মুক্তিযুদ্ধের সময় সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধে জড়িত থাকার অভিযোগে করা মামলায় জামায়াত নেতাদের বিচার ও সাজা কার্যকর নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন আইনজীবী মোহাম্মদ শিশির মনির। কারাগারে থাকা জামায়াত নেতা এটিএম আজহারুল ইসলামের আপিল শুনানিতে এই প্রশ্ন তোলেন তিনি।
Advertisement
আইনজীবী মুহাম্মদ শিশির মনির সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে এটিএম আজহারুল ইসলামের খালাস চেয়ে আপিল আবেদনের শুনানিতে দ্বিতীয়, তৃতীয় ও চতুর্থ অভিযোগে রাষ্ট্র পক্ষের চতুর্থ, পঞ্চম, নবম ও দশম সাক্ষীর ওপর ভিত্তি করে যে তিনটি অভিযোগে তার মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছিল ওইসব অভিযোগের বিষয়ে দেওয়া সাক্ষী ও তাদের জেরার বিষয়ে যুক্তি তর্ক-উপস্থাপন করেন তিনি। শুনানির এক পর্যায়ে সাক্ষী ও দণ্ড নিয়ে প্রশ্ন তুলে আপিল শুনানিতে আইনজীবী শিশির মনির বলেন, রাষ্ট্রপক্ষের এমন এক সাক্ষী তার স্ত্রী কয়জন, সন্তান কতজন কবে প্রথম বিয়ে করেছিল এবং সন্তান কতজন বলতে পারেন না এসব সাক্ষীর ওপর ভিত্তি করে এটিএম আজহারুল ইসলামের দণ্ড হয়েছে। এমনকি তাদের একজন সাক্ষী আছেন ইংরেজি ১২ মাসের নাম না পারলেও ১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল এটিএম আজহারুলকে তিনি কোথায় কীভাবে দেখছেন সেটা বলছেন। এটা হাস্যকর।
এরপর এ সংক্রান্ত বিষয়ে আরও শুনানির জন্য বৃহস্পতিবার (৮ মে) পরবর্তী দিন ঠিক করেন সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ।
শুনানি শেষে মঙ্গলবার ব্রিফ করেন আইনজীবী শিশির মনির-ছবি ফেসবুক থেকে নেওয়া
Advertisement
মঙ্গলবার (৬ মে) প্রধান বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদের নেতৃত্বে সাত সদস্যের বিচারপতির আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ ও নিয়মিত বেঞ্চে এই শুনানি হয়। ব্যারিস্টার এহসান এ সিদ্দিক আগে শুনানি করলেও তার বাবা ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাক মারা যাওয়ায় এদিন শিশির মনির শুনানি করেন।
আরও পড়ুন
এটিএম আজহারের আপিল শুনানি বৃহস্পতিবার পর্যন্ত মুলতবি সংক্ষিপ্ত আদেশে তড়িঘড়ি করে কার্যকর করা হয়েছিল কাদের মোল্লার ফাঁসিশুনানিতে শিশির মনির বলেন, সাক্ষী ১৬১ ধারায় জবানবন্দি দেওয়ার পর কোর্টে আসার পর দেখলাম সে ঘটনার তারিখ-সময় বলতে পারছে না। পরে অনেক সাক্ষীকে কোর্টে আনা হয়নি। রাষ্ট্রপক্ষ থেকে ওই সময় ১৭ জনের তালিকা দিয়ে বলা হয়েছিল এরা আদালতে আসতে পারবেন না। ট্রাইব্যুনাল ওই আবেদন মঞ্জুর করেছিলেন। যে কারণে আসামি পক্ষ অনেক সাক্ষীকে জেরা করতে পারেনি। অথচ সাক্ষীদের জেরা করা বিশ্বব্যাপী স্বীকৃত। এটাই সাক্ষ্য আইনের বিধান। অথচ জেরা না করতে অ্যাক্ট ও রুলস পরিবর্তন করা হয়েছিল।
শিশির মনির বলেন, ওই সময় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের কোনো আদেশের বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে আসার সুযোগ ছিল না। বিচারটা ছিল রাজনৈতিক উদ্দেশ্য প্রণোদিত। তখন আমরা স্কাইপ কথোপকথন প্রকাশ, মেইল যোগাযোগের বিষয়গুলো বার বার বলেছি। কিন্তু আমাদের এসব বিষয় আপিল বিভাগ শুনতে রাজি হননি।
Advertisement
একটি মামলার হাজিরায় আদালতে এটিএম আজহার-ফাইল ছবি
সাক্ষী সুখরঞ্জন বালিকে ট্রাইব্যুনালের গেট থেকে আইনজীবীদের চোখের সামনে অপহরণ করে ভারতে নিয়ে আটক করে রাখা হয়েছিল। আমরা সিসিটিভির ফুটেজ দেখতে চেয়ে আবেদন করলে তা খারিজ করেছিল ট্রাইব্যুনাল।
রাষ্ট্রপক্ষের একজন সাক্ষী ট্রাইব্যুনালে এসে সাক্ষ্য দিতে না চাইলে তাকে আদালত থেকেই কারাগারে পাঠানো হয়।
