জোয়ারের পানিতে তলিয়ে যায় রাস্তা। বর্ষাকালে হয় হাঁটুপানি। এই হলো খুলনা মহানগরী। জলাবদ্ধতায় নাকাল নগরবাসী। রাস্তাঘাট পানিতে তলিয়ে গেলে যাতায়াতে পোহাতে হয় ভোগান্তি। কিন্তু দীর্ঘদিনের এ সমস্যা দেখার কেউ নেই। সিটি করপোরেশনের দূরদর্শিতার অভাব, পরিকল্পিত ড্রেনেজ ব্যবস্থা না থাকা, খাল বিল দখল আর সঠিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনা না থাকার কারণকেই দায়ী করছেন নগরবাসী।
Advertisement
নগরবাসীর অভিযোগ, অলিগলি থেকে শুরু করে প্রধান সড়কেও সামান্য বর্ষায় হাঁটুপানি জমে। জলাবদ্ধতায় যানবাহন চলাচলে সমস্যা হয়। দীর্ঘ যানজটের সৃষ্টি হয়। যানজটের কারণে স্কুল, কলেজ কিংবা কর্মস্থলে সময়মতো যাওয়াও সম্ভব হয় না। অনেক এলাকার ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে পানি উঠে মালপত্রও নষ্ট হয়।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, নগরীর টুটপাড়া, রয়েল মোড়, মিস্ত্রিপাড়া, খালিশপুর, নিউ মার্কেট এলাকা, বাস্তুহারা এলাকা, শান্তিধাম মোড়, দিলখোলা রোড, পূর্ব বানিয়া খামার, বসুপাড়া, ফুলবাড়িগেট, আলমনগর, মুজগুন্নি আবাসিক এলাকা, করপাড়া, দৌলতপুর বীনাপানি এলাকা, কুয়েট রোড, রুপসা ব্রিজ রোডসহ বিভিন্ন এলাকা সামান্য বর্ষায় তলিয়ে যায়। গুরুত্বপূর্ণ সড়ক এবং বাণিজ্যিক এলাকায় জলাবদ্ধতা নিরসন প্রকল্পের একাধিক কাজ বাস্তবায়ন হলেও দূর হয়নি সমস্যা।
আরও পড়ুন-
Advertisement
কেসিসি সূত্রে জানা যায়, খুলনা সিটি করপোরেশন এলাকায় প্রায় ১৫ লাখ মানুষের বসবাস। যাতায়াতের জন্য সড়ক রয়েছে প্রায় ১ হাজার ২১৫টি। পানি নিষ্কাশনের জন্য খাল রয়েছে ১৩টি। ড্রেন রয়েছে প্রায় ৫৪২ কিলোমিটার। ড্রেন ও খাল সংরক্ষণ ও জলাবদ্ধতা নিরসনে ২০১৮-১৯ অর্থবছরে সিটি করপোরেশন ৮২৩ কোটি টাকা ব্যয়ে ড্রেন নির্মাণ ও ৬৬০ কোটি টাকা ব্যয়ে ক্ষতিগ্রস্ত রাস্তা মেরামত ও উন্নয়নে কাজ শুরু করে। সব মিলিয়ে জলাবদ্ধতা নিরসনে গত পাঁচ বছরে এই দুই প্রকল্পে প্রায় ১ হাজার ৪৮৩ কোটি টাকার প্রকল্প ব্যয় ধরা হয়। যার মধ্যে অধিকাংশ কাজ চলমান।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কেসিসির এক কর্মকর্তা বলেন, জলাবদ্ধতার মূল কারণ জনবান্ধবহীন মেয়র। আমরা তো সাবেক মেয়র তালুকদার আব্দুল খালেক থাকাকালীন কোনো পরিকল্পনায় মুখই খুলতে পারতাম না। কিছু বলতে গেলেই বলতো ‘ব্যাডা তুমি বেশি বুঝো?’।
তিনি বলেন, পরিকল্পনা না করে প্রকল্প দাঁড় করিয়ে টেন্ডার বাণিজ্য করা হয়েছে। যার কারণেই এই জলাবদ্ধতা দূর হয়নি। মেয়রের চেয়ারে বসে খালেক সাহেব করেছেন ঠিকাদারি ব্যবসা। ৮০ ভাগ কাজ বিভিন্ন কাউন্সিলর এবং খালেক সাহেব নিজেই করেছেন।
তিনি আরও বলেন, অনিয়মের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে গেলে ইনডাইরেক্টলি লাঞ্ছিত করার হুমকি পেয়েছেন অনেকে। আপনারাইতো ভালো জানেন ঠিকাদারি কাজ কৌশলে নিজেই করতেন তিনি (খালেক)। প্রকল্প আর কাজের নামে শুধু আওয়ামী লীগ নেতাদের পকেট ভর্তি হয়েছে। নেতাদের উন্নয়ন হলেও নগরবাসীর কোনো উন্নয়ন হয়নি।
