শিশুদের অনেক আচরণ বড়রা কখনও দুষ্টুমি, কখনও বেয়াদবি হিসেবে দেখে পাশ কাটিয়ে যান। অভিভাবকরাও অনেক সময় ভেবে দেখেন না যে শিশুটি অন্যসময়ের থেকে আলাদা আচরণ কেন করছে, সে কি কোনো মানসিক সমস্যায় ভুগছে কিনা।
Advertisement
আমেরিকান একটি গবেষণায় দেখা গেছে ৩ থেকে ১৭ বছর বয়সী শিশুদের ২০ শতাংশ কোনো না কোনো মানসিক সমস্যায় ভোগে। উচ্চমাধ্যমিক শেষ করতে করতে ৪০ শতাংশের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা দেখা যায়। দেশ ও সংস্কৃতি আলাদা হওয়ায় এ পরিসংখ্যানে কিছু ভিন্নতা আসতে পারে। কিন্তু তা যে কমই হবে, এ কথা নিশ্চিত হয়ে বলা যায় না। কারণ বাংলাদেশে মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে কথা বলা এখনও অনেকটাই ট্যাবু হয়ে আছে। তবে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের সঠিক বিকাশের জন্য এ বিষয়ে কথা বলতেই হবে।
ডিপ্রেশন বা মানসিক অবসাদ এই শব্দের সঙ্গে আমরা কমবেশি সকলেই পরিচিত। আমরা জানি ডিপ্রেশনে শুধু বড়রাই ভোগে। তবে আপনি শুনে অবাক হবেন ছোটদেরও ডিপ্রেশন হয়, যাকে চাইল্ডহুড ডিপ্রেশন বলা হয়। শিশুদের মানসিক সমস্যার মধ্যে ডিপ্রেশন উল্লেখযোগ্য।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব হেলথ ইকোনমিক্স-এর গবেষণা (২০১৯) অনুসারে, বাংলাদেশে স্কুলগামী শিশুদের ৭-১০ শতাংশ ডিপ্রেশন বা অ্যাংজাইটিতে ভোগে। তবে সঠিকভাবে জানা না থাকার কারণে শিশুদের ডিপ্রেশন সেভাবে খেয়াল করা হয় না। তবে তাদের আচরণের মাধ্যমেই ডিপ্রেশনের অনেক লক্ষণ প্রকাশ পায়। বিষণ্নতার কারণে পড়াশোনা কাজকর্মে, ব্যক্তিগত জীবনে এবং দৈনন্দিন কাজে প্রভাব পড়ে।
Advertisement
গ্রামের শিশুরা মা-বাবা ও পরিবারের অন্য সদস্যদের কাছে পেলেও শহরের শিশুদের জীবনে ভিন্নতা রয়েছে। শহরে মা-বাবা বেশিরভাগই চাকরি করেন এবং শিশুর দাদা-দাদিও কাছে থাকে না। ফলে সারাদিন বাসায় একাই সময় কাটে। রাতে যখন মা-বাবা অফিস থেকে আসে তার একটু পরেই তারা ঘুমিয়ে যায়। একটি শিশুর মানসিক ও আবেগীয় বিকাশের পেছনে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে মা-বাবা। তবে এসব শিশুরা মা-বাবার সঙ্গে গল্প, আড্ডা এবং মনের কথা শেয়ার করতে পারে না। এই একা থাকার কারণে নিজেকে আলাদা ভাবতে শুরু করে, যা ধীরে ধীরে মনে বিষণ্নতা তৈরি হয়। অনেক শিশু একা থাকা সহ্য করতে পারে না। অনেক সময় তাদের আচরণে বিরক্তি, রাগ, কান্নাকাটি বা নিস্তেজতা দেখা যায়, যেগুলো মূলত তার ভেতরের শূন্যতা ও ভালোবাসার ঘাটতির বহিঃপ্রকাশ।
২. পারিবারিক অশান্তিশিশুদের মানসিক বিকাশে পরিবার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। বিশেষ করে মা-বাবা। শিশুর সামনে ঝগড়া, অসহিষ্ণু আচরণ এবং একে অন্যকে গালিগালাজ করলে তা তাদের মনে গভীর আঘাত ফেলে। পরিবারে নিয়মিত এসব কার্যকলাপ দেখতে দেখতে এক সময় তারা বিষণ্নতায় পড়ে যায়।
৩. অতিরিক্ত শাসন অথবা অবহেলাঅতিরিক্ত শাসন শিশুর স্বাধীনতা ও আত্মবিশ্বাস হরণ করে। শিশুরা স্বভাবতই কৌতূহলী, আবেগপ্রবণ ও ভালবাসার ক্ষুধায় ভোগে। তারা চায় কেউ শুনুক, বোঝার চেষ্টা করুক, আদর করুক এবং সময় দিক। যখন মা-বাবা শুধু উপদেশ দেন, কিন্তু পাশে বসে গল্প করা, খেলাধুলা করা বা তার অনুভূতি জানার চেষ্টা করেন না, তখন শিশুর মন নিঃসঙ্গতায় ভরে ওঠে। নিজেকে পরিবারে অপ্রয়োজনীয় ভাবতে শুরু করে, যা হতাশার কারণ হতে পারে।
