শিক্ষা

আনিসার জন্য ‘বিশেষ বিবেচনা’, পরীক্ষা নাকি অন্য উপায়?

আনিসার জন্য ‘বিশেষ বিবেচনা’, পরীক্ষা নাকি অন্য উপায়?

বাবা বেঁচে নেই, মা হঠাৎ অসুস্থ। মুমূর্ষু মাকে হাসপাতালে পৌঁছে দিয়ে ছুটে যান এইচএসসি পরীক্ষার কেন্দ্রে। কিন্তু ততক্ষণে দেড় ঘণ্টা দেরি! আইনে নেই, তাই শত আকুতি-মিনতি করেও কেন্দ্রে প্রবেশ করতে পারেননি। পরীক্ষা কেন্দ্রের সামনে ছোটাছুটি আর কান্নায় ভেঙে পড়ার এক হৃদয়বিদারক দৃশ্য, যা দেখে আবেগাপ্লুত সবাই।

Advertisement

বৃহস্পতিবার (২৬ জুন) রাজধানীর মিরপুরে সরকারি বাঙলা কলেজ কেন্দ্রের সামনে এ ঘটনা ঘটে। ঘটনার বেশকিছু ছবি-ভিডিও ছড়িয়ে পড়েছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, মেয়েটি এবারের এইচএসসি পরীক্ষার্থী। প্রথমে গণমাধ্যমসহ সব জায়গায় তার নাম ‘আয়েশা’ বলা হলেও কলেজ সূত্রে জানা যায়, ওই ছাত্রীর নাম ‘আনিসা’।

মিরপুরে অবস্থিত ঢাকা শিক্ষা বোর্ড ল্যাবরেটরি স্কুল অ্যান্ড কলেজ থেকে এবার এইচএসসি পরীক্ষা দিতে ফরম পূরণ করেন তিনি। তবে ভাগ্যের নির্মম পরিহাস! স্বপ্নের এইচএসসি পরীক্ষার প্রথমদিনের পরীক্ষার আগে সকালে মায়ের অসুস্থতায় পরীক্ষা দেওয়া হয়নি তার।

Advertisement

আনিসার কান্না-আকুতি নাড়িয়ে দিয়েছে বহু মানুষের মন-বিবেক। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রশ্ন উঠেছে—আইন কি মানবিক বিবেচনার ঊর্ধ্বে? নেটিজেনরা দাবি তুলেছেন—মানবিক বিবেচনায় হলেও তাকে পরীক্ষা দেওয়ার সুযোগ করে দেওয়া উচিত।

সেই দাবি আমলে নিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকারও। প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং থেকে শিক্ষা উপদেষ্টার বরাতে জানানো হয়েছে, ‘পরীক্ষা দিতে না পারা আনিসার বিষয়টি বিশেষভাবে বিবেচনা করা হচ্ছে।’

তবে সেক্ষেত্রেও ‘পাবলিক পরীক্ষা গ্রহণ সংক্রান্ত আইন ও বিধির বিষয়টি সামনে এনেছেন শিক্ষা উপদেষ্টা। তিনি বলেন, ‘মানবিক বিবেচনায় ওই শিক্ষার্থীর বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে দেখা হচ্ছে। তার বাংলা প্রথমপত্রের পরীক্ষা নেওয়ার বিষয়টি পাবলিক পরীক্ষা গ্রহণ সংক্রান্ত আইন ও বিধির আলোকে সমাধানের চেষ্টা করা হচ্ছে। তার এ দুঃসময়ে আমরাও সমব্যথী।’

আরও পড়ুন

Advertisement

দেরিতে যাওয়ায় পরীক্ষা দিতে না পারা সেই ছাত্রী সুযোগ পেতে পারেন পরীক্ষা দিতে না পারা সেই ছাত্রীর বিষয়ে ‘বিবেচনা’ করছে সরকার বিশেষ ব্যবস্থায় নেওয়া হলো করোনা আক্রান্ত শিক্ষার্থীর পরীক্ষা

জানতে চাইলে ঢাকা শিক্ষা বোর্ড ল্যাবরেটরি স্কুল অ্যান্ড কলেজের অধ্যক্ষ মো. আসাদুজ্জামান জাগো নিউজকে বলেন, ‘মেয়েটির খোঁজ-খবর নিয়েছি আমরা। সে মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছে। কিছুটা ট্রমার মধ্যেও আছে। আমরা তাকে মন দিয়ে আপাতত বাংলা দ্বিতীয়পত্র পরীক্ষার প্রস্তুতি নিতে বলেছি।

