প্রতিটি অফিসের ঘড়ির কাঁটা প্রতিদিন ঠিক সময়ে ঘোরে, ফাইল ওঠানামা করে, মিটিং চলে, ই-মেইল পাঠানো হয়; তবুও কিছু অফিস প্রাণবন্ত, আর কিছু একঘেয়ে। পার্থক্যটা কোথায়? সেই প্রাণটা আসে মানুষ দিয়ে, আর মানুষ চালিত হয় সম্পর্ক দিয়ে। অফিস হোক বা ফ্যাক্টরি, ক্লাসরুম হোক বা মাঠ; কাজের জগতে সবচেয়ে উপেক্ষিত কিন্তু সবচেয়ে জরুরি জিনিসটি হলো ‘সম্পর্ক’।
Advertisement
আপনি যদি কারও সঙ্গে আন্তরিকভাবে কথা বলেন, তার সমস্যায় পাশে থাকেন, তার পরিশ্রমকে স্বীকৃতি দেন; তবে দেখবেন সেই মানুষটিই আপনার কথায় কাজ করতে আগ্রহী হয়ে উঠছে। তাকে কড়া নির্দেশনা বা নিয়ম চাপিয়ে দিতে হচ্ছে না। একটা সুস্থ সম্পর্কের আবহে মানুষ স্বতঃস্ফূর্তভাবে নিজের সেরাটা দিতে চায়।
আজকের কর্পোরেট দুনিয়ায় যেখানে ‘ডেডলাইন’, ‘টার্গেট’, ‘পারফরম্যান্স রিভিউ’, এসব শব্দই নিয়ম বানিয়ে ফেলেছে, সেখানে একজন নেতার সবচেয়ে বড় শক্তি হতে পারে তার দলের সবার সঙ্গে গড়ে ওঠা সুসম্পর্ক। আপনি মানুষকে বোঝার চেষ্টা করুন, তাকে বিশ্বাস করুন ও সম্মান দিন দেখবেন সে কাজে তার সর্বোচ্চটা দিবে। সম্পর্ক মানে শুধু ভালো ব্যবহার নয়, সম্পর্ক মানে বোঝাপড়া, আন্তরিক যোগাযোগ এবং সম্মানজনক সহাবস্থান। আর যখন সেই সম্পর্ক সত্যিকারের হয় তখন দায়িত্ব আর দায়িত্ব থাকে না, তা হয়ে ওঠে নিজস্ব উদ্যোগের অংশ।
কেননা জীবনে সফল হতে হলে শুধু নিজের দক্ষতাই যথেষ্ট নয়, প্রয়োজন সঠিক কৌশলে অন্যদের সাহায্য নেওয়ার। একজন মানুষ একা সব দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিতে পারেন না, বিশেষত যখন সেই দায়িত্বগুলো বিভিন্ন খাতে বিভক্ত। তাই কৌশলগতভাবে দলকে পরিচালনা করাই প্রকৃত নেতৃত্বের চাবিকাঠি।
Advertisement
আরও পড়ুন:
লাইক-কমেন্টের ফাঁদে মৃত্যু: সোশ্যাল মিডিয়া যখন জীবনের হুমকি রাস্তায় আঁকা রহস্য: চিহ্নগুলোর ভাষা বুঝলে বাঁচবে জীবন একা নন, একসঙ্গে চলা প্রয়োজনধরুন আপনি একটি কোম্পানির সিইও। প্রোডাকশন, মার্কেটিং, ক্লায়েন্ট ম্যানেজমেন্ট সবকিছু সামলানো আপনার দায়িত্বের মধ্যে পড়ে। যদিও এই কাজগুলো আপনি বিভিন্ন টিম মেম্বারের মধ্যে ভাগ করে দিয়েছেন, তবুও আপনাকে প্রত্যেকটি খুঁটিনাটি বিষয়ে নজর রাখতে হয়।
এমন পরিস্থিতিতে যদি আপনার সামনে জটিল একটি পরিকল্পনার কাজ আসে, সেটি মনোযোগ দিয়ে শেষ করতে হলে আপনাকে অন্য দিক থেকে নিজেকে সাময়িকভাবে সরিয়ে রাখতে হবে। কিন্তু বাকি কাজের চাপ মাথায় থাকলে আপনি তা পারবেন না, যদি না আপনি সঠিক কৌশল প্রয়োগ করেন।
বিকল্পের স্বাধীনতা বাড়ায় উৎসাহমনোবিজ্ঞান বলছে, মানুষ যখন সিদ্ধান্ত নেয়ার স্বাধীনতা পায়, তখন তার কাজ করার আগ্রহ অনেক বেড়ে যায়। একটি নির্দিষ্ট পদ্ধতিতে কাজ করতে বাধ্য করলে মানুষ বিরক্ত হয়ে পড়ে। কিন্তু তাকে যদি বিকল্প বেছে নেওয়ার সুযোগ দেওয়া হয়, তখন সে কাজটিকে নিজের মত করে সম্পন্ন করতে আগ্রহী হয়।
