ফাহিম হাসনাত
Advertisement
কবি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘পাহাড় চূড়ায়’ কবিতার সেই আকুতি—‘অনেকদিন থেকেই আমার একটা পাহাড় কেনার শখ।/ কিন্তু পাহাড় কে বিক্রি করে তা জানি না।/ যদি তার দেখা পেতাম,/ দামের জন্য আটকাতো না’—বহু বছর ধরেই আমার মনে গেঁথে ছিল লাইনগুলো। পাহাড় বিক্রির ঠিকানা অজানা, দাম নিয়ে চিন্তা না থাকলেও সেই অধরা স্বপ্ন যেন সব সময় তাড়া করে বেড়াতো।
সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ১৮০০ ফুট উপরে দাঁড়িয়ে যখন পাহাড়ের দিগন্তবিস্তৃত সবুজ আর মেঘের লুকোচুরি দেখার সুযোগ হলো; তখন বুঝলাম কেন কবির মনে পাহাড় কেনার এমন তীব্র আকাঙ্ক্ষা জেগেছিল। সেই উপলব্ধি থেকেই হঠাৎ একদিন আমরা ৯ বন্ধু মিলে রওয়ানা হলাম রাঙ্গামাটির ছাদ খ্যাত সাজেক ভ্যালির উদ্দেশ্যে।
সাজেক ভ্যালি, প্রকৃতির এক অসাধারণ সৃষ্টি। বাংলাদেশের বুকে এই পাহাড়ি জনপদ তার মনোমুগ্ধকর সৌন্দর্য আর শান্ত স্নিগ্ধ পরিবেশ দিয়ে সহজেই পর্যটকদের মন জয় করে নেয়। রাঙ্গামাটি জেলার বাঘাইছড়ি উপজেলার সাজেক ইউনিয়নে অবস্থিত এই ভ্যালির উত্তরে ভারতের ত্রিপুরা এবং পূর্বে মিজোরামের সীমান্ত।
Advertisement
ঢাকা থেকে রাঙ্গামাটির সরাসরি কোনো বাস না থাকায় আমাদের প্রথম গন্তব্য ছিল খাগড়াছড়ি। রাতের বাসে চেপে বসলাম আমরা ৯ জন। যারা দূরে কোথাও ঘুরতে যেতে চান, তাদের জন্য টিপস—সম্ভব হলে ৩-৪ দিন আগে থেকেই যাওয়া-আসার টিকিট বুকিং করে রাখুন। এতে বাসের সামনের দিকের পছন্দের সিট পাওয়া যায়। আমরাও সেই কাজটি সেরে রেখেছিলাম।
বাসে আমার ঘুমের এক বদঅভ্যাস রয়েছে। যথারীতি ঘুমিয়েই কাটিয়ে দিয়েছিলাম পুরোটা সময়। শুধু কুমিল্লায় রাতের খাবারের জন্য বাস থামলে একটু জেগেছিলাম। তারপর আবার সেই ঘুমের রাজ্যে হারিয়ে যাওয়া। প্রায় ৭ ঘণ্টার জার্নি শেষে আমরা ভোরে খাগড়াছড়ি পৌঁছালাম।
বাস থেকে নেমেই আমাদের প্রথম কাজ ছিল সাজেক যাওয়ার জন্য চান্দের (জিপ) গাড়ি ভাড়া করা। কিন্তু এখানে বাঁধলো বিপত্তি। নিয়ম অনুযায়ী, জিপ টাইপের চান্দের গাড়িতে সর্বোচ্চ ৭ জন যেতে পারে, আমরা ছিলাম ৯ জন। আমাদের পছন্দ ছিল জিপেই যাওয়ার। অনেক বুঝিয়ে শেষমেশ ২ দিনের জন্য একটা চান্দের গাড়ি ঠিক করতে সক্ষম হলাম।
চান্দের গাড়িতে করে যখন আমরা সাজেকের দিকে এগোচ্ছিলাম, তখন পথের দু’ধারের দৃশ্য মুগ্ধ করে দিচ্ছিল। এ যেন এক স্বপ্নের দুনিয়া! বাঁকে বাঁকে পাহাড়ি দৃশ্য, বাঁশের মাচাং ঘর, মাঝে মাঝে মেঘে ঢাকা রাস্তা, আবার হঠাৎ করেই জনবসতি—সব মিলিয়ে যেন কোনো সিনেমার দৃশ্যপট। মাঝে মাঝে হালকা মেঘ আর কুয়াশা রাস্তার মাঝে ঢুকে পড়ছিল, যা পরিবেশটাকে আরও রহস্যময় করে তুলছিল। একটা বিষয় আমাকে বেশ অবাক করেছিল—কিছুক্ষণ পরপরই দেখতাম আশেপাশে শুধু পাহাড় আর জঙ্গল, কোনো জনবসতি নেই। আবার একটু পরেই হয়তো বিশাল বাজার কিংবা লোকালয়।
Advertisement
