পটুয়াখালীসহ উপকূলীয় এলাকার মাটি ও পানিতে বাড়ছে লবণাক্ততার মাত্রা। গত এক দশকে লবণাক্ততার প্রভাবে নানামুখী সমস্যায় পড়েছেন এই অঞ্চলের কৃষকরা। বিশেষ করে কৃষি ব্যবস্থাপনায় যেমন পরিবর্তন আনতে হয়েছে তেমনি অনেক জমি হয়েছে অনাবাদি। ফলে আগে যেসব জমিতে দুই কিংবা তিনটি ফসল উৎপাদন করা যেত, তার অনেক জমিতেই এখন আমন ধান ছাড়া অন্য কোনো ফসল ফলানো সম্ভব হচ্ছে না।
Advertisement
বাংলাদেশ মৃত্তিকা সম্পদ উন্নয়ন ইনস্টিটিউটের তথ্য বলছে, প্রতি বছর পানি ও মাটিতে লবণের মাত্রা বাড়ছে। পটুয়াখালী ও বরগুনা জেলায় প্রতি মাসে মাটি ও পানির লবণাক্ততা পরিমাপ করে সংস্থাটি। এ বছর এপ্রিল মাসের তথ্য বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, পটুয়াখালী ও বরগুনা জেলার মধ্যে বরগুনা সদর উপজেলার উত্তর হেউবুনিয়া এলাকায় মাটিতে লবণাক্ততার মাত্রা সব থেকে বেশি। বিষখালী নদী সংলগ্ন এই এলাকার মাটিতে লবণের মাত্রা ১৫.৫৯ ডিএস/মিটার। যা অত্যধিক লবণাক্ত জমি হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। আর পটুয়াখালী জেলার মধ্যে সব থেকে বেশি লবণাক্ত কলাপাড়া উপজেলার টিয়াখালী ইউনিয়নের নাচনাপাড়া এলাকা। এই এলাকার মাটির লবণাক্ততার মাত্রা ৮.৭১ ডিএস/মিটার। যা মাঝারি মানের লবণাক্ত জমি হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে।
এদিকে জেলার বিভিন্ন নদীর পানি পরীক্ষার যে প্রতিবেদন উঠে এসেছে তা রীতিমতো চমকে ওঠার মতো। ২০২৩ সালের এপ্রিল মাসের প্রতিবেদনে দেখা যায়, পটুয়াখালী জেলার তেতুলিয়া নদীর দশমিনা পয়েন্টে পানিতে লবণাক্ততার মাত্রা ছিল ০.৬০ ডিএস/মিটার। যা সেচ কাজের জন্য ছিল নিরাপদ। কিন্তু ২০২৫ সালে একই পয়েন্টের রিপোর্ট বলছে, এপ্রিল মাসে পানিতে লবণের মাত্রা ১.৮৫ ডিএস/মিটার। যা সেচ কাজে ব্যবহারের জন্য ক্ষতিকর।
আরও পড়ুন-
Advertisement
একইভাবে জেলার গলাচিপা নদীতে ২০২৩ সালের এপ্রিল মাসের রিপোর্ট বলছে সেসময় পানিতে লবণের মাত্রা ছিল ০.৬৯ ডিএস/মিটার যা সেচ কাজের জন্য নিরাপদ। কিন্তু ২০২৫ সালে এপ্রিল মাসে সেই একই পয়েন্টে পানিতে লবণের মাত্রা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২.৫৬ ডিএস মিটার। যা সেচ কাজের জন্য ক্ষতিকর।
এদিকে সাগর থেকে কিছুটা দূরে পটুয়াখালীর লোহালিয়া নদীতে ২০২৩ সালের এপ্রিলে পানিতে লবণের মাত্রা ছিল .৫৫ ডিএস মিটার যা সেচ কাজের জন্য ছিল নিরাপদ। কিন্তু ২০২৫ সালের এপ্রিলের প্রতিবেদন বলছে বর্তমানে এই নদীতে ভাটার সময় লবণের মাত্রা দাঁড়িয়েছে ১.৩৫ ডিএস/মিটার। যা সেচ কাজের জন্য ক্ষতিকর।
