দেশজুড়ে

কোটি টাকার রাস্তায় হাত দিলেই উঠে আসছে পিচ

কোটি টাকার রাস্তায় হাত দিলেই উঠে আসছে পিচ

সরকারি অর্থে নির্মিত রাস্তা টিকলো না তিনদিনও! বগুড়ার তিনটি ভিন্ন এলাকায় সম্প্রতি নির্মাণ বা সংস্কার করা রাস্তার কার্পেটিংয়ের অবস্থা এমনই করুণ যে, কোথাও হাতের টানেই উঠে যাচ্ছে পিচ, আবার কোথাও চাকার চাপে দেবে গিয়ে সৃষ্টি হচ্ছে ছোট-বড় গর্ত। একাধিক দুর্ঘটনাও ঘটেছে এর ফলে।

Advertisement

এলাকাবাসী বলছেন, নিম্নমানের নির্মাণ সামগ্রী ও ঠিকাদারদের গাফিলতির সঙ্গে স্থানীয় প্রকৌশলীদের অবহেলা ও যোগসাজশ না থাকলে এমন দুর্ভোগ হতো না। এ নিয়ে ক্ষুব্ধ এলাকাবাসী প্রতিবাদ ও অভিযোগ জানালেও সংশ্লিষ্ট দপ্তর দায় এড়িয়ে যাচ্ছে বরাবরের মতো। এসব ঘটনায় এরইমধ্যে মাঠে নেমেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। চলমান তদন্তে উঠে আসছে ভয়াবহ অনিয়ম ও দুর্নীতির প্রমাণ।

শিবগঞ্জের রাস্তা তিনদিনেই ধসে পড়লো!

শিবগঞ্জ উপজেলার মোকামতলা ইউনিয়নের মুরাদপুর থেকে চাকলমা পর্যন্ত আড়াই কিলোমিটার রাস্তার সংস্কার কাজ শেষ হয় ২৩ এপ্রিল। মাত্র তিনদিনের মাথায় মুরাদপুরের পুকুরপাড়ে রাস্তার পাশের স্লাইডিং ইট খুলে গিয়ে ধসে পড়ে প্রায় ১৭ ফুট। রাস্তার একাধিক স্থানে হাতের সামান্য চাপেই উঠে আসে কার্পেটিং, কোথাও আবার চাকার দাগে দেখা যায় খোয়া উঠে দেবে গেছে।

স্থানীয় কৃষক ইমন হাসান বলেন, রাস্তার রোলারিং সঠিকভাবে করা হয়নি। কাজ শেষ হওয়ার পরের দিনই একটি অটোভ্যানের চাকা দেবে গিয়ে খাদে পড়ে যায়। এক্সেল ভেঙে যায়, যাত্রীরা আহত হন।

Advertisement

মুরাদপুরের বাসিন্দা স্কুলশিক্ষক আবিদুর রহমান বলেন, এখানে সোজা কথায় লুটপাট হয়েছে। প্রকৌশলী যদি ঠিকভাবে তদারকি করতেন, তাহলে এমন নিম্নমানের কাজ হতো না। এটা শুধু ঠিকাদারের দায় নয়, প্রকৌশলী দপ্তরও সমানভাবে দায়ী।

সরকারি অর্থে এলজিইডির অধীনে ৮১ লাখ টাকা ব্যয়ে রাস্তাটির সংস্কার কাজ করেন ঠিকাদার রফিকুল ইসলাম। তিনি অবশ্য দাবি করেন, সব নিয়ম মেনেই কাজ করেছি। কিছু জায়গায় ক্ষতি হয়েছিল, তা ঠিক করে দিয়েছি।

তবে উপজেলা প্রকৌশলী আব্দুল লতিফ ঘটনাটি ‘স্বাভাবিক’ দাবি করে বলেন, কাজ শেষ হওয়ার পর বৃষ্টি হয়েছিল। সে কারণে কিছু জায়গায় পিচ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

শিবগঞ্জের এই রাস্তা নিয়ে ব্যাপক অভিযোগ উঠলে বিষয়টি নজরে আসে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক)। ২৯ এপ্রিল বগুড়া দুদক কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক জাহিদুল ইসলামের নেতৃত্বে একটি তদন্ত দল সরেজমিন পরিদর্শনে যান। সঙ্গে ছিলেন একজন নিরপেক্ষ প্রকৌশলীসহ কয়েকজন কর্মকর্তা।

