দেশজুড়ে

আধুনিকতার ছোঁয়ায় জৌলুস হারিয়েছে কামার শিল্প

আধুনিকতার ছোঁয়ায় জৌলুস হারিয়েছে কামার শিল্প

‘স্যাঁকরার খুট খাট, কামারের এক ঘা’ বহুল প্রচলিত প্রবাদটি এখন আর তেমন শোনা যায় না। এক সময় কোরবানির ঈদকে ঘিরে কর্মচঞ্চলে মুখরিত থাকতো কামারপাড়া। তবে এখন সময় বদলেছে, নেই আগের মতো জৌলুস। বাজারে আধুনিক যন্ত্রপাতি থাকায় শিল্পটি বিলুপ্তির পথে।

Advertisement

বংশ পরম্পরায় চলে আসা এক সময়ের ঐতিহ্য ধরে রেখে হাতে গোনা কয়েকটি পরিবার এ পেশাকে আঁকড়ে ধরে রেখেছে। তবে এতে নেই আগের মতো আয়।

শরীয়তপুর সদর উপজেলার আংগারিয়া বাজার। এক সময় কামারশিল্পের জন্য সুখ্যাতি ছিল এই বাজারের। কমপক্ষে ২০টি দোকান ছিল এখানে। দা, বটি, ছুরি, কাচি, কোদালসহ বিভিন্ন গৃহস্থালির নানা উপকরণ তৈরিতে এক সময় দিনরাত ব্যস্ত থাকতো কামারপাড়ার শিল্পীরা। উপজেলার গণ্ডি পেরিয়ে এসব উপকরণ সরবরাহ হতো দেশের বিভিন্ন জেলায়।

কিন্তু নানা সমস্যায় জর্জরিত শিল্পটি এখন প্রায় বিলুপ্তির পথে। কালের বিবর্তনে অনেকেই গুটিয়েছেন পৈত্রিক ব্যবসা। শুধুমাত্র চারজন এখন বাজারটিতে টিকে রয়েছেন। আগের মতো হাপড় (চামড়া দ্বারা তৈরি একধরনের যন্ত্র) টেনে, লোহা পুড়িয়ে লাল করে পিটিয়ে টুং টাং শব্দে দিনরাত ধারালো জিনিস তৈরিতে ব্যস্ততা নেই কারিগরদের। বর্তমানে বাজারে আধুনিক স্টিল ও লোহার তৈরি জিনিসপত্র পাওয়ায় প্রাচীন পদ্ধতিতে তৈরি লোহার উপকরণের প্রতি আগ্রহ নেই মানুষের।

Advertisement

কয়েকটি কামারশালা ঘুরে দেখা যায়, কামারিরা কেউ দা-বটি বানাচ্ছেন। অনেকে আবার সেগুলোকে ধার দিচ্ছেন। সামনে সাজিয়ে রাখা রয়েছে এসব জিনিস। তবে ক্রেতার তেমন উপস্থিতি নেই। কেউ আসছেন, দামদর করে আবার চলে যাচ্ছেন। শুধুমাত্র ছোট ছুরি ও চাপাতি বিক্রি হচ্ছে। কেজিপ্রতি সেগুলোর দাম ধরা হয়েছে ৮০০ টাকা।

আংগারিয়া এলাকার মনি কর্মকার (৭০)। ৫৬ বছর ধরে কামার শিল্পের সঙ্গে জড়িত। তার দোকানে রয়েছে সুজন ও শিশির নামে দুই কর্মচারী। এক সময় কোরবানির ঈদকে ঘিরে তার দোকানে বেচাবিক্রি ছিল লাখ টাকার ওপরে। এখন আর নেই সেই জৌলুশ। ৫০ হাজার টাকা বিক্রি করতেই হিমশিম খেতে হয় তাকে।

জানতে চাইলে তিনি বলেন, দিন দিন কাঁচামালের দাম বাড়ছে, কিন্তু আমাদের মজুরির দাম বাড়ে না। বাজারে এখন মেশিনে তৈরি নানা ধরনের জিনিসপত্র পাওয়া যায়। যার চাহিদা বেশি। আমরা যেহেতু প্রাচীন পদ্ধতি অবলম্বন করে জিনিসপত্র তৈরি করি, সেগুলো দেখতে অতোটা সুন্দর নয় বলে মানুষ এগুলো কিনতে আগ্রহ দেখায় না। যদি সরকারিভাবে প্রশিক্ষণের মাধ্যমে আধুনিক যন্ত্রপাতি প্রস্তুত করার ব্যবস্থা ও কারখানা করে দেয়, তাহলে শিল্পটি বাঁচিয়ে রাখা সম্ভব।

বাজারের আরেক ব্যবসায়ী উত্তম মণ্ডল। তার বাবা সুধীর মণ্ডলের পেশাটি ধরে রেখেছেন তিনি। তবে ঈদ এলেও তেমন ক্রেতা নেই তার দোকানে। কিছু লোকজন আসে দামদর করে চলে যায়।

Advertisement

তিনি বলেন, আমাদের তৈরি লোহার জিনিসপত্রের চাহিদা কমে গেছে। এজন্য কামার শিল্পের সঙ্গে জড়িতদের সংখ্যা দিনদিন কমে যাচ্ছে। এ পেশার ভবিষ্যৎ দিন দিন খারাপ হওয়ায় অনেকেই অন্য পেশায় চলে গেছে। বাপ-দাদার পেশা বলেই আমরা উপায় না পেয়ে কোনোমতে পেশাকে ধরে রাখার চেষ্টা করছি। তবে আমাদের সন্তানদের এ পেশায় আর আনার আগ্রহ নেই।

বাচ্চু মন্ডল নামের আরেক কামার শিল্পী বলেন, একদিকে পুঁজির অভাব, অন্যদিকে লোহা-কয়লার দাম বেশি হওয়ায় মজুরির দাম উঠছে না। কোরবানি উপলক্ষে কিছু চাপাতি, আর ছোট ছুরি বিক্রি হচ্ছে। অন্যসব দিনে এগুলোর চাহিদা থাকে না। তখন আমরা বসে থাকি। আসলে আমাদের দেখার মতো কেউ নেই। সরকার যদি শিল্পটির দিকে একটু নজর দিয়ে আধুনিক যন্ত্রপাতি প্রস্তুত করার ব্যবস্থা করে দেয় তাহলে আমরা পরিবার নিয়ে টিকে থাকতে পারবো।

এদিকে শিল্পটি টিকিয়ে রাখতে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা ও সহযোগিতার হাত বাড়িতে দেওয়ার কথা জানালেন সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) ইলোরা ইয়াসমিন।

তিনি বলেন, আমাদের কামার শিল্প কিছুটা পিছিয়ে পড়েছে। এর কারণ মানুষ দিন দিন আধুনিক প্রযুক্তির জিনিসপত্রের দিকে ঝুঁকছে। বাংলাদেশের প্রত্যেকটি শিল্পই গুরুত্বপূর্ণ। আমরা চাই এটি টিকে থাকুক। আমরা এ শিল্পটি টিকিয়ে রাখতে প্রয়োজনে কামার শিল্পীদের প্রশিক্ষণ ও ক্ষুদ্র ঋণের ব্যবস্থা করবো।

বিধান মজুমদার অনি/জেডএইচ/এএসএম