মুফতি ফয়জুল্লাহ আমান
Advertisement
শনিবার, বাদ মাগরিব। আমি আনসান মসজিদের দ্বিতীয় তলায় তাফসির মাহফিলের প্রস্তুতি নিচ্ছি। হঠাৎ দেখি, এক তরুণ কোরিয়ান আমার দিকে এগিয়ে আসছে। হাতে একটি ছোট গিফট। আমাকে হ্যান্ডশেক করিয়ে গিফটটি দিল। এরপর ব্যাগ থেকে বের করল তার গবেষণাপত্র। আমি স্মরণ করার চেষ্টা করলাম—ওর সাথে কোথায়, কবে পরিচয় হয়েছিল।
ধীরে ধীরে মনে পড়ল—হানিয়াং ইউনিভার্সিটির ছাত্র, নাম কিবিন কিম। নৃতত্ত্ব নিয়ে পড়াশোনা করে। আনসানের মুসলিম সমাজকে ঘিরে একটি গবেষণা করছে। কয়েক মাস আগে দীর্ঘ সময় কথা বলেছিল আমার সাথে, পরে গবেষণাপত্রের একটি খসড়া সম্পাদনার জন্যও পাঠিয়েছিল।
আজ মাহফিলে শ্রোতা কম। শুনলাম, কিছু দূরে একজন ভাই F-5 ভিসা পেয়েছেন, সে উপলক্ষে আয়োজন আছে—সেই দাওয়াতে অনেকে চলে গেছেন। আমিও তাফসীর সংক্ষিপ্ত করলাম, বিশেষত কিবিন কিমের উপস্থিতি বিবেচনায়। আজ ছিল মাসের শেষ শনিবার, তাই তাফসীর শেষে প্রশ্নোত্তর পর্বও রেখেছিলাম।
Advertisement
কিবিনও একটি প্রশ্ন করল—তার হাতের লেখা বুঝতে পারছিলাম না, তাই বললাম মোবাইলে লিখে দিতে। সে কাকাউ মেসেঞ্জারে ইংরেজিতে লিখে পাঠাল, হঠাৎ মৃত্যু, যেমন ভূমিকম্প, বন্যা বা দুর্ঘটনার জন্য আমরা কীভাবে প্রস্তুতি নিতে পারি?
আমি বললাম, হঠাৎ মৃত্যু আমাদের হাতে নেই। বরং এখনকার মুহূর্তগুলো কীভাবে কাজে লাগানো যায়, সেটাই গুরুত্বপূর্ণ। মৃত্যুর সময় কেউ ঠেকাতে পারবে না, তাই সেই অমোচনীয় বাস্তবতা থেকে নয়, জীবনকে মূল্যবান করার পথ থেকেই আমাদের প্রস্তুতি শুরু হওয়া উচিত।
অনুষ্ঠান শেষ হলো। তারপর মনে হলো, আসলে কিবিনের প্রশ্নের পেছনে তার ভয় কাজ করছে। হঠাৎ মৃত্যু—এই ভাবনাই হয়তো তাকে প্রশ্ন করিয়েছে।
আমরা তৃতীয় তলায় দস্তরখানে বসেছি। কামরুল ভাই বললেন, কিবিনকে আলাদা প্লেটে খাওয়ানো হোক। আমি বললাম, না, একসাথে খাই—এতে কথা বলা সহজ হয়। তবে ওদের চামচে অভ্যস্ততা মাথায় রেখে চামচ রাখলাম।
Advertisement
আমার পাশে ছিল দাউদ—এক তরুণ, যার বাবা কাজাখ, মা কোরিয়ান। চেহারায় তাকে কোরিয়ানই মনে হয়। কয়েক দিন আগে সে তার ছোট ভাইকে নিয়েও এসেছিল। জিজ্ঞেস করেছিলাম, ভাইটিও কি মুসলিম? সে বলেছিল, না, তাদের পরিবারে কেবল দাউদই মুসলিম।
দাউদের বয়স ১৯। কিবিন কিম বয়সে কিছুটা বড়। একসাথে বসে দুই ধর্মের দুই তরুণের মধ্যে আলাপ জমে উঠলো। তারা ইংরেজিতে কথা বলছিলো। আমি এখানে বাংলায় লিখছি। দাউদ জিজ্ঞেস করলো,
—তুমি কি ক্যাথলিক?
কিবিন বললো,
—না, আমি বৌদ্ধ।
—তুমি কি ধর্ম অনুসরণ করো, নাকি শুধু বংশগত কারণে বৌদ্ধ?
