স্বল্পোন্নত দেশ (এলডিসি) থেকে উত্তরণ ও যুক্তরাষ্ট্রের সাম্প্রতিক শুল্ক বৃদ্ধির প্রভাব বিবেচনায় নিয়ে এ সরকার বাজেটে পাঁচ শতাধিক পণ্যের আমদানি শুল্ক ব্যাপকভাবে কমানোর ঘোষণা দিয়েছে। তবে এতে স্থানীয় আমদানি বিকল্প শিল্পগুলো বাড়তি প্রতিযোগিতায় পড়তে পারে। তাদের জন্য এ বাজেট চ্যালেঞ্জের বলে মন্তব্য করেছেন বিশেষজ্ঞরা।
Advertisement
তারা বলছেন, এলডিসি-পরবর্তী সময়ে প্রতিযোগিতা সক্ষমতা বাড়ানোর লক্ষ্য থাকলেও যেসব পণ্যে দেশেও উৎপাদন হয়, সেগুলোর শুল্ক কমানোয় ওই খাতগুলোর শিল্প প্রবৃদ্ধি ও কর্মসংস্থানের গতি শ্লথ হতে পারে।
অর্থ উপদেষ্টা অর্থনীতির জন্য একটি বৈষম্যহীন ও টেকসই ভিত্তি নিশ্চিত করতে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকারের কথা বললেও আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) পরামর্শে প্রস্তাবিত বাজেটে কর অব্যাহতি প্রত্যাহারের মাধ্যমে স্থানীয় শিল্পের সুরক্ষা কমানো হয়েছে। রাজস্ব আয় বাড়াতে সুতা উৎপাদনে ভ্যাট ও লোকসানি প্রতিষ্ঠানেরও কর বাড়ানো হয়েছে। আবার ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের স্থান-স্থাপনা ভাড়ার উৎসেও কর বাড়ানো হয়েছে।
যেসব পণ্যের শুল্ক কমানো হয়েছে তার মধ্যে রয়েছে, আমদানিকৃত প্লাস্টিক পণ্য, কিচেনওয়্যার, টয়লেটপেপার, টিস্যু পেপারসহ বিভিন্ন ধরনের ফ্যাব্রিক। বিভিন্ন তৈরি পোশাক ও জুতার ওপর শুল্ক ৪৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ৪০ শতাংশ করা হয়েছে। আর ব্রিক, ব্লক ও টাইলসের ওপর শুল্ক ২০ শতাংশ থেকে কমিয়ে ১০ শতাংশ করা হয়েছে। এছাড়া কিছু পেট্রোলিয়াম পণ্য এবং আমদানি করা মাছ ও মাংসের ওপরেও শুল্ক কমানো হয়েছে।
Advertisement
সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) বিশিষ্ট ফেলো অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান বলেন বলেন, আমদানিতে যে উচ্চ শুল্ক ছিল, তা কমানোর যুক্তি ছিল। তবে এর ফলে স্থানীয় পর্যায়ের আমদানি বিকল্প শিল্পও বাড়তি প্রতিযোগিতার মুখে পড়তে যাচ্ছে।
অর্থনীতিবিদ এম এম আকাশের মতে, আমদানি পণ্যের উদার নীতির কারণে স্থানীয় শিল্পে এখন বিনিয়োগ বাড়ার কোনো সুযোগ নেই। আর বৈদেশিক বিনিয়োগ আসারও কোনো সুযোগ নেই। যেহেতু বিনিয়োগ আসবে না, সে জন্য চাপ সৃষ্টি হবে এবং বেকারত্ব ও দারিদ্র্য বাড়বে।
শুল্ক কমানোর বিষয়টি যথাযথ গবেষণা করে এবং বাণিজ্য নীতি বিবেচনায় নিয়ে করা হয়েছে কি না, বিশেষত উদীয়মান শিল্পের বিষয়টি মাথায় ছিল কি না, তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন এ দুই অর্থনীতিবিদ।
এবারের বাজেটে ১১০টি পণ্যে আমদানি শুল্ক সম্পূর্ণ প্রত্যাহার করা হয়েছে। আরও ৬৫টি পণ্যে কাস্টমস ডিউটি কমানো হয়েছে। ৯টি পণ্যে সম্পূরক শুল্ক পুরোপুরি তুলে নেওয়া হয়েছে এবং ৪৪২টি পণ্যে তা আংশিকভাবে কমানো হয়েছে। বিগত তিন বছর ধরে শুল্ক কমানো হলেও এবারের বাজেটেই সবচেয়ে বেশি পণ্যে শুল্ক কমানো হয়েছে।
Advertisement
এদিকে, সরকারের দাবি, আগামী বছরের ২৪ নভেম্বর বাংলাদেশের এলডিসি বা স্বল্পন্নোত দেশ থেকে উত্তরণের কথা। তখন আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্যে বিদ্যমান অনেক সুযোগ-সুবিধা কমে আসবে। ফলে স্থানীয় শিল্পকে প্রতিযোগিতা করেই বিশ্ববাজারে টিকে থাকতে হবে। সেই প্রস্তুতি এখন থেকেই নিচ্ছে সরকার।
তবে হুট করে আমদানি শুল্ক ব্যাপকভাবে কমানোর কারণে বড় সমস্যা হবে জানিয়ে খাত-সংশ্লিষ্টদের বক্তব্য, শিল্পে উৎপাদন খরচ বাড়লে বিনিয়োগকারীরা নিরুৎসাহিত হবেন। তাতে বিনিয়োগের গতি মন্থর হয়ে পড়বে। কমে যাবে কর্মসংস্থান।
