিনে নিতে পারেন। তবে খেয়াল রাখবেন, স্প্রে করার সময় ইউনিটটি অবশ্যই বন্ধ ও ঠান্ডা থাকতে হবে।
৭. কয়েলের উপর অ্যান্টিফাঙ্গাল ক্লিনার স্প্রে করুনঅ্যান্টিফাঙ্গাল ক্লিনার স্প্রে একটি বিশেষ ধরনের ক্লিনিং স্প্রে, যা আপনার এসির অভ্যন্তরে ছত্রাক, টক্সিন এবং ক্ষতিকর জীবাণু জন্মাতে বাধা দেয়। স্প্রে করার সময় বিশেষ করে এয়ার কন্ডিশনারের পেছনের অংশে ভালোভাবে প্রয়োগ করুণ। কারণ এ জায়গাগুলোতেই ছত্রাক ও জীবাণু সবচেয়ে বেশি জমে ওঠে।
স্প্রে করার পর অন্তত ৫ মিনিট সময় দিন, যাতে ক্লিনারটি ঠিকভাবে কাজ করতে পারে। এই সময়ের মধ্যে ক্লিনারটি ছত্রাকের বীজ ও জীবাণুগুলোকে ধ্বংস করবে এবং একটি সুরক্ষিত স্তর তৈরি করবে। যখন স্প্রে সম্পূর্ণ শুকিয়ে যাবে, তখন আপনি এয়ার ফিল্টারগুলো আবার ইউনিটে বসাতে পারেন।
যদি স্থানীয় হার্ডওয়্যার দোকানে এই অ্যান্টিফাঙ্গাল স্প্রে না পান, তাহলে অনলাইন মার্কেটপ্লেসে খুঁজে দেখতে পারেন । অ্যান্টিফাঙ্গাল ক্লিনার স্প্রে ব্যবহার করা বাধ্যতামূলক নয় তবে ঘরের পরিবেশ ভালো রাখতে এসিতে অ্যান্টিফাঙ্গাল ক্লিনার ব্যবহার করতে পারেন।
৮. এয়ার কন্ডিশনারের ড্রেন লাইন পরিষ্কার করুনএয়ার কন্ডিশনারের ড্রেন লাইনে যেকোনো ময়লা বা ক্লগ জমে থাকলে তা দূর করুন। স্প্লিট এসি’র ইনডোর এবং আউটডোর ইউনিটের মাঝে সংযুক্ত থাকা পাইপ খুলে ফেলুন, যাতে ড্রেন লাইনটি ভালোভাবে পরিষ্কার করা যায়।
এরপর একটি প্রেশারাইজড ফ্লাশ কিট ( এটি এমন একটি যন্ত্র, যার মাধ্যমে জোরে পানি বা পরিষ্কারক তরল ড্রেন লাইনের ভিতর প্রবাহিত করা যায় ) ব্যবহার করুন। এটি চাপযুক্ত প্রবাহ জমে থাকা ময়লা ও জীবাণু বের করে দেয়, ড্রেন লাইনকে করে তোলে অবরোধমুক্ত ও কার্যকর।
পরিষ্কারের পর ড্রেন লাইনকে অন্তত ১ ঘণ্টা বাতাসে শুকাতে দিন, যেন ভেতরে কোনো পানি বা ক্লিনিং সলিউশন থেকে না যায়। পুরোপুরি শুকিয়ে গেলে পুনরায় পাইপটি ইনডোর ও আউটডোর ইউনিটের মধ্যে ভালোভাবে সংযুক্ত করে দিন।
প্রয়োজনে আপনি দুই দিক থেকেই পানি বা ক্লিনার ঢেলে ড্রেন লাইন ফ্লাশ করতে পারেন, এতে জমে থাকা ময়লা আরও ভালোভাবে পরিষ্কার হবে। এই ফ্লাশ কিট অনলাইনেই সহজে পাওয়া যায় যেখানে প্রেশারাইজড নোজলসহ পুরো সেট থাকে।
ড্রেন লাইন পরিষ্কার রাখা খুবই গুরুত্বপূর্ণ, কারণ এই অংশে ময়লা জমে গেলে পানি জমে গিয়ে এসি থেকে পানি চুইয়ে পড়া, দুর্গন্ধ, এমনকি ইউনিটের কর্মক্ষমতা হ্রাস পেতে পারে। তাই নিয়মিত সময় পেলেই ড্রেন লাইন অন্তত কয়েকদিন পর পর পরিষ্কার করুন।
৯. পুনরায় এসি সেট করুন এয়ার ফিল্টারগুলো সম্পূর্ণ পরিষ্কার ও শুকিয়ে গেলে সেগুলো আবার আগের জায়গায় ঠিকভাবে বসিয়ে দিন। প্রতিটি ফিল্টার সাবধানে স্লটে স্লাইড করে ঢুকিয়ে দিন-সাধারণত এগুলো খুব সহজেই তাদের নির্ধারিত স্থানে বসে যায়। তবে যদি কোনো সমস্যা হয় বা বুঝতে অসুবিধা হয়, তাহলে আপনার এসি যে কোম্পানি থেকে কিনেছেন সেই কোম্পানির ওয়েবসাইটে নির্দেশিকা দেখে এসি সেট করে নিন। সেখানে প্রতিটি ধাপ বিস্তারিতভাবে উল্লেখ থাকবে। ১০. সবকিছু পরিষ্কার ও সেটআপ শেষ হলে এবার আপনার স্প্লিট এসি চালু করে দেখুন ঠিকভাবে কাজ করছে কি না। এজন্য প্রথমে সার্কিট ব্রেকার বা নির্দিষ্ট পাওয়ার সোর্স থেকে আবার এসির বিদ্যুৎ সংযোগ চালু করুন। বিদ্যুৎ সংযোগ চালু হলে এসি চালু করে দেখুন ঠান্ডা বাতাস ঠিকমতো বের হচ্ছে কি না, সেটি ভালোভাবে যাচাই করুন।
আরও পড়ুন এসময় ডিস্কাউন্টে এসি কিনলে যেসব বিষয় মাথায় রাখবেন প্রথমবার এসি কেনার সময় মাথায় রাখুন ৭ বিষয়সূত্র: উইকিহাউ
কেএসকে/এএসএম