এই প্রশ্নটা গভীর ছিল। কারণ কিবিন আমাকে আগে বলেছিল, সে কোনো ধর্ম মানে না। আজ সে বলছে, কঠোরভাবে বৌদ্ধ ধর্ম অনুসরণ করে। হয়তো একজন মুসলিম ইমামের সামনে নিজেকে নিরপেক্ষ দেখাতে চেয়েছিল।
কিবিনও দাউদকে জিজ্ঞেস করলো,
—তুমি কি জন্মসূত্রে মুসলিম?
দাউদ উত্তর দিল,
—না। আমি ক্যাথলিক পরিবারে জন্মেছি। আমার মা ক্যাথলিক। আমার বাবা মুসলিম ছিলেন, তবে ধর্ম পালন করতেন না। মৃত্যুর আগে তিনি আমাকে একটি কাজাখ কোরআন, কিছু ইসলামিক বই আর একটি নামাজের জায়নামাজ দিয়ে গিয়েছিলেন। তার মৃত্যুর পর আমি ইসলাম নিয়ে জানতে শুরু করি। কোভিডের সময় আমি একা ছিলাম, অনেক চিন্তা করেছি। তারপর আমি ঠিক করলাম—আমি মুসলিম হতে চাই।
এই কথাগুলো বলার সময় দাউদের চোখ টলমল করছিল। আমি মুগ্ধ হয়ে দেখছিলাম—একজন কিশোর তার অন্তরের কথা বলছে। তার চোখে ছিল অনুশোচনা, আবেগ আর হেদায়াতের আলো।
আমি বুঝলাম, এটাই কিবিনের প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার উপযুক্ত সময়। বললাম,
—মৃত্যু কী, কিবিন? এটা বিলীন হয়ে যাওয়া নয়। এটা এক অবস্থা থেকে আরেক অবস্থায় রূপান্তর। যদি হঠাৎ মৃত্যু আসে, ভয় কিসের? এতে সব শেষ হয়ে যায় না। আরেক জীবন শুরু হয়। এমন এক জীবন, যা চিরস্থায়ী। তাই আসল প্রস্তুতি হলো, আমরা এই অল্প সময়ের জীবন কীভাবে অর্থবহভাবে কাটাই।
দাউদ আবার প্রশ্ন করলো,
—বৌদ্ধরা কি সৃষ্টিকর্তায় বিশ্বাস করে?
কিবিন বললো,
—না, বৌদ্ধ ধর্মে সৃষ্টিকর্তার ধারণা নেই।
—তাহলে তুমি কি কিছুতেই বিশ্বাস করো না?
—ঠিক তা নয়। আমরা কম বিশ্বাস করি। কোনো সৃষ্টিকর্তার দৃঢ় বিশ্বাস নেই, তবে পুরোপুরি অস্বীকারও করি না।
আমি বললাম,
—যদি পুরোপুরি অস্বীকার না করো, তাহলে তো ভাবার সুযোগও আছে। যেমন কোনো শিশু, যে তার বাবা-মাকে কখনও দেখেনি, পরে তাদের খুঁজে পায়—সেটা কি আনন্দের হবে না?
কিবিন মাথা নেড়ে বলল,
—হ্যাঁ, খুব আনন্দের হবে।
—তাহলে ভাবো—সৃষ্টিকর্তাকে খুঁজে পাওয়া হয়তো তেমনই আনন্দের। যেমন তোমার ফোন নিজে নিজে তৈরি হয়নি, কেউ বানিয়েছে, এই বিশাল মহাবিশ্বও নিজে তৈরি হতে পারে না, কেউ তৈরি করেছে।
আমরা গল্পে মগ্ন। বাকিরা খাওয়া শেষ করে উঠে গেছে। নামাজের সময় হয়ে গেছে। আমি নিচে নামছি, কিবিনও আমার সাথে নামল। বললাম,
—থাকো কিছুক্ষণ, নামাজের পর তোমার গবেষণাটা পড়বো।
সে বলল,
—অনেক রাত হয়ে গেছে। এখন আর থাকতে পারছি না।
আমি অতিথিদের সাথে সরাসরি দাওয়াত দিতে চাই না। সময়ের সাথে হৃদয়ের কাছাকাছি যেতে চাই। আজও আমার ইচ্ছা ছিল না ধর্ম নিয়ে আলাপ করবো। কিন্তু দাউদের প্রশ্নে আমাকে কথা বলতে হলো। জানি না, কিবিন কীভাবে নিল, কিন্তু আমার বিশ্বাস, কিছু কথা তার হৃদয়ে পৌঁছেছে।
কিবিনের জন্য দোয়া করলাম, হে আল্লাহ! কিবিন কিমকে হেদায়াত দিন, আমাদের সবাইকে আপনার দ্বীনে দৃঢ়তা দিন।
লেখক: ইমাম ও খতিব, মসজিদে সিরাতুল মুস্তাকিম, আনসান, দক্ষিণ কোরিয়া
ওএফএফ/জেআইএম