স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় মুক্তিযোদ্ধাদের সাহস ও অনুপ্রেরণাদায়ী গান ‘মোরা একটি ফুলকে বাঁচাবো বলে যুদ্ধ করি’ এর গীতিকার ও গায়ক আপেল মাহমুদ বলেছেন, ‘আমি যে আপেল মাহমুদ তা জীবিত থেকেই প্রমাণ করেছি। আমি মুক্তিযোদ্ধা নই অভিযোগটি ভুল প্রমাণিত হওয়ায় জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিলের (জামুকা) সদস্যরা দুঃখ প্রকাশ করেছেন।’
Advertisement
সোমবার (২ জুন) দুপুরে কুমিল্লা সার্কিট হাউজে জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিলের শুনানি শেষে সাংবাদিকদের তিনি এসব কথা বলেন।
আপেল মাহমুদ বলেন, ‘৩ নম্বর সেক্টরে আমি সরাসরি যোদ্ধা ছিলাম। ক্যাপ্টেন মতিউর রহমানের কমান্ডে যুদ্ধ করেছি। ১০ এপ্রিল পর্যন্ত আমরা নরসিংদীর পাঁচদোনাসহ বিভিন্ন এলাকায় যুদ্ধ করেছি। নরসিংদী ফল করে ১০ তারিখে। আমরা চলে যাই ক্যাপ্টেন নাসিমের আন্ডারে আশুগঞ্জে। সেখানে আমরা ভৈরব রামনগর ব্রিজে পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করি। সেখান থেকে রামনগর ব্রিজ, ভৈরব, আশুগঞ্জ, হবিগঞ্জ, চুনারুঘাট, চানপুর টি-স্টেট, তেলিয়াপাড়া টি-স্টেটে যুদ্ধ করেছি। তেলিয়াপাড়া ১৯৭১ সালে আমার শেষ যুদ্ধক্ষেত্র ছিল।’
তিনি আরও বলেন, ‘আশুগঞ্জের যুদ্ধের সময় আমার বাম চোখের পাশে আঘাতপ্রাপ্তও হই। পরে আমাকে আগরতলা নিয়ে যাওয়া হয় এবং সেখানে মোহাম্মদ আব্দুল জব্বার (শিল্পী আব্দুল জব্বার) ভাইও আসেন। ২৫ মে কলকাতায় বড় করে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র প্রতিষ্ঠিত হলে শুরুতেই আমাকে এবং জব্বার ভাইকে শরণার্থীদের জন্য একটি অনুষ্ঠান করতে হয়েছে। আমরা দুদিন অনুষ্ঠান করে অনেকগুলো শিল্পী পাই। পহেলা জুন থেকে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে আমার ওপর যে দায়িত্ব ছিল তা ২০০৬ সালে রিটায়ারমেন্ট পর্যন্ত বাংলাদেশ বেতার বা রেডিও বাংলাদেশ যাই বলেন না কেন, সেই দায়িত্ব পালন করেছি। আমি তো মনোয়ার হোসেনের (অভিযোগকারী) কোনো ক্ষতি করিনি, জানি না তিনি কেন এমন সঙ্গে এমন করলেন।’
Advertisement
এসময় আপেল মাহমুদের সঙ্গে উপস্থিত ছিলেন তার সহধর্মিণী নাসরিন মাহমুদ, বীর মুক্তিযোদ্ধা একুশে পদকপ্রাপ্ত শব্দসৈনিক মনোরঞ্জন ঘোষাল, বাংলাদেশ বেতারের সাবেক পরিচালক মুক্তিযোদ্ধা আশরাফুল আলম, বীর মুক্তিযোদ্ধা জাহাঙ্গীর হায়াত খান, বীর মুক্তিযোদ্ধা সুভাষ সাহা প্রমুখ।
গত ৫ আগস্টের পর স্বাধীন বাংলা বেতার কর্মী পরিষদের সাধারণ সম্পাদক মনোয়ার হোসেন গীতিকার আপেল মাহমুদের বিরুদ্ধে অভিযোগ তোলেন যে, তিনি মুক্তিযোদ্ধা নন। এরই পরিপ্রেক্ষিতে গত ১২ মে জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিলের উপ-পরিচালক (উন্নয়ন) ফাতেমা খাতুন আপেল মাহমুদের সপক্ষে যাবতীয় দলিল ও সাক্ষ্য উপস্থাপনের জন্য নোটিশ জারি করেন। গত ২ মে কুমিল্লা সার্কিট হাউজে শুনানির জন্য আপেল মাহমুদকে ডাকা হয়।
জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিলের মহাপরিচালক শাহিনা খাতুন শুনানি শেষে কুমিল্লা সার্কিট হাউজে সাংবাদিকদের জানান, গীতিকার আপেল মাহমুদ নিজেকে বীর মুক্তিযোদ্ধা প্রমাণ করতে পেরেছেন। গত ৫ আগস্টের পরে কুমিল্লা জেলা থেকে ‘৩১ জন মুক্তিযোদ্ধা নন’ এমন অভিযোগ ওঠে। সেসব অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে কুমিল্লা সার্কিট হাউজে দুটি কমিটিতে শুনানি অনুষ্ঠিত হয়। আজ সেখানে আপেল মাহমুদ নিজেকে প্রমাণ করেছেন তিনি একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা।
তিনি আরও বলেন, আপেল মাহমুদ যদি শুধু গান গেয়ে উদ্বুদ্ধ করার মতো ঘটনায় সম্পৃক্ত থাকতেন, তাহলে তিনি সহযোগী মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে খেতাব পেতেন। কিন্তু তিনি কাগজপত্রে প্রমাণ করেছেন তিনি সম্মুখযোদ্ধাও ছিলেন। তাই তিনি বীর মুক্তিযোদ্ধা।
Advertisement
স্বাধীনতা যুদ্ধের সময়ে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে প্রচারিত ‘মোরা একটি ফুলকে বাঁচাবো বলে যুদ্ধ করি’ গানের গায়ক হিসেবে সবচেয়ে বেশি পরিচিত আপেল মাহমুদ। এছাড়া ‘তীর হারা এই ঢেউয়ের সাগর’ তার একটি উল্লেখযোগ্য গান।
দেশাত্মবোধক গান ছাড়াও তিনি রবীন্দ্রসংগীত, লালনগীতি, গণসংগীত ও আধুনিক ধারার গান গেয়েছেন। সংগীতে অবদানের জন্য তিনি ২০০৫ সালে দেশের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বেসামরিক পুরস্কার একুশে পদকে ভূষিত হন।
জাহিদ পাটোয়ারী/এসআর/এমএস