প্রত্যেক বছর ২৩ মে পালিত হয় বিশ্ব কচ্ছপ দিবস। এই দিনটি মূলত কচ্ছপ এবং অন্যান্য সরীসৃপ প্রজাতির সংরক্ষণে সচেতনতা তৈরির উদ্দেশ্যে পালন করা হয়। ২০০০ সালে আমেরিকার সংগঠন ‘আমেরিকান টরটয়েস রেসকিউ’ এই দিনটির সূচনা করে। তাদের লক্ষ্য ছিল মানুষের মাঝে কচ্ছপদের জীববৈচিত্র্য ও তাদের বিপন্নতার প্রসঙ্গে আলোড়ন তোলা। তবে এই দিবসটি শুধু একটি প্রাণীর রক্ষার ডাক নয়, এটি আমাদের জীবনের জন্যও এক অনন্য দর্শন তুলে ধরে।
Advertisement
আমরা ছোটবেলায় সবাই পড়েছি সেই বিখ্যাত গল্প...খরগোশ ও কচ্ছপের দৌড়। একদিকে গতি, অন্যদিকে ধৈর্য; একদিকে আত্মতৃপ্তি, অন্যদিকে একাগ্রতা। এই গল্পটি আজও শুধু শিশুদের মনোরঞ্জনের জন্য নয়, বরং জীবনের এক বাস্তব রূপক হয়ে আছে। এই দৌড়ের গল্পে যেমন কচ্ছপ জেতে ধৈর্য, অবিচলতা আর একনিষ্ঠ প্রচেষ্টায়, তেমনি বাস্তব জীবনেও এই গুণগুলো সফলতার চাবিকাঠি হয়ে ওঠে।
আজকের দিনে দাঁড়িয়ে আমরা অনেকটা সেই খরগোশের মতো হয়ে উঠেছি। ক্যারিয়ার, সাফল্য, সামাজিক মর্যাদা, অর্থ-সম্পদ, সুখের প্রদর্শনী সব কিছুতেই চলছে এক অন্তহীন দৌড়। কে আগে চাকরি পেল, কে আগে গাড়ি কিনলো, কে কোথায় ঘুরতে গেল সোশ্যাল মিডিয়ায় এসব বিষয়ই যেন ব্যক্তিগত উন্নতির সূচক হয়ে উঠেছে। অথচ এই প্রতিযোগিতা আমাদের মানসিকভাবে বিপর্যস্ত করে তুলছে। হতাশা, আত্মসমালোচনা, মানসিক চাপ এসব ক্রমাগত গ্রাস করছে আমাদের ভিতরকার শান্তিকে।
এখানেই কচ্ছপ আমাদের সামনে দাঁড় করায় এক বিকল্প পথ। সে বলে, ‘তাড়াহুড়ো নয়, ধৈর্য ধরো। নিজের গতিতে এগিয়ে চলো।’ ধীরে চলা মানেই থেমে যাওয়া নয়। বরং প্রতিদিন অল্প করে চেষ্টা করা মানেই দীর্ঘমেয়াদে স্থায়ী সাফল্যের দিকে এগিয়ে যাওয়া। কচ্ছপের মতো চলা মানেই নিজের ওপর আস্থা রাখা, নিজের লক্ষ্য ঠিক রাখা এবং প্রতিনিয়ত তা অর্জনের চেষ্টা চালিয়ে যাওয়া।
Advertisement
প্রকৃতিতে কচ্ছপ এক বিস্ময়কর প্রাণী। এটি পৃথিবীর সবচেয়ে প্রাচীন প্রাণীদের একটি, প্রায় ২২ কোটি বছর ধরে এরা পৃথিবীতে টিকে আছে। এদের জীবনের গড় আয়ুও অনেক দীর্ঘ। অনেক প্রজাতির কচ্ছপ ১০০ বছরের বেশি বাঁচে। ধীর, স্থির ও নিরাপদভাবে চলাই তাদের টিকে থাকার কৌশল। এই বৈশিষ্ট্যগুলো আমাদের জীবনেও কার্যকর হতে পারে।
