মতামত

সংকটের আবর্তে উত্থাপিত প্রশ্ন যেন উত্তরহীন না থাকে

সংকটের আবর্তে উত্থাপিত প্রশ্ন যেন উত্তরহীন না থাকে

অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের পদত্যাগের বিষয়টি নিয়ে নতুন করে আলোচনার কিছু নেই। এটা এখন অতীতের বিষয়। ড. ইউনূসকে পদত্যাগ করার দাবি কেউ উত্থাপন করেনি। তিনি স্বপ্রণোদিত হয়ে এমন সিদ্ধান্ত নিতে যাচ্ছিলেন। তবে কেন তিনি দায়িত্ব ছেড়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন এর নানান বিশ্লেষণ ইতিমধ্যে সংবাদমাধ্যমে কম উঠে আসেনি। এ নিয়ে আর চর্বিত চর্বন না করাই শ্রেয় মনে করি।

Advertisement

প্রশ্ন হলো, ওই অধ্যায়ের পরিসমাপ্তি হয়েছে বটে কিন্তু সংকট কতটা কাটলো? হঠাৎ কেন নানামুখী সংকটের ছায়া প্রলম্বিত হচ্ছে? এর কিছু কারণ নতুন কিছু কারণ পুরোনো। আমরা দেখছি, প্রায় প্রতিদিন কোনো না কোনো কারণে ঢাকায় চলাচলের পথ অবরুদ্ধ হয়ে পড়ছে। যে কোনো আন্দোলনের ঢেউ অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার বাসভবনের দিকে আঁছড়ে পড়ছে। কয়দিন ধরে চলমান সচিবালয়ের আন্দোলন জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) দৃষ্টিতে 'প্রশাসনিক কু্য' এই বার্তা সংবাদমাধ্যমের।

২৮ মে বিকেলে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে নিজের ভেরিফায়েড অ্যাকাউন্টে এক পোস্টে এনসিপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মুখ্য সমন্বয়ক হান্নান মাসউদ হুঁশিয়ারি দেন, ‘আজ সচিবালয়, এনবিআর কিংবা পোর্টে যাঁরা স্ট্রাইক করছেন, তাঁদের বলছি, বিপ্লব ওখানেও হবে। আপনারা দুর্নীতি আর লুটপাটের স্বাধীনতা চাচ্ছেন, কিন্তু চব্বিশ-পরবর্তী সময়ে এটা আর পাবেন না। হাসিনার পুরো শাসনামলের প্রতিটি গুম, খুন, দুর্নীতি, অর্থপাচার—সবকিছুর সহযোগী আপনারা। ভাববেন না, পার পেয়ে গেছেন। পুনশ্চ বলছি, পার পাওয়ার কোনো সুযোগ নেই। সরকারের উচিত অবিলম্বে এসব দুর্নীতিগ্রস্তদের অপসারণ করে, নিরপেক্ষ কমিশনের মাধ্যমে তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়া।’

অন্যদিকে চট্টগ্রামে দলের এক কর্মসূচিতে অংশ নিয়ে এনসিপির দক্ষিণাঞ্চলের মুখ্য সংগঠক হাসনাত আবদুল্লাহও কঠোর হুঁশিয়ারি দেন। তিনি বলেন, 'কর্মচারীরা সরকারের কাজে বাধা দিলে, হুমকি দিলে জনগণই তাঁদের বিকল্প খুঁজে নেবে। সংস্কারে বাধা দিয়ে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীরা সরকারকে জিম্মি করলে পরিস্থিতি ভালো হবে না।’ অর্থাৎ সচিবালয়ে আন্দোলনকারীদের প্রতিপক্ষ এখন শুধু সরকারই নয়। তাছাড়া বিভিন্ন ইস্যুতে মব তৈরি করে জনমনে ত্রাসের সঞ্চার , ভাঙচুর একই সঙ্গে আরও বিভিন্ন ইস্যুতে অরাজকতা সরকার অনেক ক্ষেত্রেই ঠেকাতে পারছে না। এর কোনো কোনোটি রাজনৈতিক আবার কোনো কোনোটি অরাজনৈতিক। মব নিয়ে জনমনে আতঙ্কের পাশাপাশি বহুবিধ প্রশ্নেরও জন্ম দিচ্ছে। সমান্তরালে জাতীয় ও স্থানীয় নির্বাচনের ব্যাপারে রাজনৈতিক বিভক্তিও দৃশ্যমান। ইশরাকের মেয়র ইস্যু এর মধ্যে নতুন সংযোজন। বিএনপি এবং এনসিপির তরফে কয়েকজন উপদেষ্টার পদত্যাগ দাবি যেন এ সময়ে ঘৃতাহুতি।

