জেসিকা জামান
Advertisement
একজন মেয়ে শিশু নারী হয়ে ওঠার দিকে প্রথম ধাপ নেয় একটি স্বাভাবিক শারীরিক পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে। মাসিক, পিরিয়ড, বা ঋতুস্রাব। এই পরিবর্তনটি নারীদেহের সুস্থতা ও সন্তানধারণের জন্য আবশ্যক। কিন্তু সামাজিক ট্যাবু, অজ্ঞতা ও নানাবিধ কুসংস্কারের কারণে অনেক নারীই এই সময়ে সঠিক স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার সুযোগটাও পান না। এর ফলে তারা বিভিন্ন সংক্রমণ ও স্বাস্থ্য সমস্যায় পড়েন। এমনকি অনেকে প্রাণও হারান।
তাই মেনস্ট্রুয়াল হাইজিন বা ঋতুস্রাবের সময় স্বাস্থ্যবিধি সম্পর্কে সচেতনতা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সেই সঙ্গে মেয়ে শিশুদের বয়স ৯-১০ হলেই এ বিষয়ে তাদের সঠিক তথ্য দিতে হবে, যেন তারা এ পরিবর্তনের সঙ্গে মানিয়ে নিতে পারে, এবং নিজেকে সুস্থ রাখতে পারে। এসময় সঠিক স্বাস্থসেবা ও সহযোগিতা না পাওয়া কেবল স্বাস্থ্যেরই সমস্যা নয়, এটি একটি মানবাধিকার সমস্যাও বটে।
মেনস্ট্রুয়াল হাইজিন বা ঋতুস্রাবের স্বাস্থ্যবিধি কী?
Advertisement
মেনস্ট্রুয়াল হাইজিন বলতে ঋতুস্রাবের সময় বিশেষভাবে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখা এবং নিরাপদ ও স্বাস্থ্যকর পদ্ধতিতে স্যানিটারি প্যাড, ট্যাম্পন, মেনস্ট্রুয়াল কাপ বা পরিষ্কার কাপড় ব্যবহার করাকে বোঝায়। এর পাশাপাশি স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস ও বিশ্রাম নেওয়াও জরুরি। আগে নানাবিধ সামাজিক ট্যাবুর কারণে মাসিক স্বাস্থ্য ও ঋতুস্রাবের মতো বিষয়গুলো নিয়ে কেউ তেমন আলোচনাই করতো না। এটিকে একটা গোপন ও লজ্জার বিষয় মনে করা হতো। কিন্তু এখন দিন পাল্টেছে। বর্তমানে এটি নিয়ে কথা হচ্ছে, বাবা-মা তাদের কন্যাদের প্রস্তুত করছেন, বিভিন্ন সংস্থা সচেতনতা বৃদ্ধির কাজ করছে, সেই সঙ্গে বিশ্বব্যাপী চলছে পিরিয়ডের জন্য বিভিন্ন পণ্য সহজলভ্য করার আন্দোলন।
আজ মাসিক স্বাস্থ্যবিধি দিবসআজকে (২৮ মে) মাসিক স্বাস্থ্যবিধি দিবস। নারীদের জন্য একটি পিরিয়ড-বান্ধব পৃথিবী গড়ে তোলা এবছরের প্রতিপাদ্য। একটি পিরিয়ড-বান্ধব পৃথিবী হলো এমন এক সংস্কৃতি, যেখানে ঋতুস্রাবকে স্বাভাবিক হিসেবে গ্রহণ করা হবে, একে লজ্জার বিষয় মনে করা হবে না; সেখানে প্রত্যেক নারী তার পছন্দের মানসম্পন্ন ও সাশ্রয়ী মূল্যের পিরিয়ড পণ্য, পিরিয়ড-বান্ধব টয়লেট এবং মাসিক স্বাস্থ্যসেবার সুযোগ পাবে; যেখানে কেবল ঋতুস্রাবের কারণে কাউকে পিছিয়ে রাখা হবে না।
