ইসলামি বর্ষপঞ্জির সূচনা হয় মহররম মাস দিয়ে। এ মাসই হিজরি সালের প্রথম মাস। হিজরতের ঐতিহাসিক ঘটনাকে ভিত্তি ধরে এই ক্যালেন্ডারের তারিখ হিসাব করা হয়। এই পঞ্জিকা চালু করেন দ্বিতীয় খলিফা হযরত ওমর ( রা.)। হিজরি ১৭ সালে যখন হজরত আবু মুসা আশআরি (রা.) ইয়েমেনের গভর্নর নিযুক্ত হন, তখন তাকে যেসব সরকারি নির্দেশনা পাঠানো হতো, তাতে কোনো তারিখ লেখা থাকতো না। ফলে আগে-পরে কোন আদেশ এসেছে, তা নির্ধারণ করা কঠিন হতো। এতে আইনগত ও প্রশাসনিক কাজকর্মে ঝামেলা হতো।
Advertisement
এই সমস্যা খলিফা ওমরের (রা.) নজরে আনেন আবু মুসা আশআরি (রা.)। তখন হজরত ওমর (রা.) সাহাবায়ে কেরামকে একত্র করেন এবং আলোচনার মাধ্যমে ঠিক করেন যে, ইসলামি বর্ষপঞ্জির সূচনা হবে এমন একটি ঘটনাকে কেন্দ্র করে, যা ইসলামি ইতিহাসে গভীর তাৎপর্যপূর্ণ এবং চিরকাল মুসলিম উম্মাহকে ইমান, ত্যাগ ও বিজয়ের স্মারক হিসেবে প্রেরণা জোগাবে। সেই বিবেচনায় নবিজির (স.) হিজরতকে হিজরি সনের সূচনাবিন্দু নির্ধারণ করা হয়।
দুনিয়ার প্রায় সব জাতিই নিজেদের বর্ষপঞ্জিকে কোনো না কোনো জাতীয় গৌরবময় ঘটনার সঙ্গে জুড়ে রেখেছে। খ্রিষ্টানরা যেমন তাদের খ্রিষ্টাব্দকে হজরত ইসার (আ.) বা যিশুখ্রিষ্টের জন্মদিনের স্মৃতিতে বানিয়েছে; ইহুদিরা তাদের বর্ষগণনাকে হজরত দাউদের (আ.) ফিলিস্তিন জয়ের সঙ্গে সংযুক্ত করেছে; হিন্দুদের বিক্রমী সন রয়েছে রাজা বিক্রমাদিত্যের নামে। অধিকাংশ ক্যালেন্ডারই কোনো রাজা-বাদশাহর জন্ম, রাজ্যাভিষেক কিংবা বিজয়ের দিনকে ভিত্তি করে তৈরি করা—আর সেই দিনটিকে ঘিরে তারা বিভিন্ন অনুষ্ঠানও করে থাকে।
ইসলাম দিবস কেন্দ্রীক উদযাপন বা অনুষ্ঠান সমর্থন করে না। তাই মুসলমানদের মধ্যে নবিজির (সা.) হিজরতের দিন বা হিজরি নতুন বছরের প্রথম দিনকে কেন্দ্র করে কোনো অনুষ্ঠান বা উদযাপনের প্রচলন নেই। ইসলাম তার অনুসারীদের ত্যাগ, ধৈর্য, আল্লাহর পথে সংগ্রাম ও আল্লাহর ওপর অটল ইমানের শিক্ষা দেয়। তাই মুসলমানদের ক্যালেন্ডার এমন এক ঘটনা দিয়ে শুরু, যা একদিকে আত্মোৎসর্গের প্রতীক, অন্যদিকে এক নতুন যুগের সূচনা।
Advertisement