Advertisement

সরকারের নজরে বিভাজন কোনোভাবেই কাম্য হতে পারে না। একই সঙ্গে সবার প্রশ্ন শুনতে হবে, আমলে নিতে হবে এবং শুধু প্রশ্নের উত্তর দেওয়াই নয়; নিশ্চিত করতে হবে যথাযথ প্রতিবিধান। প্রশ্ন করা নাগরিকের অধিকার। ন্যায়বিচার ও আইনের শাসনের আকুতির নিরসন ঘটুক। জবাবদিহিতা সুশাসনের নিশ্চয়ই অন্যতম বড় অনুষঙ্গ। দায়বদ্ধতা-জবাবদিহিতার বিষয়গুলো যে কোনো ব্যবস্থার সরকারেরই এড়ানোর অবকাশ নেই।

নির্বাচনের ব্যাপারে সরকারের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত না পাওয়ায় বিএনপির রাজনৈতিক চাপও বাড়ছে এবং বিষয়টি কেন্দ্র করে রাজনৈতিক বাহাস চলছে। শুধু বাহাসেই বিষয়টি থেমেও নেই। সরকার ব্যবস্থার নানাবিধ খবর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে খুব চাউর। এর সঙ্গে মিয়ানমারকে মানবিক করিডোর, চট্টগ্রাম বন্দর পরিচালনার দায়িত্ব বিদেশি সংস্থাকে দেওয়া কিংবা না দেওয়া ইত্যাদি বিষয়ে সরকার, রাজনৈতিক দল ও সেনাবাহিনীর অবস্থান অস্পষ্ট নয়। এসব ব্যাপারে সেনাপ্রধানের বক্তব্য সেনাবাহিনীর অবস্থান আরও সুস্পষ্ট করেছে।

গত দুদিন আগে বেশ কিছু রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধি যমুনায় অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠক করে সরকারের প্রতি আস্থা জ্ঞাপনের পাশাপাশি তাদের চাওয়ার কথাও জানিয়েছেন এবং কিছু পরামর্শ দিয়েছেন। ওই বৈঠকটিকে সর্বদলীয় বৈঠক বলা হয়েছে কিন্তু বেশ কিছু নিবন্ধিত রাজনৈতিক দল তাতে আমন্ত্রণ পায়নি এবং এ নিয়ে কোনো কোনো সমালোচক ওই বৈঠকটিকে সর্বদলীয় বলতে নারাজ। এসবই বিতর্কের বিষয়। এগুলো বাদ দিলেও সামগ্রিক পরিস্থিতি যে প্রীতিকর নয় বিদ্যমান বাস্তবতা তাই বলছে।

বর্তমানে রাজনীতির খণ্ডিত চিত্র হলো, সাংবিধানিক সংস্কার প্রশ্নে বিএনপির বিপরীতে অবস্থান নিয়েছে এর সঙ্গে যুগপৎ আন্দোলনকারী মিত্র দলগুলো। ভোটের অনুপাতে উচ্চকক্ষ, প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা কমানো, জাতীয় সাংবিধানিক কাউন্সিল (এনসিসি) গঠন এবং এর মাধ্যমে সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানে নিয়োগের সুপারিশে বিএনপি রাজি না হলেও তার মিত্ররা রাজি। যুগপৎ আন্দোলনে থাকা দলগুলোকে নিয়ে বিএনপি ২০২৩ সালের জুলাইয়ে রাষ্ট্র সংস্কারের ৩১ দফা ঘোষণা করেছিল। আগামী নির্বাচনে এই জোট জয়ী হলে জাতীয় সরকার গঠনেরও প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল তারা। বিএনপির মিত্র দলগুলো হলো– গণঅধিকার পরিষদ, জেএসডি, নাগরিক ঐক্য, গণসংহতি আন্দোলন, বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি, এনডিএম, ১২ দলীয় জোট ও ১২টি দলের জাতীয়তাবাদী জোট। এর মধ্যে দুই জোট বিএনপির পথে হাঁটলেও বাকিদের ভিন্নমত আছে।