আমরা প্রায়ই দেখি, সমাজে যারা ধৈর্য ধরে, একাগ্রচিত্তে ও ক্রমাগত উন্নতির চেষ্টা করেন, তারাই শেষমেশ সফল হন। উদ্যোক্তা, ক্রীড়াবিদ, লেখক, গবেষক যে কোনো পেশার মানুষই যদি নিয়মিত চেষ্টা করে, তাহলে ধীরে হলেও লক্ষ্য অর্জন সম্ভব। একবারের জন্য হলেও আমাদের ভাবা উচিত, প্রতিদিন অল্প অল্প করে নিজেকে গড়ার চেষ্টা করলে দীর্ঘমেয়াদে তা কী অসাধারণ রূপ নিতে পারে।
খরগোশের মতো আত্মঅহংকার ও প্রতিপক্ষকে তাচ্ছিল্য করার মানসিকতা বাস্তব জীবনেও বড় ক্ষতির কারণ হতে পারে। কচ্ছপের মতো নিজের সীমাবদ্ধতা বুঝে, আত্মবিশ্বাস রেখে এগিয়ে চলা একদমই আলাদা ফল বয়ে আনে।
বর্তমান প্রজন্ম সবকিছুর তাৎক্ষণিক ফল চায়। যাকে বলে ‘ইনস্ট্যান্ট গ্র্যাজিফিকেশন’। পড়াশোনায় তাড়াতাড়ি ভালো রেজাল্ট, ডায়েটে দ্রুত ওজন কমানো, ব্যবসায় দ্রুত লাভ, প্রেমে দ্রুত প্রতিফল এটাই যেন আজকের বাস্তবতা। কিন্তু আমরা ভুলে যাচ্ছি, প্রকৃত সাফল্য কোনো ম্যাজিক নয়। এটি সময়, পরিশ্রম এবং ধৈর্যের ফসল।
Advertisement
বিশ্ব কচ্ছপ দিবসে তাই আমরা শুধু কচ্ছপ সংরক্ষণের বার্তা ছড়াবো না, বরং এর গভীরে থাকা জীবনের পাঠও গ্রহণ করবো। আমরা যেন কচ্ছপের মতো হয়ে উঠি ধীর, অথচ দৃঢ়। আমাদের যাত্রা যেন হয় আত্মবিশ্বাসী, নিয়মিত এবং স্থির লক্ষ্যের দিকে।
যারা এখনো জীবন নিয়ে দুশ্চিন্তায় আছেন, অন্যের সাফল্যের সঙ্গে নিজের জীবন তুলনা করে ভেঙে পড়ছেন, তাদের জন্য বিশ্ব কচ্ছপ দিবস হতে পারে; আত্মবিশ্বাস ফিরে পাওয়ার এক আশার আলো। মনে রাখুন, দ্রুত ছুটে গেলেই যে গন্তব্যে পৌঁছানো যাবে তা নয়। ধৈর্য, নিষ্ঠা, এবং নিজের গতিতে এগিয়ে চলার মধ্যেই লুকিয়ে আছে প্রকৃত বিজয়।
আজকের দিনে, বিশ্ব কচ্ছপ দিবসে, আসুন আমরা এই কথাগুলো মনে রাখি ‘তুমি পিছিয়ে নেই, তুমি কেবল তোমার নিজের গতিতে এগিয়ে চলছো।’
আরও পড়ুন চায়ের ইতিহাসে লুকিয়ে আছে শ্রমিকের নীরব কষ্ট সিলেটের মণিপুরী শাড়ি বাংলার নতুন সাংস্কৃতিক পরিচয়তথ্যসূত্র: আমেরিকান টরটয়েস রেসকিউ, ওয়ার্ল্ড টার্টল ডে
কেএসকে/জিকেএস