জামায়াত নেতাদের প্রসঙ্গ টেনে শিশির মনির বলেন, ১৯৭১ সালের অপরাধের বিচারের জন্য স্বাধীনতার পর ১৯৭৩ সালে আইন করা হয়েছিল। সারাদেশে ২৮টি ট্রাইব্যুনাল করে বিচার শুরু হয়েছিল। অথচ ট্রাইব্যুনালে যেসব জামায়াত নেতার বিচার করা হয়েছে তাদের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের কোনো থানায় জিডি পর্যন্ত ছিল না।
১৯৭৩ সালের ওই আইন সংশোধর করে পরে আওয়ামী লীগ সরকার সিভিলিয়ানদের বিচারের বিধান করে। বিষয়টি নিয়ে ইন্টারন্যাশনাল সেমিনারের আয়োজন করেছিলেন প্রয়াত বিচারপতি টিএইচ খান। সেখানে দেশি–বিদেশি আইনজ্ঞরাও অংশ নিয়েছিলেন। তারা বলেছিলেন এই আইন ও ট্রাইব্যুনাল আন্তর্জাতিক মানের ছিল না।
আরও পড়ুন
নিবন্ধন ফিরে পেতে জামায়াতের আপিল শুনানি ১৩ মে সহকর্মীদের ভালোবাসায় সিক্ত ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাকএটিএম আজহারের বিষয়ে শিশির মনির বলেন, একজন সাক্ষী ছয় কিলোমিটার দূর থেকে দেখেছে পাকিস্তানিদের সঙ্গে এটিএম আজহার ট্রেন থেকে নেমে গ্রামে আগুন দিয়েছে। ঘটনার স্থান বর্ণনা করা হয়েছে এক জায়গায়, সাক্ষী বলছে অন্য জায়গায়। একজন সাক্ষী বলছে, তার ছেলে–মেয়ে কয়টি তা সে জানে না। কিন্তু পরের দিন বলছে দুজন। পরে তিনি ওইদিন আদালতকে বলেন, ‘আমি গতকাল ভুলে গিয়েছিলাম। তাই সন্তান কতজন মনে ছিল না। তার সাক্ষ্যও নেওয়া হয়েছে।’
আইনজীবী শুনানিতে বলেন, একজন সাক্ষী তার জবানবন্দির জেরায় বলেন, তার বিয়ে কবে হয়েছিল মনে নেই, তার জন্মতারিখ মনে নেই। তিনি ইংরেজি ১২ মাসের নাম বলতে না পারলেও ১৯৭১ সালের এপ্রিল মাসের ১৭ তারিখ এটিএম আজহারুল ইসলাম কী করেছিলেন সেটা ঠিকই বলছেন। আদালত সেটি গ্রহণ করে দণ্ড দিয়েছেন!
একজন সাক্ষী বলেছেন, তার বাবাকে কে মেরেছে তা তিনি দেখেননি, গুলিবিদ্ধ হয়ে আহত ছিলেন ওনার বাবা। কিন্তু বাবাও তাকে বলেননি কে তাকে গুলি করেছেন। অন্য একজন বলেছেন এটিএম আজহার মেরেছেন। একজন সাক্ষী কারমাইকেল কলেজের (বার্বুচি) পাচক। তিনি তৎকালীন সময়ের কারমাইকেল কলেজের অধ্যক্ষের নাম কি সেটা জানেন না, অন্য কোনো ছাত্র সংগঠনের নেতাদেরও চেনেন না। অথচ তিনি শুধু এটিএম আজহারুল ইসলামকে চেনেন বলে সাক্ষ্য দিয়েছেন। সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে গুরুত্বপূর্ণ এই মামলায় শুনানিতে সাক্ষীর জবানবন্দি ও জেরা এবং যুক্তিতর্ক তুলে ধরার সময় বিচারপতি ও আইনজীবীরা হেসে ওঠেন।
শুনানিতে আইনজীবী বলেন, একজন সাক্ষী বলেন, এটিএম আজহার ঝাড়ুয়ার বিলের গণহত্যার সঙ্গে জড়িত নন। আমরা আসামির পক্ষে বলেছি সাক্ষী বলেছেন, তিনি জড়িত নন৷ অথচ এ বিষয়ে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ আগের শুনানিতে বলেছেন, এখানে এটি সত্য নয় ধরে নিতে হবে বলেছিলেন। এসব সাক্ষ্যের ওপর ভিত্তি করে এটিম আজহারুল ইসলামকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছে। যদিও আপিল বিভাগের একজন বিচারপতি বলেন, এসব সাক্ষী বিশ্বাসযোগ্য নয়। পরে ওইসব অভিযোগ থেকে ওই বিচারপতি তাকে খালাসও দেন।
কাদের মোল্লার বিষয়ে শিশির মনির বলেন, কাদের মোল্লার রিভিউ আবেদন ২০১৩ সালের ১২ ডিসেম্বর খারিজ করা হয়। পরে সংক্ষিপ্ত আদেশে ওইদিন রাতেই তড়িঘড়ি করে তার ফাঁসি কার্যকর করে সরকার। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি বিতর্কিত নির্বাচন করার জন্য এই ফাঁসি কার্যকর করা হয়। কী কারণে রিভিউ খারিজ হলো সেটা আমরা জানতে পারিনি। সাধারণত আসামির মুক্তির জন্য সংক্ষিপ্ত আদেশ ফলো করা হয়। তবে কারও ফাঁসির জন্য সংক্ষিপ্ত আদেশ এটা প্রথম ঘটনা। উপমহাদেশে এমন নজির আর নেই।
এফএইচ/এসএইচএস/এমএফএ/জেআইএম