রকিবুল ইসলাম
Advertisement
দারিদ্র্য মানুষকে বড় করে। মহান করে। সৃষ্টি জগতের প্রতি প্রেমভক্তি জাগিয়ে তোলে। দারিদ্র্যের যেমন অসুবিধা আছে; তেমনই বড় ধরনের সুবিধাও আছে। দারিদ্র্যের কষাঘাতে জর্জরিত হয়েই মানুষ এখান থেকে বেরোনোর পথ খোঁজে। মনের মধ্যে প্রবল জেদের উদ্রেক হয়। একসময় এ জেদ তাকে দারিদ্র্যের শিকল থেকে বের হওয়ার পথ বাতলে দিতে সহায়তা করে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে সে পথ পেয়েও যায়।
ড. সালেহ হোসেনের ‘এক জীবনের গান’ মূলত এমন দারিদ্র্যজয়েরই বিজয়ফলক। লেখক খুব কাছে থেকে দারিদ্র্য দেখেছেন। মনে-প্রাণে-দেহে দারিদ্র্যের ছোঁয়া অনুভব করেছেন। পাশাপাশি এ দারিদ্র্য থেকে উত্তরণের পথও খোঁজার চেষ্টা করেছেন। পরিশেষে সফলভাবেই সেই দারিদ্র্যজয়ের মালাও পরেছেন। আর এসবের জীবনঘনিষ্ঠ প্রয়োজনীয় বিষয়ের আলোকপাত করেছেন এক জীবনের গানে। লেখক তাঁর প্রসঙ্গ-কথায় লিখেছেন, ‘দিরাই, কখনো সিলেট শহর, কখনো মৌলভীবাজার, কখনো মুইগড় গ্রামের প্রায় অনিশ্চিত আটপৌরে দারিদ্র্যের জীবন দেখে শৈশব থেকেই এই বিরুদ্ধ-ক্লিষ্ট জীবনের সীমাহীন দুর্ভোগ ও দারিদ্র্যের হাত থেকে বাঁচার জন্য নিজেকে মনে মনে প্রস্তুত রাখতাম। শৈশবের দুরন্ত জীবনের আড়ালে একটাই জেদ মনের ভেতর পুষতাম, আমাকে দারিদ্র্য থেকে মুক্ত হতে হবে। নিজের, মা-বাবা, পরিবারের সচ্ছলতার জন্য আমাকে যত পরিশ্রমই করতে হোক না কেন, তা করবো। এবং সকল উপার্জন নীতিনৈতিকতা ও হালাল উপার্জনের মাধ্যমে হতে হবে।’
শৈশব-কৈশোর জীবন মানবজীবনের এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। মূলত শৈশবে যে স্বপ্নের বীজ বোনা হয়, পরিণত বয়সে তারই প্রতিফলন পাওয়া যায়। শৈশবকে ভালোভাবে আলোকিত করতে পারলে সে আলো একসময় সমাজের প্রতিটি স্তরে আলো ছড়িয়ে থাকে। এভাবে সামাাজিক মানুষ হিসেবে সমাজের প্রতি তার দায়বদ্ধতার বহিঃপ্রকাশ ঘটে। ব্যক্তি তখন আর ব্যক্তিগত পর্যায়ে না থেকে সে হয়ে ওঠে বিশ্বজনীন। ড. সালেহ হোসেন শৈশবে স্বপ্ন দেখতেন, নিজেকে মানুষের মতো করে গড়ে তুলতে। পাশাপাশি নিজের পরিবার ও সমাজকে দারিদ্র্যের নির্মম দুর্ভোগ থেকে মুক্ত করতে। আর সে কারণে তিনি অপরিণত বয়সেই দারিদ্র্য থেকে মুক্তির বিষয়টি মনে-প্রাণে ধারণ করতে পেরেছিলেন। গ্রামের পণ্ডিতমশাইয়ের পাঠশালা থেকে শুরু করে দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ পর্যন্ত তাঁর বর্ণিল শিক্ষাজীবন সমৃদ্ধ হয়েছে। এ জীবনকে আরও সোনায়-সোহাগায় পরিপূর্ণ করতে নিজেকে গবেষণায় সম্পৃক্ত করেছেন। তিনি স্বদেশের মায়া ছেড়ে নিজেকে সমৃদ্ধ করতে পাড়ি জমালেন অজানা-অচেনা বিদেশের মাটিতে। সেখানে আপনজন বলতে কেউ নেই। নিজেকে অভয় দিলেন, আবিষ্কার করলেন। ‘আমি পারব, আমাকে যে পারতেই হবে।’ দীপ্ত এ মনোবল তাঁকে আরও মনোযোগী করেছিল, আরও দায়িত্বশীল করেছিল।
Advertisement
আরও পড়ুন
ক্রীতদাসের হাসি: তাতারীর আর্তনাদ বাঘ ও দৈত্য: রাইদাহ গালিবার বিস্ময়কর সৃষ্টিনিজের সীমাবদ্ধতা অতিক্রম করে একজন মানুষ কীভাবে তাঁর কাঙ্ক্ষিত স্বপ্নের জায়গায় পৌঁছতে পারে, তারই এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত ড. সালেহ হোসেন। লক্ষ্যে পৌঁছতে হলে নিজেকে কীভাবে প্রস্তুত করতে হয়, কীভাবে পরম সৃষ্টিকর্তা আল্লাহর ওপর ভরসা করে এগিয়ে যেতে হয়, তার সবই উঠে এসেছে গ্রন্থটিতে। ঔপন্যাসিক না হয়েও যে দক্ষতা ও সৃজনশীল কারিশমায় গ্রন্থটি সাজিয়েছেন, তাতে তাঁর মুনশিয়ানারই পরিচয় পাওয়া যায়। তাছাড়া গ্রন্থটিকে মোটিভেশনাল বই বললেও অতিরিক্ত বলা হবে না। কিশোরসহ সব বয়সী পাঠকের জন্য বইটি পাঠ করা তাই জরুরি বলেই মনে করি।
‘এক জীবনের গান’ লেখকের এক জীবনের পাওয়া না-পাওয়ার গান। লেখকের সমসাময়িক পারিপার্শ্বিক ঘটনাপ্রবাহের আখ্যান। এখানে উঠে এসেছে দেশভাগ, বঙ্গভঙ্গ, মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতার কথা। ঘটমান পরিস্থিতির মধ্যে নিজের আত্মজৈবনিক অগ্রসরতার কাব্যিক উপস্থাপনা গ্রন্থটিকে ব্যঞ্জনা দান করেছে। গ্রন্থটি পাঠে একজন পাঠক আত্মজীবনী পাঠের পাশাপাশি নিজের মধ্যকার মানবিক সত্তার উপস্থিতিও টের পাবেন। একটি উপন্যাস যেমন পাঠককে এর শেষ অবধি মন্ত্রমুগ্ধের মতো টেনে নিয়ে যায়; তেমনই এক জীবনের গান পাঠেও একজন পাঠক সেই একই স্বাদ আস্বাদন করতে পারবেন। লেখকের এক জীবনের গান তাই শেষ পর্যন্ত হয়ে ওঠে সব মানুষের এক জীবনের গান।
বইটির প্রকাশনার মান অত্যন্ত চমৎকার। প্রচ্ছদ, মেকাপ, ছাপা, বাঁধাই, কাগজ সব মিলিয়ে বেশ উন্নতমানের প্রোডাকশন বলতেই হয়। বইটির লেখক, প্রকাশক, সব চরিত্র ও পাঠকের জন্য অনন্ত শুভ কামনা ও ভালোবাসা। বইটি প্রকাশ করেছে প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান সংযোগ। প্রকাশকাল ফেব্রুয়ারি ২০২৫। প্রচ্ছদ করেছেন আল নোমান। মূল্য ১২০০ টাকা।
Advertisement
এসইউ/এমএস