Advertisement
টুটপাড়ার বাসিন্দা আসাদুজ্জামান বলেন, বৃষ্টি কিংবা জোয়ার ভাটায় টুটপাড়া পানিতে তলিয়ে যায়। ছেলে মেয়েদের ভিজে-পুড়ে স্কুল-কলেজে যেতে হয়। বয়স্কদের চলাচল করতে সমস্যা হয়। এ সমস্যার সমাধান দরকার। নইলে বর্ষাকালে ভোগান্তি পোহাতে হবে।
নিরালার বাসিন্দা হাসিব হাসান বলেন, নিরালা আবাসিকের রাস্তা অনেক নিচু। বৃষ্টির পানি নিষ্কাশনে এ এলাকায় অনেক প্রতিবন্ধকতা তৈরি হয়।
দৌলতপুরের বাসিন্দা হাসান মাহমুদ বলেন, দীর্ঘ বছর ধরে দেখছি কেসিসি শুধু কাজই করছে। কাজের ফল আর ভোগ করতে পারছি না। সামনে বর্ষাকালে জলাবদ্ধতার সমস্যা আরো বাড়বে।
ইজিবাইক চালক আজমল গাজী বলেন, বর্ষা হলে ময়লাপোতা ক্রস করতে ভয় লাগে। রয়েল মোড়ের দিকে গাড়ি নিয়ে গেলে গাড়িতে পানি ওঠে। সিটি করপোরেশন রয়েল মোড়ের জলাবদ্ধতার বিষয়ে জেনেও কোনো ব্যবস্থা নেয় না। এটা দুঃখজনক।
খুলনা নাগরিক সমাজের সদস্য সচিব অ্যাডভোকেট বাবুল হাওলাদার বলেন, জলাবদ্ধতা খুলনা নগরীর দীর্ঘদিনের সমস্যা। জলাবদ্ধতা এ বছর দ্বিগুণ মাত্রার রূপ ধারণ করবে। খুলনা সিটি করপোরেশনের কোনো দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা নেই। সঠিক পরিকল্পনা এবং দূরদর্শিতার অভাবে জলাবদ্ধতা এখন নগরবাসীর বিষফোড়া।
তিনি বলেন, খুলনা সিটি করপোরেশনের জলাবদ্ধতা নিরসনে দৃশ্যমান কোনো অগ্রগতি নেই। সিটি করপোরশনের বর্জ্য ব্যবস্থাপনা কার্যক্রম নেই বললেই চলে। শহরের ভৌগোলিক অবস্থান এবং পানি ওঠা নামার সঙ্গে সংগতি না রেখেই ড্রেনেজ ব্যবস্থা করা হয়েছে। খাল বিল দখল এবং যত্রতত্র পলিথিন ফেলার কারণেও জলাবদ্ধতা ভয়াবহ রূপ ধারণ করেছে। ড্রেনগুলো নিয়মিত পরিষ্কার করা হচ্ছে না। বিগত দিনে জবাবদিহিতার মাধ্যমে কোনো উন্নয়ন কাজ হয়নি। উন্নয়ন কাজে অর্থ তছরুপ হওয়ার জনশ্রুতিও রয়েছে।
তিনি আরও বলেন, জলাবদ্ধতা নিরসনে আমাদেরও সচেতন হতে হবে। যেখানে সেখানে ময়লা আবর্জনা ফেলা যাবে না। পলিথিন ব্যবহার বন্ধ করতে হবে।
কেসিসির প্রধান কনজারভেন্সি কোহিনুর জাহান বলেন, জলাবদ্ধতা নিরসনে আমাদের কাজ চলমান রয়েছে। প্রতিটি ওয়ার্ডে ড্রেন পরিষ্কারের কাজ চলছে। মতিয়াখালি খাল এবং ক্ষেত্রখালি খাল পরিষ্কারের কার্যক্রম চলমান রয়েছে। দ্রুত পদক্ষেপ নিতে প্রতিটি ওয়ার্ডে কর্মকর্তাদের ট্যাগ করে দেওয়া হয়েছে।
তিনি আরও বলেন, ড্রেনে জমে থাকা মাটি উত্তোলন করা হচ্ছে এবং ড্রেন পরিষ্কারের কার্যক্রম বর্তমানে চলমান রয়েছে।
খুলনা সিটি করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা লস্কার তাজুল ইসলাম বলেন, জলাবদ্ধতা নিরসনে আমরা বিভিন্ন কার্যক্রম চলমান রেখেছি। বর্তমানে ড্রেন পরিষ্কার করা হচ্ছে। মরা খালগুলো পুনরায় জীবিত করার চেষ্টা করা হচ্ছে। গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গ্রহণে ওয়ার্ড পর্যায়ে কমিটি করা হয়েছে। এছাড়াও জলাবদ্ধতা নিরসন প্রকল্পের চলমান কাজ নির্ধারিত সময়ে সম্পন্ন করার চেষ্টা করা হচ্ছে।
এফএ/এমএস