Advertisement

মিত্র হয়েও সংস্কারে বিএনপির বিপরীতে অবস্থান বিষয়ে দলগুলোর নেতারা জানিয়েছেন, নিজস্ব রাজনৈতিক অবস্থান থেকে তারা মতামত দিয়েছেন। আনুপাতিক পদ্ধতির উচ্চকক্ষ না হলে ছোট দলগুলো সংসদীয় রাজনীতিতে টিকতে পারবে না। অর্থাৎ সংকটের ছায়া নানাদিকে বিস্তৃত হচ্ছে। যেখানে ঐকমত্যের দূরত্ব ক্রমেই বাড়ছে সেখানে সংস্কারের পথ কতটা সুগম প্রশ্ন তোলা যায় এ নিয়েও। অনেক ক্ষেত্রেই আমাদের অভিজ্ঞতা সুখকর নয়। ‘ঘর পোড়া গরু সিঁদুর রাঙা মেঘ দেখলেও ডরায়’ এই প্রবাদের সঙ্গে দেশের উল্লেখযোগ্য অংশের মানুষের তুলনা অমূলক নয়।

উল্লেখ্য, বিএনপি নেতারা বিগত এক দশকে রাজনৈতিক নিপীড়নের শিকার হয়েছেন নানাভাবে তাও অসত্য নয়। অনেক প্রতিকূলতা-প্রতিবন্ধকতা ছিল তাদের রাজনীতির পথে। বিগত সরকারের পতনে তাদের ভূমিকা খাটো করে দেখার অবকাশ নেই। সেনাবাহিনীর ভূমিকা এবং দেশপ্রেম নিয়েও প্রশ্ন তোলার অবকাশ নেই। দেশের পরিবর্তিত প্রেক্ষাপটে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাসহ জননিরাপত্তা নিশ্চিত করতে তারা আপ্রাণ প্রয়াস অব্যাহত রেখেছে। তারপরও মবের মতো সমাজ ও মানবতাবিরোধী কর্মকাণ্ড চলছে এবং তাদের তরফে এ নিয়ে পুনরায় হুঁশিয়ারি শোনা গেছে।

আইনশৃঙ্খলার আরও যদি অবনতি ঘটে তাহলে সরকার জনআস্থাহীনতার তীরে বিদ্ধ হবে অভিজ্ঞতা তাই বলে। নিশ্চয়ই সবার আগে নিরাপত্তা। অন্তর্বর্তী সরকার কতটা সবার হতে পেরেছে - এ প্রশ্ন সরকারের জন্য সুখকর নয়। বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের দাবিদাওয়া উত্থাপন অস্বাভাবিক কিছু নয়। কিন্তু এর প্রক্রিয়া এমন হওয়া বাঞ্ছনীয় যাতে জনদুর্ভোগ তৈরি না করে। অধিকারের সমতল মাঠ রাষ্ট্রের সব নাগরিকের জন্য নিশ্চিত হওয়া খুব জরুরি। বিদ্যমান পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের পথ তো সর্বাগ্রে বাতলাতে হবে সরকারকেই। রাজনৈতিক শক্তিগুলোর এক্ষেত্রে সহযোগিতা নিশ্চয়ই প্রয়োজন।

সরকার ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলোর পাশাপাশি দায়িত্বশীল সব পক্ষের দায় জনশান্তির পথ মসৃণ করে জাতীয় নির্বাচনের দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া। দল যার যার কিন্তু সরকার তো সবার। সরকারের নজরে বিভাজন কোনোভাবেই কাম্য হতে পারে না। একই সঙ্গে সবার প্রশ্ন শুনতে হবে, আমলে নিতে হবে এবং শুধু প্রশ্নের উত্তর দেওয়াই নয়; নিশ্চিত করতে হবে যথাযথ প্রতিবিধান। প্রশ্ন করা নাগরিকের অধিকার। ন্যায়বিচার ও আইনের শাসনের আকুতির নিরসন ঘটুক। জবাবদিহিতা সুশাসনের নিশ্চয়ই অন্যতম বড় অনুষঙ্গ। দায়বদ্ধতা-জবাবদিহিতার বিষয়গুলো যে কোনো ব্যবস্থার সরকারেরই এড়ানোর অবকাশ নেই।

লেখক : সাংবাদিক, কলাম লেখক।

এইচআর/এমএফএ/জিকেএস