পরীক্ষা দিতে না পারা আনিসার সঙ্গে জাগো নিউজের পক্ষ থেকে যোগাযোগের চেষ্টা করেও তাকে পাওয়া যায়নি। কলেজের অধ্যক্ষ জানিয়েছেন, তার পরিবারের পক্ষ থেকে আপাতত গণমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলতে চান না কেউ।

আইনে কী আছে?

দেশের সব পাবলিক পরীক্ষাগুলো ১৯৮০ সালে প্রণীত একটি আইনের ৪২ ধারা অনুযায়ী পরিচালিত হয়। এটিকেই ‘পাবলিক পরীক্ষা আইন ১৯৮০’ বলে বিবেচনা করা হয়। এ আইনে পরীক্ষার কক্ষে বা কেন্দ্রে প্রবেশের নির্দিষ্ট বা সর্বশেষ সময় স্পষ্টভাবে উল্লেখ নেই।

তবে এ আইনের দ্বারা স্বীকৃত পরীক্ষাবিধি ও বোর্ডের নির্দেশনা অনুযায়ী—পরীক্ষা শুরুর কমপক্ষে ৩০ মিনিট আগে পরীক্ষার্থীকে কেন্দ্রে প্রবেশ করতে হবে। বিশেষ কারণে কেউ যদি দেরি করেন, তাহলে তাকে কেন্দ্রের প্রবেশপথে থাকা রেজিস্ট্রার খাতায় প্রবেশের সময়, দেরির কারণ লিখে যেতে হবে। এক্ষেত্রেও বোর্ডের নির্দেশনা পরীক্ষা শুরুর সর্বোচ্চ ৩০ মিনিট পর্যন্ত কেউ দেরি করলে তাকে প্রবেশ করতে দেওয়া যাবে।

যত বড় কারণই থাকুক না কেন, ৩০ মিনিট দেরির পর কাউকে প্রবেশ করতে দেওয়া যাবে না। যদি এ নিয়ম কোনো কেন্দ্রসচিব বা কর্মকর্তা ভঙ্গ করে কাউকে পরীক্ষা শুরুর ৩০ মিনিট দেরির পরও প্রবেশ করতে দেন; তাহলে পাবলিক পরীক্ষা আইন অনুযায়ী—তার ৫ বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড বা অর্থদণ্ড অথবা উভয়দণ্ড হতে পারে।

দেশের ১১টি শিক্ষা বোর্ডের মোর্চা ‘বাংলাদেশ আন্তঃশিক্ষা বোর্ড পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক কমিটি’র আহ্বায়ক অধ্যাপক এস এম কামাল উদ্দিন হায়দার। শিক্ষা ক্যাডারের এ কর্মকর্তা বর্তমানে ঢাকা মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ডের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রকের দায়িত্বে রয়েছেন।

আরও পড়ুন

মেয়েটি কি এইচএসসি পরীক্ষা দিতে পারবে? প্রফেসর বায়েজীদ বোস্তামীর মহানুভবতায় পরীক্ষার হলে শারমিন পরীক্ষা কেন্দ্রে ছাত্রদল নেতা, সচিবকে শোকজ

জানতে চাইলে অধ্যাপক কামাল উদ্দিন হায়দার জাগো নিউজকে বলেন, ‘পরীক্ষা কেন্দ্রে প্রবেশের বিষয়ে আইনে সেভাবে স্পষ্ট করে বলা নেই। তবে ১৯৮০ সালের আইনের দ্বারা স্বীকৃত বিধি অনুযায়ী—পরীক্ষার শুরুর পর ১৫ মিনিট পর্যন্ত কেউ দেরি করলে তাকে প্রবেশ করতে দেওয়ার নিয়ম আছে। যানজটসহ নানা কারণে পরীক্ষার্থীদের দেরি হতে পারে—এ বিবেচনায় আমরা নির্দেশনায় সেটা বাড়িয়ে ৩০ মিনিট পর্যন্ত অ্যালাও (অনুমোদন) করি। এরপর আর কাউকে প্রবেশ করতে দেওয়ার সুযোগ নেই।’

একই নিয়মের কথা জানিয়েছেন ঢাকা মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ডের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক তপন কুমার সরকার। তিনি জাগো নিউজকে বলেন, ‘বিধি মোতাবেক ৩০ মিনিট পর্যন্ত দেরি করলে প্রবেশের সুযোগ দেওয়া আছে। এরপর আর সুযোগ নেই বা সচরাচর প্রবেশ করতে দেওয়া হয় না।’

আনিসার জন্য বিশেষ বিবেচনায় কী হতে পারে?