Advertisement

দুদকের সহকারী পরিচালক জাহিদুল ইসলাম বলেন, নিম্নমানের নির্মাণসামগ্রী ব্যবহারের অভিযোগ পেয়েই আমরা সরেজমিনে গিয়েছি। প্রকৌশলীর মূল্যায়ন রিপোর্ট পাওয়ার পর তা কমিশনে জমা দিয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

শেরপুরে হাত দিলেই উঠছে কোটি টাকার রাস্তার পিচ

শেরপুর উপজেলার খামারকান্দি ইউনিয়নের আমতলা ব্রিজ থেকে পারভবানীপুর আল হেরা মসজিদ পর্যন্ত এক কিলোমিটার রাস্তার কার্পেটিং কাজ শেষ হয় ১৮ এপ্রিল। কিন্তু চারদিনের মাথায় রাস্তার পিচ উঠে যেতে শুরু করে। হাতের টানেই উঠে আসছে কার্পেটিং।

এলাকাবাসীর অভিযোগ, বালির পরিবর্তে মাটি মেশানো বিটবালি, নিম্নমানের খোয়া ও নির্মাণ সামগ্রী ব্যবহার করা হয়েছে। ফলে রাস্তা টেকসই হয়নি।

স্থানীয় বাসিন্দা ইয়াসিন আলী বলেন, ঠিকাদাররা উপজেলা প্রকৌশলীকে ‘ম্যানেজ’ করে এই দুর্নীতি করেছে। কাজ শুরু থেকেই নিম্নমানের ছিল, সেটা আমরা বললেও কেউ শোনেনি।

এই রাস্তার জন্য বরাদ্দ ছিল ১ কোটি ২ লাখ টাকা। ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান অন্তরা এন্টারপ্রাইজের ব্যবস্থাপক বিদ্যুৎ কুমার কুন্ডু বলেন, সঠিক নিয়মেই কাজ হয়েছে। যেখানে কিছু সমস্যা ছিল, সেখানে আমরা পুনঃসংস্কার করেছি।

তবে ঠিকাদারের এ কথার সঙ্গে এলাকাবাসী একমত নয়।

ইউপি সদস্য নজরুল ইসলাম বলেন, রাস্তা নির্মাণের পরপরই পিচ উঠে যাওয়ায় জনমনে ব্যাপক ক্ষোভ সৃষ্টি হয়েছে। তদন্ত করে জড়িতদের শাস্তি চাই।

বগুড়া সদরেও পিচ উঠছে হাতের স্পর্শে

বগুড়া সদর উপজেলার শেখেরকোলা ইউনিয়নের গোকুল থেকে তেলিহারা পর্যন্ত আড়াই কিলোমিটার সড়কেও একই অবস্থা। এক কোটি ২০ লাখ টাকা ব্যয়ের এই রাস্তা নির্মাণ কাজ শেষ হয় কিছুদিন আগে। চুনাতিঘাট ও বালুপাড়ায় রাস্তা নির্মাণের একদিন পরই হাত দিয়ে টানলেই উঠে যাচ্ছে পিচের আস্তরণ!

তেলিহারা গ্রামের বাসিন্দা নজরুল ইসলাম বলেন, এতো নিম্নমানের কার্পেটিং আগে কখনো দেখিনি। আমরা প্রকৌশলী দপ্তরে অভিযোগ করেছি, এখনও কোনো ব্যবস্থা হয়নি।

ঠিকাদার শাহীন আলম বলেন, পিচ বসতে দুই-তিন দিন সময় লাগে। কেউ কেউ আগেই টেনে দেখছেন, তাই উঠে যাচ্ছে। তারপরও আমরা যেসব জায়গায় অভিযোগ পেয়েছি, সেখানে মেরামত করেছি।

উপজেলা প্রকৌশলী মোবারক হোসেন বলেন, কাজের মানে কোনো বড় ত্রুটি চোখে পড়েনি। অনেক সময় মানুষ পরীক্ষা করার জন্য হাত দিয়ে টান দেয়, তখনই পিচ উঠে যায়। এমন ঘটনা স্বাভাবিক।

এলাকাবাসীর অভিযোগ, প্রতিটি প্রকল্পেই নিম্নমানের নির্মাণ সামগ্রী, রোলার ব্যবহার না করা এবং পর্যাপ্ত তদারকির অভাবে রাস্তা ব্যবহার অযোগ্য হয়ে পড়ছে। আর এসব কাজের পেছনে জলে যাচ্ছে সরকারের বরাদ্দের কোটি কোটি টাকা।

এফএ/জেআইএম