বর্তমানে, ৫০ কোটিরও বেশি নারী নিরাপদে এবং মর্যাদার সঙ্গে তাদের মাসিককালীন পরিচর্যা করার জন্য প্রয়োজনীয় উপকরণ এবং সহায়তার অভাবে আছে। মাসিক-সম্পর্কিত চ্যালেঞ্জগুলো বিশ্বজুড়ে নারীদের শিক্ষাগত সুযোগ, আয়-উপার্জনের সুযোগ ও স্বাস্থ্যের উপর প্রভাব ফেলে এবং সমাজে সমানভাবে অংশগ্রহণের ক্ষমতাকে ক্ষতিগ্রস্ত করে। তাহলে চলুন জেনে নেওয়া যাক কীভাবে নিশ্চিত করবেন নারীদের মেনস্ট্রুয়াল হাইজিন সুবিধা-
১. পিরিয়ড বিষয়ে সঠিক শিক্ষামাসিক এর ব্যাপারে সঠিক এবং পর্যাপ্ত তথ্যের অভাবে স্বাস্থ্য ঝুঁকি বাড়ে। এর ফলে অনেক মেয়েরা স্কুলে অনুপস্থিত হয়ে যায়; এমনকি এটি ঝরে পড়ারও কারণ হয়ে দাঁড়ায়। কিন্তু যদি ছোটবেলা থেকেই ছেলে মেয়েদেকে শেখানো যায় যে মাসিক একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া, তাহলে সামাজিকভাবে এটির গ্রহণযোগ্যতা বৃদ্ধি পাবে। এছাড়াও পিরিয়ড বিষয়ক শিক্ষা মেয়েদেরকে বয়ঃসন্ধির শুরুতেই প্রয়োজনীয় ব্যবহারিক এবং জৈবিক জ্ঞান দিতে পারে। এর মধ্য দিয়ে নারীদের মধ্যে প্রচলিত ভয় ও লজ্জা দূর করা যায়। মানসিক সুস্থতা বজায় রাখা এবং যাবতীয় কুসংস্কার ও নিষেধাজ্ঞা দূর করার জন্য সময়োপযোগী এবং সঠিক জ্ঞান খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
Advertisement
২. স্যানিটারি প্যাড, ট্যাম্পন বা মেনস্ট্রুয়াল কাপ ব্যবহারমাসিক সচেতনতার প্রথম ধাপ হিসাবেই ভালো মানের স্যানিটারি প্যাড বা ট্যাম্পন ব্যবহার করুন এবং প্রতি ৪-৬ ঘণ্টা পর পর বদলে ফেলুন। মেনস্ট্রুয়াল কাপ ব্যবহার করা যেতে পারে, তবে সেক্ষেত্রে তা সঠিকভাবে পরিষ্কার করে পুনরায় ব্যবহার করতে হবে। ট্যাম্পন, মেনস্ট্রুয়াল কাপ বাংলাদেশে তেমন সহজলভ্য এবং প্রচলিত না হলেও দেশে বিভিন্ন কোম্পানির স্যানিটারি প্যাড বেশ সহজলভ্য। আবার, অনেক নারী কাপড় ব্যবহার করেন, সেক্ষেত্রে পরিষ্কার সুতি কাপড় ব্যবহার করা উচিত এবং ব্যবহারের পর সাবান দিয়ে ধুয়ে কড়া রোদে শুকিয়ে নিতে হবে। ৩. ব্যক্তিগত পরিচ্ছন্নতা:প্রতিবার প্যাড বা কাপড় বদলানোর আগে ও পরে সাবান দিয়ে হাত ধুতে হবে। যৌনাঙ্গ পরিষ্কার রাখতে নিয়মিত কুসুম গরম পানি দিয়ে পরিষ্কার রাখা ভালো। তবে ঘন ঘন ক্ষারযুক্ত সাবান ব্যবহার না করতে পরামর্শ দেন চিকিৎসকরা। মনে রাখবেন মাসিক কালীন বিশেষ পরিচর্যা ও সচেতনতা আপনাকে সুস্থতার দিকে কয়েক ধাপ এগিয়ে রাখতে সাহায্য করে। তাই লজ্জা না করে নিজেকে ভালবাসুন, নিজের যত্ন নিন।
৪. সঠিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনাব্যবহৃত প্যাড, ট্যাম্পন বা কাপড় মাটিতে পুঁতে ফেলা, পুড়িয়ে ফেলা বা মাসিক বর্জ্য ফেলার নির্ধারিত স্থানে ফেলা উচিত। এতে পরিবেশ দূষণ কম হবে। তবে সম্ভব হলে রিইউজেবল পণ্যও ব্যবহার করা যায়। এখন বিভন্ন ধরণের ওয়াশেবল প্যাড, মেনস্ট্রুয়াল কাপ পাওয়া যায়। এগুলো একটি পণ্য অনেকবার ব্যবহার করা যায় বলে তা সাশ্রয়ী এবং পরিবেশবান্ধব। মেনস্ট্রুয়াল হাইজিন মেনে চললে ইউরিনারি ট্র্যাক্ট ইনফেকশন, ইস্ট ইনফেকশন সংক্রমণ জাতীয় সমস্যার সম্ভবনা কমে।