মায়ের অসুস্থতার কারণে পরীক্ষা দিতে না পারা আনিসার বিষয়টি সরকারের উচ্চপর্যায় থেকে ‘বিশেষ বিবেচনা’ করার কথা বলা হয়েছে। তবে ‘পাবলিক পরীক্ষা আইনের আলোকে সেটা সমাধান করা হবে’ বলে উল্লেখ করেছেন শিক্ষা উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. চৌধুরী রফিকুল (সি আর) আবরার। তবে পরীক্ষা বিধির আলোকে বিশেষ বিবেচনার সুযোগ নেই বলে জানিয়েছেন শিক্ষা বোর্ডের সাবেক ও বর্তমান কর্মকর্তারা।

তারা জানান, বিশেষ বিবেচনা মানে তো অতি বিশেষ, সবকিছুর ঊর্ধ্বে। ফলে সেখানে বিধি দেখার বা মানার প্রয়োজন নেই। সরকার বা সর্বোচ্চ কর্তৃপক্ষের ইচ্ছা থাকলেই সেটা করা সম্ভব। তবে এমন ঘটনা সারাদেশে অসংখ্য ঘটে থাকে। সেক্ষেত্রে আইনি জটিলতার সৃষ্টি হতে পারে বলেও আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন তারা।

ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের সাবেক একজন পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক নাম প্রকাশ না করে জাগো নিউজকে বলেন, ‘আনিসার বিষয়টি সোশ্যাল মিডিয়ায় ব্যাপকভাবে ভাইরাল হওয়ায় বিশেষ বিবেচনার বিষয়টি সামনে আসছে। প্রতি বছর এমন কেস (ঘটনা) অসংখ্য ঘটে। এবারও ভালো করে খোঁজ নেন, দেখবেন আরও এমন বহু ঘটনা আছে। সেগুলো হয়তো সামনে আসেনি। অনেকে তো বাবা-মায়ের লাশ বাড়িতে রেখে পরীক্ষায় অংশ নেন। এগুলো তো গণমাধ্যমেও আসে; সবাই আমরা জানি।’

‘এখন তাকে (আনিসা) পরীক্ষা দেওয়ার সুযোগ দিলে অন্যরাও যদি আইনগত পদক্ষেপ নেন; হাইকোর্টে রিট করে বসেন; তাদেরও পরীক্ষা নিতে শিক্ষা বোর্ড তখন বাধ্য হবে। হাইকোর্টে রিট করলে এটাকে (আনিসা) কেস ধরে সেগুলোও অ্যালাও (অনুমোদন বা নির্দেশ) করবে আদালত। তখন ব্যাপক বিড়ম্বনাও সৃষ্টি হতে পারে’ বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেন সাবেক ওই পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক।

আরও পড়ুন

এইচএসসি পরীক্ষায় সাড়ে ১২ লাখ শিক্ষার্থী প্রথম দিনে স্বাস্থ্যবিধি উপেক্ষিত, নেই মাস্ক-হ্যান্ড স্যানিটাইজার এইচএসসির প্রথম দিনে অনুপস্থিত ১৯৭৫৯ পরীক্ষার্থী, বহিষ্কার ৪৩

বিষয়টির সঙ্গে একমত পোষণ করেছেন বর্তমান পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক অধ্যাপক কামাল উদ্দিন হায়দারও। তবে তার ভাষ্য, মানুষের জন্যই আইন। ফলে মানবিক কারণে আইনের ব্যত্যয়কে স্বাভাবিকভাবে দেখছেন তিনি। পাশাপাশি শিক্ষা মন্ত্রণালয় বিষয়টিকে কীভাবে সমাধান করতে নির্দেশনা দেন, সেটাও বিবেচনার বিষয় বলে উল্লেখ করেন তিনি।