বাংলাদেশ মৃত্তিকা সম্পদ উন্নয়ন ইনস্টিটিউটের পটুয়াখালী আঞ্চলিক কার্যালয়ের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা আশিক এলাহী বলেন, প্রতি মাসেই আমরা পটুয়াখালী ও বরগুনা জেলার মাটি ও পানির নমুনা পরীক্ষা করে থাকি। এই প্রতিবেদনে মাটি ও পানির লবণাক্ততা নিরুপণের পর কয়েকটি ক্যাটাগরিতে মন্তব্য করা হয়। মাটির ক্ষেত্রে অলবণাক্ত, অতিসামান্য লবণাক্ত, সামান্য লবণাক্ত, মাঝারি লবণাক্ত এবং অত্যধিক লবণাক্ত হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। এছাড়া পানির লবণাক্ত পরীক্ষা করার পর সেটি সেচ কাজের জন্য কেমন, তা মন্তব্য হিসেবে নিরাপদ, ক্ষতিকর এবং অধিক ক্ষতিকর হিসেবে চিহ্নিত করা হয়ে থাকে।
পটুয়াখালী জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরে সংরক্ষিত ২০০৮-২০০৯ অর্থবছর থেকে ২০১৮-২০১৯ অর্থ বছরের ফসলের চাষাবাদ চিত্র পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, আমন মৌসুমে ২০০৮-২০০৯ সালে জেলায় রোপা আমনের আবাদি জমির পরিমাণ ছিল ২,৯৪,২৯০ হেক্টর। আর ২০১৮-২০১৯ অর্থবছরে এসে জমির পরিমাণ কমে দাঁড়িয়েছে ২,৩৫,৩৮১ হেক্টরে। ধাপে ধাপে গত ১০ বছরের জেলায় আমন আবাদের জমির পরিমাণ কমেছে ৫৮ হাজার ৯০৯ হেক্টর। একইভাবে ২০০৮-২০০৯ সালে জেলায় মোট আউশের জমির পরিমাণ ছিল ৭৫ হাজার ৭০০ হেক্টর। সেখানে ২০১৮-২০১৯ সালে এসে জমির পরিমাণ কমে দাঁড়িয়েছে ২৯,৫২৫ হেক্টরে। এছাড়া ২০০৮-২০০৯ অর্থবছরে জেলায় মোট বোরো আবাদের জমি ছিল ৪৯৯০ হেক্টর, সেখানে ২০১৮-২০১৯ সালে জমির পরিমাণ কমে দাঁড়িয়েছে ৩২৪৮ হেক্টরে।
Advertisement
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক কৃষিবিদ মো. নজরুল ইসলাম বলেন, প্রতি বছর অনাবৃষ্টি, অতিবৃষ্টি, তাপদাহসহ অতি খরার মতো বিষয়গুলোর কারণে কৃষকদের নানামুখী সমস্যায় পড়তে হচ্ছে। ফলে কৃষকদের অনেক বেশি ঝুঁকি নিয়েই চাষাবাদ করতে হচ্ছে। পরিবর্তিত এই পরিস্থিতিতে লবণাক্ততার সঙ্গে খাপ খেতে পারে এমন ফসল চাষাবাদে আমরা কৃষকদের উদ্বুদ্ধ করছি। সেক্ষেত্রে এ অঞ্চলে সূর্যমুখী এবং ভুট্টা আবাদ কৃষকদের কাছে জনপ্রিয়তা পাচ্ছে।
পটুয়াখালী কলাপাড়া উপজেলার নীলগঞ্জ ইউনিয়নের কুমিড়মারা গ্রামের কৃষক জাকির হোসেন বলেন, ‘আগে ফসল ফলাতে বীজ কিংবা ফসলের জাত নিয়ে কোনো চিন্তা করা লাগতো না। তবে এখন আগে ভাবতে হয় কত দিনের মধ্যে ফসল ফলবে এবং জমিতে লবণ উঠে আসার আগেই আমাদের ফসল ঘরে তুলতে হবে। সকল জমিতে সকল ফসল হবে না, এজন্য আমাদের আগে ভাগেই নির্ধারণ করতে হয় কোন জমিতে আমরা ধান আবাদ করবো, আর কোন জমিতে আমরা শাক-সবজি বা অন্য ফসল আবাদ করবো।’