প্রস্তাবিত বাজেটে প্লাস্টিকের তৈরি সব ধরনের পণ্যের উৎপাদন পর্যায়ে ভ্যাট সাড়ে ৭ থেকে ১৫ শতাংশ করা হয়েছে। ফলে এসব পণ্যের দাম কিছুটা বাড়তে পারে। একইভাবে বাড়বে দেশে তৈরি এসি-ফ্রিজের দাম। এছাড়া যারা ঘরবাড়ি বানানোর পরিকল্পনা করেছেন তারাও হোঁচট খেতে পারেন। কারণ রডের উৎপাদন পর্যায়ে আরোপিত সুনির্দিষ্ট কর প্রায় ২০ শতাংশ বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে। ফলে নির্মাণ খাতের প্রধান এই উপকরণটির দাম বাড়তে পারে।
আরও পড়ুন: পাচারের টাকা ফেরানো সহজ নয়: অর্থ উপদেষ্টাইলেকট্রনিক্স পণ্য উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান ইলেক্ট্রোমার্টের উপ-ব্যবস্থাপনা পরিচালক নুরুল আফসার জাগো নিউজকে বলেন, ভ্যাট দ্বিগুণ হলে ফ্রিজের দাম দুই থেকে তিন হাজার টাকা ও এসির দাম তিন থেকে চার হাজার টাকা বেড়ে যাবে। দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা এখনও ঘুরে দাঁড়ায়নি। এই উদ্যোগে ক্রেতারাই ক্ষতিগ্রস্ত হবেন।
তিনি বলেন, বাংলাদেশের ইলেকট্রনিক্স খাত মাত্র যাত্রা শুরু করেছে। রপ্তানিও বাড়ছে। এমন সময় এ ধরনের সিদ্ধান্ত আমাদের বড় ক্ষতির মুখে ফেলবে।
২০১৯ সাল থেকে হোম অ্যাপ্লায়েন্স পণ্য উৎপাদন পর্যায়ে ভ্যাট এবং উৎপাদনে ব্যবহৃত উপকরণ যন্ত্রাংশ আমদানি ও স্থানীয়ভাবে কেনার ক্ষেত্রে ভ্যাট ও সম্পূরক শুল্ক অব্যাহতি সুবিধা পেয়ে আসছিল। তবে সরকারের টেকসই ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার অংশ হিসেবে এসব খাতে অব্যাহতি সুবিধা কমিয়ে আনার উদ্যোগ নিচ্ছে। এ ক্ষেত্রে আগামী পাঁচ বছরে তিন ধাপে ভ্যাট বসাতে যাচ্ছে সরকার।
২০২৫-২৬ অর্থবছর থেকে দুই বছরের জন্য এসব পণ্যের স্থানীয় উৎপাদন পর্যায়ে ৫ শতাংশ ভ্যাট আরোপ করা হচ্ছে। এর পরের দুই বছর ভ্যাটের এই হার হবে সাড়ে ৭ শতাংশ, যা ২০২৯ সালের জুন পর্যন্ত বহাল থাকবে। তারপরের বছর ভ্যাট আরও বেড়ে ১০ শতাংশ হবে। এটি কার্যকর থাকবে ২০৩০ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত।
আরও পড়ুন: কালো টাকা সাদা করার সুযোগ জুলাই আন্দোলনের সঙ্গে সাংঘর্ষিক: সিপিডিএ ছাড়া রেফ্রিজারেটর, ফ্রিজার, এসি ও কম্প্রেসরের ক্ষেত্রেও অতিরিক্ত সুবিধা কমানো হয়েছে। স্থানীয় শিল্পকে সুরক্ষা দিতে ২০১১ সাল থেকে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান নানা অব্যাহতি সুবিধা পেয়ে আসছে। রাজস্ব বাড়াতে এখন এসব খাতের পণ্য উৎপাদনের ক্ষেত্রে স্থানীয় পর্যায়ে বিদ্যমান অব্যাহতি সুবিধা প্রত্যাহার করা হচ্ছে। আগামী অর্থবছর থেকে এসব পণ্য উৎপাদনে ব্যবহৃত উপকরণ ও খুচরা যন্ত্রাংশ আমদানির ক্ষেত্রে ভ্যাট দিতে হবে।
তবে এসব খাতে বিদ্যমান বিনিয়োগের বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে উৎপাদনের ব্যবহৃত প্রয়োজনীয় উপকরণ ও খুচরা যন্ত্রাংশ আমদানির ক্ষেত্রে শর্তসাপেক্ষে সম্পূরক শুল্ক (প্রযোজ্য ক্ষেত্রে) ২০২৮ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। এই পদক্ষেপের কারণে এসি-ফ্রিজের উৎপাদন খরচ ও দাম বেড়ে যাবে। ফলে নিম্ন ও মধ্যবিত্তদের পক্ষে এসব পণ্য কেনা অনেকটা কঠিন হয়ে যাবে।
দেশে মোবাইল ফোন উৎপাদন ও সংযোজনের ক্ষেত্রে শর্তসাপেক্ষে ভ্যাট অব্যাহতি সুবিধা রয়েছে। তবে এবারের বাজেটে এ ক্ষেত্রে ভ্যাট দুই থেকে আড়াই শতাংশ পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে। সরকার ব্লেডের উৎপাদন পর্যায়ে ভ্যাট ৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে সাড়ে ৭ শতাংশ করেছে।
এনএইচ/এসএনআর/এএসএম