Advertisement
চার্লস ডুহিগ তার বই ‘স্মার্টার, ফাস্টার, বেটার’ এ এই বিষয়টি দারুণভাবে ব্যাখ্যা করেছেন। তার মতে, মানুষ যখন নিজের মতো করে সিদ্ধান্ত নিতে পারে, তখন সে আরও সচেতনভাবে ও মনোযোগ দিয়ে কাজ করে।
ধরুন একটি বাচ্চাকে আপনি খেলনার দোকানে নিয়ে গিয়ে নিজের পছন্দের খেলনা কিনে দেন, সে খুশি হবে। কিন্তু যদি আপনি তাকে বলেন, তুমি তোমার পছন্দের খেলনাটি বেছে নাও, তখন তার খুশি আরও দ্বিগুণ হয়ে যাবে। সে নিজে সিদ্ধান্ত নিচ্ছে এই অনুভবই তাকে আনন্দ দিচ্ছে।
এই সিদ্ধান্ত নেওয়ার স্বাধীনতাই মানুষকে দায়িত্ববান করে তোলে। শুধু শিশুকালেই নয়, প্রাপ্তবয়স্ক হয়েও মানুষ নিজের মতো করে সিদ্ধান্ত নিতে ভালোবাসে।
কর্মক্ষেত্রে চয়েসের প্রয়োগএই মনস্তত্ত্ব কাজে লাগিয়ে আপনি আপনার সহকর্মী, অধীনস্থ কর্মী বা সহায়কদের দিয়ে কাজ করিয়ে নিতে পারেন আরও সহজে ও দক্ষভাবে।
যেমন- একটি এক ঘণ্টার কাজে দশ মিনিটের বিরতি রাখা যাবে। আপনি যদি সহকর্মীকে বলেন, তুমি যেকোনো সময় বিরতি নিতে পারো তবে সে নিজেই সময় বেছে নিয়ে বিরতি নেবে এবং তত বেশি উৎসাহ নিয়ে কাজটিও করবে।
কিংবা অফিসে যদি অতিরিক্ত কাজ জমে যায়, আপনি তাকে বলতে পারেন, তুমি চাইলে আজ অফিসের পরে বা ছুটির দিনে কিছুক্ষণ সময় বের করে আমাকে সাহায্য করতে পারো। এতে তার মনে হবে সে নিজের সিদ্ধান্তে আপনাকে সাহায্য করছে, ফলে সে কাজটিও আন্তরিকতা দিয়ে করবে।
ঘরের ভেতরেও একই কৌশল কার্যকরএই কৌশল শুধু অফিসে নয়, পরিবার বা ব্যক্তিগত জীবনেও দারুণভাবে কার্যকর। যেমন: সন্তান ঠিকমতো পড়ছে না? তাকে চাপ না দিয়ে বলুন, সকাল ও সন্ধ্যা এই দুই সময়ের মধ্যে কখন পড়তে চাও তুমি? এতে সে মনে করবে তার মতামত গুরুত্বপূর্ণ।
সিদ্ধান্ত গ্রহণের স্বাধীনতা মানে দায়িত্ববোধের উন্মেষএই পদ্ধতির সবচেয়ে বড় উপকারিতা হলো মানুষ কাজটিকে নিজের দায়িত্ব হিসেবে নেয়। কারণ সে মনে করে সিদ্ধান্তটি তার নিজের। ফলে কাজটি আরও যত্ন ও নিষ্ঠার সঙ্গে হয়। এই স্বাধীনতা কাউকে কৌশলে দিলেও, সে অনুভব করে তার মূল্যায়ন করা হচ্ছে। ফলে আপনার কাজও হয়ে যায়, আর সে নিজেও হয়ে ওঠে আরও অ্যাকটিভ।
‘দ্যা পাওয়ার অফ চয়েস’-এই কৌশলটি মানুষকে শুধু মোটিভেট করে না, বরং তাদের আত্মবিশ্বাসও বাড়ায়। সিদ্ধান্ত নেওয়ার সুযোগ দিলে তারা কাজটিকে নিজের ভাবেই দেখে এবং ফলাফল হয় আরও সুন্দর। একজন দক্ষ নেতা বা অভিভাবক হিসেবে যদি আপনি এই কৌশলটি বুঝে কাজে লাগান, তাহলে আপনি সহজেই অন্যদের উৎসাহ দিয়ে বড় বড় কাজ করে নিতে পারবেন।
জেএস/এমএস