পটুয়াখালী কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে শুষ্ক মৌসুমে জেলার মোট আবাদি জমির ২৭.৫ ভাগ জমিতে কোনো ফসলই ফলানো সম্ভব হচ্ছে না। আর শঙ্কার বিষয় হচ্ছে বিগত বছরের থেকে এবার অনেক আগেই জমিতে লবণাক্ততা দেখা যাচ্ছে। পটুয়াখালী জেলার মোট আবাদি জমির পরিমাণ ৩ লাখ ৭ হাজর ৮৭৫ হেক্টর। এর মধ্যে লবণাক্ত জমির পরিমাণ এক লাখ ৫৫ হাজার ১৮০ হেক্টর। যা মোট জমির ৫০.৪ শতাংশ। এর মধ্যে ৪২ হাজার ৯৮০ হেক্টর জমিতে কৃষক কিছু কিছু ফসল চাষাবাদ করলেও তারা লাভবান হচ্ছেন না। আর ১৫ হাজার ৭৭০ হেক্টর জমিতে কোনো ফসলই চাষাবাদ করা সম্ভব নয়। প্রতি বছর মার্চ থেকে এপ্রিল মাসে জমির উপরিভাগে লবণের সাদা আস্তরণ পড়লেও এবার ফেব্রুয়ারির প্রথম দিকেই লবণের আস্তরণ দেখা যাচ্ছে। ফলে কৃষকদের দুশ্চিন্তার মাত্রা বাড়ছে। আর জেলার গলাচিপা এবং কলাপাড়া উপজেলায় এই লবণাক্ততার প্রভাব সব থেকে বেশি।
উপকূলীয় এলাকায় সরাসরি চাষাবাদে জড়িত কৃষকরা বলছেন, ফসল আবাদে আগে সাধারণত স্থানীয় বীজ বা সাধারণ বীজ ব্যবহার করলেও বর্তমানে চাষাবাদের আগেই লবণাক্ততার কথা মাথায় রেখে ফসলের জাত নির্ধারণ করতে হচ্ছে। বিশেষ করে কোন ফসল গুলো লবণাক্ত সহিষ্ণু এবং কোন ফসলগুলো এই প্রতিকূল পরিস্থিতি মোকাবিলা করে টিকে থাকতে পারবে সেসব জাত আবাদ করতে হয়। ফসলের জাত নির্বাচন করতে ভুল হলে লোকসানের মুখে পড়তে হয়। আর এসব কারণে এখন কৃষকদেরও অনেক বেশি সচেতন ও তথ্য সংগ্রহ করে রাখতে হচ্ছে।
উপকূলের কৃষি ও জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে সরকারের পাশাপাশি বিভিন্ন এনজিও কাজ করছে। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে কীভাবে কৃষকরা খাপ খেতে পারে সেজন্য তাদের পক্ষ থেকে বিভিন্ন সহযোগিতা করা হচ্ছে। উপকূলের আবহাওয়া বিবেচনা করে যেহেতু এখন লবণাক্ত জমিতে অন্য ফসল আবাদ করা সম্ভব হচ্ছে না সে কারণে সূর্যমুখী এবং ভুট্টা চাষে সহযোগিতা করছে এনজিওগুলো।
বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ব্র্র্যাক জেলার উপকূলীয় এলাকাগুলোতে কৃষকদের প্রণোদনা ও বিভিন্ন সহযোগিতা প্রদান করছে। ব্র্যাক ব্যাংকের ডিএমডি ও কৃষি বিশেষজ্ঞ সাব্বির হোসেন বলেন, ‘তাপমাত্রা বেড়ে যাচ্ছে, যেটা আমরা সবাই উপলব্ধি করতে পারছি। অলরেডি ১.৫ থেকে ১.৭ ডিগ্রি তাপমাত্রা বেড়ে গেছে। খরার কারণে অনেক জমি চাষাবাদ করা যাচ্ছে না, এছাড়া গত ২৫ থেকে ৩০ বছরে ২০ থেকে ২৫ পার্সেন্ট যদি বেড়ে গিয়ে থাকে সেটা আবাদের জন্য বড় বিষয়। যেহেতু কৃষি আমাদের প্রধান পেশা, সেহেতু কীভাবে এক ফসলি জমিগুলোতে দুই কিংবা তিন ফসলি জমিতে রূপান্তর করা যায়, তা নিয়ে আমরা কাজ করছি। মূলত ব্র্যাক ব্যাংকের সিএসআর তহবিল থেকে এই অঞ্চলের কৃষকের সহযোগিতা করা হচ্ছে।
কৃষি বিজ্ঞানীরা বলছেন, কৃষি একটি আদি ও নিত্য পরিবর্তনশীল শিল্প, যা সভ্যতা বিনির্মাণ করে। তাইতো জলবায়ু পরিবর্তনের এই সংকটেও কৃষি টিকে থাকবে। আর সেক্ষেত্রে কৃষি এবং কৃষকদের আধুনিক হতে হবে।
এফএ/এমএস