অধ্যাপক কামাল উদ্দিন হায়দার জাগো নিউজকে বলেন, ‘আনিসার বিষয়টি গণমাধ্যমে এসেছে। সেটা নিয়ে সরকারের পক্ষ থেকে শিক্ষা উপদেষ্টা বিশেষ বিবেচনার কথা বলেছেন, সেটাও আমরা জেনেছি। কিন্তু এ নিয়ে মন্ত্রণালয় এখনো আমাদের (শিক্ষা বোর্ড) কিছু বলেনি। ফলে কীভাবে এটা সমাধান করা হবে, তা এখনই বলা সম্ভব নয়।’

দুটি উপায়ে এর সমাধান হতে পারে বলে মনে করেন ঢাকা বোর্ডের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক। প্রথমটির বিষয়ে তিনি বলেন, ‘সে (আনিসা) একটা পরীক্ষা মিস (দিতে পারেনি) করেছে। বাকি পরীক্ষাগুলো সে যথারীতি দেবে। যখন ফল তৈরি করা হয়, তখন বাংলা প্রথমপত্র ও দ্বিতীয়পত্রের নম্বর যোগ করে ফল তৈরি হয়। যদি সে বাংলা দ্বিতীয়পত্রে ভালো করে অর্থাৎ, ৬৬ পেয়ে যায় অথবা তারও বেশি নম্বর পায়; তাহলে তো পাস করেই গেলো। এটাও নিয়মের মধ্যে হতে পারে।’

‘আরেকটি উপায় হলো পরীক্ষা গ্রহণ। সেটা এখনই তো সম্ভব নয়। রুটিন মেনে সব পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হতে হবে। পরীক্ষাগুলো শেষে তার বিষয়ে যদি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ ব্যবস্থা (পরীক্ষা) নিতে বলে, তাহলে সেটা সেভাবে বোর্ড থেকে অ্যারেঞ্জ (পরীক্ষা আয়োজন) করা হবে। সেক্ষেত্রে তার প্রশ্নপত্রের সেট কী হবে, কেমনভাবে পরীক্ষা নেওয়া হবে; সেটা আলোচনার পর বলা যাবে।’ যোগ করেন পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক কামাল উদ্দিন হায়দার।

বিষয়টি নিয়ে জানতে চাইলে ঢাকা বোর্ডের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক তপন কুমার সরকার বলেন, বিশেষ বিবেচনার বিষয়টি ‘বিশেষ’। এখানে নিয়মের কোনো যোগসূত্র নেই। শিক্ষা মন্ত্রণালয় যদি এ নিয়ে সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকে, তাহলে সেটা শিক্ষা বোর্ড বাস্তবায়ন করবে। সেক্ষেত্রে পরীক্ষা নিয়ে হোক, বা অন্য কোনো উপায়ে হোক; সেটা করা সম্ভব।

চলতি বছরের এইচএসসি ও সমমান পরীক্ষা শুরু হয়েছে বৃহস্পতিবার (২৬ জুন)। প্রথম দিনে দেশের সাধারণ ৯টি শিক্ষা বোর্ডের অধীনে ১ হাজার ৬০৫টি কেন্দ্রে বাংলা প্রথমপত্র পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়। মাদরাসা বোর্ডের অধীন ৪৫৯টি কেন্দ্রে আলিমের কোরআন মাজিদ এবং কারিগরি বোর্ডের অধীন ৭৩৩ কেন্দ্রে এইচএসসি (বিএম/বিএমটি) পরীক্ষা নেওয়া হয়।

আন্তঃশিক্ষা বোর্ড সমন্বয় কমিটি সূত্র জানায়, এবার ১১টি শিক্ষা বোর্ডের অধীনে সারাদেশে এ পরীক্ষায় অংশ নিতে ফরম পূরণ করেন ১২ লাখ ৫১ হাজার ১১১ জন। তবে প্রথম দিনে সারাদেশে অনুপস্থিত ছিলেন ১৯ হাজার ৭৫৯ পরীক্ষার্থী। এদিন অসদুপায় অবলম্বনের দায়ে বহিষ্কার করা হয়েছে ৪৩ জনকে।

এএএইচ/ইএ/এমএস