পথের মাঝে সেনাবাহিনীর একটি ক্যাম্পে আমাদের গাড়ি থামানো হলো। সেখানে অন্য পর্যটকদের গাড়িও এসে জমায়েত হয়েছিল। পরে সবগুলো গাড়িকে একসাথে নির্দিষ্ট সময়ে ছাড়া হয়। মূলত পর্যটকদের নিরাপত্তার কথা ভেবেই এমন ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। সেখানে নিরাপত্তা নিয়ে কোনো রকম দুশ্চিন্তা করার অবকাশ নেই।
আরও পড়ুন
গরমে ভ্রমণের প্রস্তুতি ও সতর্কতা কেমন হবে? কলকাতার ট্রাম: পর্যটকের চোখে নান্দনিক সংস্কৃতিরাস্তার দু’পাশে পাহাড়ি ফল বিক্রেতাদের পসরা দেখে লোভ সামলানো কঠিন ছিল। আমরা পেঁপে, আখ, কলা, আনারস, ডাব, বরই, তেঁতুল—যা পেলাম তাই চেখে দেখলাম। স্বাদের দিক থেকে আমাদের সমতলের ফলের সাথে খুব বেশি পার্থক্য না থাকলেও ফলগুলো ছিল বেশ মিষ্টি আর ঠান্ডা। মনে হচ্ছিল যেন এইমাত্র ফ্রিজ থেকে বের করা হয়েছে।
পাহাড়ের মনোরম দৃশ্য দেখতে দেখতে আর সুস্বাদু ফল খেতে খেতে প্রায় ৩ ঘণ্টার পথ পাড়ি দিয়ে অবশেষে আমরা পৌঁছে গেলাম আমাদের কাঙ্ক্ষিত গন্তব্য—সাজেক ভ্যালিতে। সেখানে পৌঁছানোর পর মনে হলো যেন কোনো শিল্পী তার তুলির আঁচড়ে এক স্বপ্নীল ছবি এঁকে রেখেছেন। চারদিকে সবুজ পাহাড়ের সারি, উপরে নীল আকাশ আর মেঘের ভেলা যেন এক অপার্থিব সৌন্দর্য সৃষ্টি করেছে।
গাড়ি থেকে নেমে আমরা সরাসরি আমাদের রিসোর্টে যাই। যারা সাজেক যেতে চান, তাদের জন্য আরেকটি পরামর্শ—সরকারি ছুটির দিনগুলো এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করুন। আর রিসোর্ট বুকিং অন্তত ৭-১০ দিন আগে করে রাখলে খরচ অনেকটাই কমানো যায়। আমরাও আগে থেকে রিসোর্ট বুকিং করেছিলাম, তাই রুম প্রতি প্রায় দেড় থেকে দু’হাজার টাকা সাশ্রয় হয়েছিল। সাজেক ভ্রমণের সেরা সময় হলো অক্টোবর-নভেম্বর মাস।
রিসোর্টে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে আমরা দুপুরের খাবার খেতে গেলাম। গরম ভাত, সবজি, পাহাড়ি মুরগির ঝোল আর ডাল—এই সাধারণ খাবারগুলোও সেখানে অসাধারণ লাগছিল। স্বাদটা মুখে লেগে থাকার মতো।
বিকেলে আমরা লুসাই গ্রাম, হেলিপ্যাড এবং কংলাক পাহাড় ঘুরে দেখলাম। কংলাক পাহাড় মূলত সাজেকের মূল উপত্যকা। প্রায় ১৮০০ ফুট উচ্চতায় অবস্থিত এই পাহাড়ের চূড়ায় দাঁড়ালে মনে হয় যেন পৃথিবী থমকে গেছে, এ যেন এক নতুন জগত।
আমাদের রাতের খাবারের মেন্যুতে ছিল বারবিকিউ আর পাহাড়ি মুরগি দিয়ে তৈরি বাম্বো বিরিয়ানি। সাজেক গিয়ে বাম্বো বিরিয়ানি না খেলে যেন ভ্রমণটাই অপূর্ণ থেকে যায়।
ঘুমোতে যাওয়ার আগে পাহাড়ের ঢালে নিস্তব্ধ পরিবেশে পূর্ণিমার চাঁদের আলোয় বন্ধুদের সাথে আড্ডা দেওয়ার স্মৃতি আজও অমলিন। সেই স্বর্গীয় আনন্দ হয়তো সারাজীবন মনে গেঁথে থাকবে।
পাহাড় আমাকে সৃষ্টিকর্তার কথা স্মরণ করিয়ে দেয়, সেখানকার প্রকৃতি নতুন করে ভাবতে শেখায়। পাহাড়ি অঞ্চলের নারীদের সংগ্রামী জীবন বেঁচে থাকার প্রেরণা জোগায় আর তাদের সংস্কৃতি আমাকে মুগ্ধ করে। তাই কবির সাথে সুর মিলিয়ে বলতে ইচ্ছে করে—‘এখন আমি একটা পাহাড় কিনতে চাই’।
লেখা: শিক্ষার্থী, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা।
এসইউ/এমএস