নভেম্বর, ২০১২। মেক্সিকোর প্যারেডন, চিয়াপাস এলাকার শান্ত সমুদ্রতীর। সকালবেলা। মাছ ধরার প্রস্তুতি নিচ্ছেন জোসে সালভাদর আলভারেঙ্গা, পেশায় একজন অভিজ্ঞ মৎস্যজীবী। সঙ্গে আছেন তরুণ এজেকিয়েল কর্ডোবা, সদ্য পরিচিত এক সহযাত্রী। তাদের গন্তব্য প্রশান্ত মহাসাগরের গভীর জলের দিকে, যেখানে বড় মাছের আশা থাকে। একটা মাঝারি আকারের ফাইবার নৌকা, সঙ্গে বরফ, মাছ ধরার জাল, কিছু শুকনো খাবার আর পানির বোতল।
Advertisement
কিন্তু প্রকৃতি কি আর মানুষের পরিকল্পনা মেনে চলে? যাত্রার একদিন পরেই এক ভয়াবহ সমুদ্র ঝড় তাদের নৌকাকে পুরোপুরি দুর্বল করে দেয়। ঘন কালো মেঘ, উল্টো হাওয়া, উচ্ছ্বসিত ঢেউ সব মিলে তারা দিক হারিয়ে ফেলেন। নৌকার রেডিও ও জিপিএস কাজ করা বন্ধ করে দেয়। শুরু হয় এক ভয়াবহ, অনিশ্চিত, অথচ বাস্তব সমুদ্র-নাটক।
প্রথমদিকে তারা ভেবেছিলেন, কেউ না কেউ বাঁচাতে আসবেই। দুই-তিন দিন, এক সপ্তাহ, তারপর এক মাস...কেউ এল না। খাদ্য ফুরিয়ে আসতে থাকে। তারা শুরু করেন মাছ ধরা। কাঁচা মাছ, কচ্ছপ, উড়ন্ত মাছ, এমনকি সামুদ্রিক পাখিও ধরতে থাকেন। বৃষ্টির পানি জমানো হয় পলিথিনে, কখনো আবার নিজেদের প্রস্রাব পান করতেও বাধ্য হন।
তবে শারীরিক কষ্টের চেয়েও বড় ছিল মানসিক ভাঙন। বিশেষ করে তরুণ কর্ডোবার জন্য। স্রোতের টানে, বাতাসের ধাক্কায়, দিন আর রাতের চক্রে বেঁচে থাকা ছিল অসম্ভবের কাছাকাছি। কয়েক সপ্তাহ পর, কর্ডোবা অসুস্থ হয়ে পড়েন। জ্বর, ডায়রিয়া, অবসাদ- একদিন নিঃশব্দে তার মৃত্যু হয়। জোসে তাকে সাগরে ভাসিয়ে দেন না, দিনের পর দিন পাশে রেখে সঙ্গ পেতে চান। শেষে, সংক্রমণের আশঙ্কায় সাগরে বিদায় দেন।
Advertisement
এরপর দীর্ঘ একাকী যুদ্ধ। দিনের পর দিন সূর্যের উত্তাপে ঝলসে যাওয়া, রাতের অন্ধকারে শূন্য দৃষ্টি, মাছ খেতে খেতে একঘেয়েমি, কখনও গভীর কষ্টে আত্মহত্যার চিন্তা। কিন্তু কোথা থেকে যেন জেগে উঠত বেঁচে থাকার ইচ্ছে। জোসে হয়ত মনে করতেন, ‘আমি মরতে পারি, কিন্তু আমি নিজেকে খেয়ে মরব না।’
১৪ মাস পরে, ২০১৪ সালের জানুয়ারি মাস। সে এক অলৌকিক দিন। জোসে তার নৌকাসহ ভেসে আসেন মার্শাল দ্বীপপুঞ্জের ইবন দ্বীপে। ক্লান্ত, পঙ্গুপ্রায়, ওজন কমে গিয়েছে অর্ধেকেরও বেশি। তাকে দেখে দ্বীপের মানুষ প্রথমে বিশ্বাস করতে পারেনি এই মানুষ সত্যিই ১৪ মাস ধরে সমুদ্রে ভেসে ছিল।
বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে পড়ে খবর। কেউ বলল বানানো গল্প, কেউ বলল অলৌকিক ঘটনা। তবে চিকিৎসক, বিশেষজ্ঞ, নেভিগেশন বিশারদরা বলেন হ্যাঁ, এই কাহিনি সত্যি। বিজ্ঞান বলছে, তার শরীরের চর্বি ও মানসিক দৃঢ়তা তাকে বাঁচিয়ে রেখেছিল। তিনি নিজের অভিজ্ঞতা নিয়ে লিখেছেন বই ‘৪৩৮ ডেইজ: অ্যান এক্সট্রাঅরডিনারি ট্রু স্টোরি অব সার্ভাইবাল অ্যাট সি’, যা পড়ে বোঝা যায়, মানুষ কীভাবে অতিমানবীয় সংকটেও বেঁচে থাকতে পারে।
আজ জোসে আলভারেঙ্গা বেঁচে আছেন, তবে তিনি আর কখনো সমুদ্রে যান না। সমুদ্রের প্রতি ভালোবাসা তার শেষ হয়নি, কিন্তু সেই গভীর নীল জলরাশি তার কাছে এক বিষণ্ন স্মৃতির নাম। জোসের গল্প আমাদের শেখায় জীবনের ঝড় যত বড়ই হোক, বেঁচে থাকার শক্তি যদি থাকে, তবে সমুদ্রও ফিরিয়ে দিতে পারে, যাকে সে গিলে ফেলেছিল।
Advertisement
আরও পড়ুন
কয়লা শ্রমিকের ঘামে জ্বলে উঠে শহরের বাতি ৯০ দশকের ছেলেমেয়ের স্মৃতিতে আজও সতেজ টমটম গাড়িতথ্যসূত্র: সিএনএন: দ্য রিয়েল লাইফ ক্যাস্টঅ্যাওয়ে, ফোর থার্টি-এইট ডেইজ বুক।
কেএসকে/এমএস