৫. পিরিয়ড-বান্ধব টয়লেটঋতুস্রাব-বান্ধব টয়লেটের অভাবে মেয়ে শিক্ষার্থীরা স্কুলে অনুপস্থিত হতে শুরু করে। অনেক নারী অফিসে এ সময় টয়লেট ব্যবহার করতে না পেরে স্বাস্থ্য সমস্যায় ভোগেন। তাই ঋতুস্রাব-বান্ধব টয়লেটে যা যা থাকা উচিত তা হলো – পরিচ্ছন্ন টয়লেট সিট ও মেঝে, পর্যাপ্ত পানি, সাবান ও টয়লেট পেপার। বাড়ি, স্কুল, বিশ্ববিদ্যালয়, কর্মক্ষেত্র, বাজার, ক্রীড়াঙ্গন, ট্রেন স্টেশন এবং বিমানবন্দরের মতো স্থানগুলোতে জনসাধারণের জন্য এ ধরনের টয়লেট থাকা উচিত। এবং অবশ্যই নারীদের নিরাপত্তা ও প্রাইভেসির কথা মাথায় রেখে পৃথক টয়লেটের ব্যবস্থা থাকা উচিত।
৬. মাসিক স্বাস্থ্যসেবামাসিককালীন সচেতনতার পাশাপাশি এর সাঙ্গে সম্পর্কিত স্বাস্থ্যসমস্যাগুলোর জন্য সময়মত রোগ নির্ণয়, চিকিৎসা এবং যত্ন নারীর স্বাস্থ্যের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কারণ দীর্ঘস্থায়ী, চিকিৎসাবিহীন ঋতুস্রাবের ব্যাধি আপনার জীবনের সব দিককে প্রভাবিত করতে পারে।
মেনস্ট্রুয়াল হাইজিন শুধু স্বাস্থ্য নয়, মর্যাদারও বিষয়। সঠিক পরিচ্ছন্নতা ও সচেতনতার মাধ্যমে নারীরা মাসিকের সময়েও সুস্থ ও সক্রিয় থাকতে পারেন। পরিবার, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও সমাজের সকলের উচিত এই বিষয়ে খোলামেলা আলোচনা করা এবং সঠিক তথ্য প্রদান করা। মাসিক সম্পর্কে ছেলে ও মেয়ে উভয়কে শিক্ষা দেওয়া প্রয়োজন, যাতে এ নিয়ে লজ্জা বা গোপনীয়তা না থাকে।
আপনি কি জানেন যে, বিশ্বব্যাপী প্রতি ৫টি স্কুলের মধ্যে মাত্র ২টিতে মাসিককালীন স্বাস্থ্য শিক্ষা দেওয়া হয় এবং প্রতি ৩টির মধ্যে মাত্র ১টিতে মাসিককালীন বর্জ্য ফেলার ব্যবস্থা আছে। সাম্প্রতিক তথ্য অনুসারে, মাসিকজনিত কারণে স্কুলে অনুপস্থিতির গড় হার ১৫ শতাংশ। আফ্রিকার এক গবেষণায় দেখা গেছে যে, এই হার ৩১ শতাংশ পর্যন্ত।
নিম্ন-আয়ের দেশগুলোতে, নারীরা মাসিক স্বাস্থ্য এবং স্বাস্থ্যবিধি বজায় রাখার ক্ষেত্রে অসংখ্য বাধার সম্মুখীন হন। উপযুক্ত মাসিক উপকরণ ও স্বাস্থ্যসম্মত টয়লেটের অভাব তার মধ্যে প্রধান। সঠিক পণ্যের অভাবে অনেক নারী কেবল টয়লেট পেপার, অন্তর্বাস, নোয়রা কাপড় ব্যবহার করেন অথবা কিছুই ব্যবহার করেন না। বিশেষজ্ঞরা উল্লেখ করেছেন যে দুর্বল স্বাস্থ্যবিধি ব্যবস্থাপনা মূত্রনালীর সংক্রমণ বা প্রজনন ট্র্যাক্টের সংক্রমণ সহ বিভিন্ন স্বাস্থ্য ঝুঁকির কারণ হতে পারে। অর্থাৎ মাসিক স্বাস্থ্য কোন বিশেষ বিষয় নয়, কোনও বিলাসবহুল বিষয়ও নয়। সবাই মিলে সচেতন হলেই মাসিক নিয়ে ট্যাবু ভাঙা সম্ভব!
সূত্র: ইউ এন ওয়াটার, ইউনিসেফ, বিশ্ব স্বাস্থ্য সমস্যা
এএমপি/এএসএম