প্রশ্ন ওঠে—মহররম কেন হিজরি সালের প্রথম মাস? কারণ, হিজরতের জন্য দৃঢ় সংকল্প হয়েছিল জিলহজ মাসেই, আর এর পরের চাঁদ উঠেছিল মহররমের। তাই চাঁদের গণনায় বছর শুরু হয় মহররম থেকে। আরবরা অন্যান্য মাসের নাম নিজেদের রীতি অনুযায়ী পাল্টালেও ‘মহররম’ নামটি ছিল অপরিবর্তিত। এ মাসে তারা যুদ্ধ-বিগ্রহ করত না। তবে কিছু বছর তারা এই নিষেধাজ্ঞা ভেঙে মহররমকে যুদ্ধের মাস বানাতো, অন্য কোনো মাসকে ‘পবিত্র’ বানিয়ে নিত।
কোরআনে আল্লাহ তাআলা বলেছেন—
إِنَّ عِدَّةَ الشُّهُورِ عِندَ اللَّهِ اثْنَا عَشَرَ شَهْرًا فِي كِتَابِ اللَّهِ…مِنْهَا أَرْبَعَةٌ حُرُمٌআল্লাহর কাছে মাসের সংখ্যা বারোটি... যার মধ্যে চারটি পবিত্র মাস। (সুরা তওবা: ৩৬)এই চারটি মাস হলো: জিলকদ, জিলহজ, মহররম ও রজব। রাসুলুল্লাহ (সা.) নিজে মহররম মাসকে ‘শাহরুল্লাহ’ বা আল্লাহর মাস বলে উল্লেখ করেছেন। এই সম্মান অন্য কোনো মাসকে দেওয়া হয়নি। এক হাদিসে এসেছে—
أَفْضَلُ الصِّيامِ، بَعْدَ رَمَضانَ، شَهْرُ اللهِ المُحَرَّمُ
Advertisement
রমজানের পর শ্রেষ্ঠ রোজা হলো আল্লাহর মাস মহররমের রোজা। (সহিহ মুসলিম: ১১৬৩)এই আয়াত ও হাদিস থেকে স্পষ্ট হয়, মহররম মাসের ফজিলত কারবালার প্রান্তরে সাইয়িদুনা হোসাইনের (রা.) শাহাদাতের কারণে নয়—বরং তা নবিজির (সা.) যুগ থেকেই ইসলামে বিশেষ মর্যাদার অধিকারী। আর কারবালার হৃদয়বিদারক ঘটনা সংঘটিত হয়েছিল নবিজির (সা.) ওফাতের প্রায় পঞ্চাশ বছর পর। অন্যদিকে দীনে ইসলাম পূর্ণতা পেয়েছে নবিজির (স.) জীবনকালেই। নবিজি (সা.) আশুরার রোজা রাখতেন আর বলেছিলেন, পরের বছর ইনশাআল্লাহ, ইহুদিদের সঙ্গে সাদৃশ্য এড়াতে নবম মহররমেও রোজা রাখবেন।
তাই আমাদের করণীয় হলো—মহররম মাসের প্রতিটি দিন, প্রতিটি রাতকে যথাসম্ভব ইবাদত, তাকওয়া ও নফল কাজের মাধ্যমে মূল্যবান করে তোলা। শরিয়তের বাইরে গিয়ে কোনো আয়োজন নয়, কোনো লোকদেখানো অনুষ্ঠান নয়। এই মাসকে নবিজি (সা.) ‘আল্লাহর মাস’ বলেছেন। তাই মহররম মাস আমাদের জন্য বিশেষ মর্যাদার মাস—রাসুল (সা.) ও সাহাবিগণের মেহনত ও কোরবানির স্মরণ ও সংযমের মাস। আর আমাদের চেষ্টা করা উচিত যেন হিজরি ক্যালেন্ডারকে আমরা আমাদের ব্যবহারিক ক্যালেন্ডার হিসেবে গ্রহণ করতে পারি—আমাদের দলিল-দস্তাবেজ, আর্থিক লেনদেন, অফিসিয়াল কাজকর্মে এই ক্যালেন্ডারের তারিখ ব্যবহারের প্রচলন আবার শুরু করা দরকার।
(কিনদিল অনলাইন অবলম্বনে)
ওএফএফ/এমএস