৪. শিক্ষা ও পরীক্ষার চাপবর্তমান সমাজে শিশুদের পড়াশোনার নিয়ে অতিরিক্ত চাপ লক্ষ্য করা যায়। তাদের বয়সের তুলনায় বাড়তি বই দেওয়া হয়। যার ফলে অতিরিক্ত পরিমাণে বই বহন করা ও পড়াশোনা করা শিশুর জন্য কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। ভালো ফল করার জন্য পরিবারের চাপ, স্কুলের প্রতিযোগিতা, কিংবা নিজেকে অযোগ্য মনে করার ভাবনা শিশুদের মধ্যে দুঃখ, আতঙ্ক ও মানসিক চাপ তৈরি করে।
Advertisement
স্কুলে সহপাঠীদের দ্বারা উপহাস, ঠাট্টা, মারধর বা অবহেলা শিশুদের আত্মমর্যাদায় আঘাত করে। এতে তারা নিজেদের দুর্বল, অবাঞ্ছিত ও অক্ষম ভাবতে শুরু করে। নিয়মিত এসব আচরণে সম্মুখীন হওয়ার কারণে একটা সময় মানসিক সমস্যা তৈরি হয়।
৬. বন্ধুহীনতাবর্তমান সময়ে পড়াশোনা চাপ ও পরিবারের অতিরিক্ত শাসনের কারণে অনেক শিশুদেরই বন্ধু নেই। ফলে খেলাধুলা করা, নিজের মনের কথা শেয়ার করা মতো কাউকে পায় না। এতে তারা সহজেই একাকীত্বে ভোগে। এর ফলে ধীরে ধীরে তাদের মনে বিষণ্নতা সৃষ্টি হতে পারে।
৭. শারীরিক বা যৌন নির্যাতনশিশু যখন পরিবার বা পরিচিত কারো দ্বারা নির্যাতনের শিকার হয়, তখন তাদের মন ও শরীর দুটিই ভয়ানক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এ ছাড়া মেয়ে শিশুরা প্রায়ই আত্মীয়, প্রতিবেশী এবং স্কুলের শিক্ষকের হাতে যৌন নির্যাতনের শিকার হয়। এসব ঘটনা তারা কারো সঙ্গে শেয়ার করতে বা সহ্য করতে পারে না, ভয় ও লজ্জার কারণে চুপ থাকে, যা ডিপ্রেশনের অন্যতম বড় কারণ।
৮. আত্মসম্মান বোধের ঘাটতিযদি শিশুকে বারবার নেতিবাচক কথা বলা হয়, যেমন 'তুই পারবি না', 'তুই অকেজো', 'তোর দ্বারা কিছু সম্ভব না' তাহলে শিশুর মধ্যে নিজেকে ছোট বা তুচ্ছ ভাবার প্রবণতা তৈরি হয়। এতে আত্মমর্যাদাহীনতা থেকে তৈরি হয় হতাশা।
৯. প্রিয়জনের মৃত্যু বা হারিয়ে যাওয়াযদি পরিবারের কেউ মারা যায় বা কোনো কারণে দূরে চলে যায় (যেমন প্রবাসে যাওয়ায় মা-বাবা আলাদা), তাহলে শিশুর মনে শোক, অভাব ও ভালোবাসার ঘাটতি তৈরি হয়। এতে শিশুর মনে আলাদা একটা কষ্টের সৃষ্টি হয়, যা ধীরে ধীরে বিষণ্নতার রূপ নেয়।
১০. দীর্ঘমেয়াদি শারীরিক অসুস্থতা বা প্রতিবন্ধকতাযেসব শিশু দীর্ঘদিন অসুস্থ থাকে বা কোনো শারীরিক প্রতিবন্ধকতা রয়েছে, তারা অনেক ক্ষেত্রেই নিজেকে আলাদা বা দুর্বল মনে করে। এটা এক প্রকার মানসিক অবসাদ তৈরি করে।
১১. প্রযুক্তি আসক্তিতথ্য প্রযুক্তির এই যুগে বেশিরভাগ শিশুই স্মার্টফোন ব্যবহার করে। এতে অতিরিক্ত পরিমাণে গেম খেলা ও ফেসবুক, ইউটিউবসহ বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আসক্ত হয়ে পড়ে। এতে শিশুটি বাস্তব জীবন থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। এটি সামাজিক দক্ষতা কমিয়ে দেয় এবং একাকীত্ব ও বিষণ্নতার জন্ম দেয়।
শিশুদের ডিপ্রেশন একটি বাস্তব সমস্যা। এটি অবশ্যই আমাদের গুরুত্ব দেওয়া উচিত এবং এর চিকিৎসা করা প্রয়োজন। সময়মতো বোঝা, ভালোবাসা, সহানুভূতি ও সঠিক দিকনির্দেশনা না পেলে ভবিষ্যতে কঠিন অবস্থার মুখোমুখি হতে হবে এসব শিশুদের। তাই এই কারণগুলোর কোনোটি আপনার শিশুর জীবনে উপস্থিত থাকলে আজই এই বিষয়ে সচেতন হন। প্রয়োজনে শিশু মনোরোগ বিশেষজ্ঞের সঙ্গে কথা বলুন। সঠিক সময়ে শিশুর দেহের পুষ্টি চাহিদার সমানই গুরুত্বপূর্ণ তার মানসিক চাহিদা।
এএমপি/এমএস