বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট নিম্নচাপের প্রভাবে কক্সবাজারে উত্তাল হয়ে উঠেছে সাগর। জোয়ারের পানির স্বাভাবিক উচ্চতার চেয়ে ৩-৪ ফুট বৃদ্ধি পেয়ে কূলে আছড়ে পড়ছে। মহেশখালী, কুতুবদিয়া, সেন্টমার্টিন, টেকনাফসহ বিভিন্ন উপকূলের নিচু এলাকায় জোয়ারের পানি তীর উপচে লোকালয়ে ঢুকে পড়েছে। প্লাবিত হয়েছে অনেক এলাকা। বেড়িবাঁধের কিনারে থাকা অনেক ঝুপড়ি ঘর ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
Advertisement
বুধবার (২৮ মে) সকাল থেকে কক্সবাজারে থেমে থেমে হচ্ছে বৃষ্টিপাত। বৃহস্পতিবারও এই ধারা অব্যাহত রয়েছে। উপকূলে চলছে ৩ নম্বর স্থানীয় সতর্ক সংকেত।
জেলার ঈদগাঁওসহ নানা এলাকায় ৩৩ কেভি লাইনের ওপর গাছ উপড়ে পড়ায় বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় বিদ্যুৎ সংযোগ। সারাদিন চেষ্টা করেও অনেক এলাকায় বিদ্যুৎ সংযোগ স্বাভাবিক করা যায়নি। বাতাসে ছেঁড়া তার দেখলে হাত দিয়ে না ধরে পার্শ্ববর্তী বিদ্যুৎ অফিসে ফোন দিতে পরামর্শ দিয়েছে পল্লী বিদ্যুৎ অফিস।
বাড়ন্ত জোয়ারের পানিতে ডুবে মহেশখালীতে দানু মিয়া (৪১) নামে এক যুবকের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। বৃহস্পতিবার দুপুরে কুতুবজোম ইউনিয়নের ঘটিভাঙা এলাকায় জোয়ারের পানিতে ডুবে তার মৃত্যু হয়। দানু মিয়া ঘটিভাঙা এলাকার মৃত নূর হোসেনের ছেলে। তিনি মৃগী রোগে আক্রান্ত ছিলেন।
Advertisement
স্থানীয়রা জানান, সাগরে জোয়ারের পানি বৃদ্ধি পেয়ে লোকালয়ে ঢুকে পড়ে। দানু মিয়া দুপুরে দোকান থেকে বাড়ি ফেরার পথে পানিতে পড়ে অজ্ঞান হয়ে যান। তাকে উদ্ধার করে মহেশখালী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করে।
এদিকে, বৈরী আবহাওয়ায় উত্তাল সমুদ্র উপভোগ করছেন সৈকতে আগত পর্যটক ও দর্শনার্থীরা। ঢেউয়ের আধিক্য দেখে অনেকে সমুদ্রে নেমে পড়ছেন। আর তাদের সতর্ক করতে প্রাণান্তকর চেষ্টা করছেন সি সেইফ লাইফগার্ড, বিচ কর্মী ও ট্যুরিস্ট পুলিশ। তবে, এ পরিস্থিতিতে সাগরে গোসলে নামতে নিষেধ করলেও অনেকেই মানছেন না। দমকা-ঝড়ো হাওয়ায় টিকতে না পেরে দোকানপাট বন্ধ করে ফেলেছেন সৈকত পাড়ের ব্যবসায়ী ও পর্যটনসেবীরা। এ তথ্য জানিয়েছেন পর্যটকদের নিরাপত্তায় কাজ করা সি সেইফ লাইফ গার্ডের সিনিয়র ইনর্চাজ জয়নাল আবেদীন ভুট্টু।
কক্সবাজার আবহাওয়া অফিসের সহকারী আবহাওয়াবিদ মো. আব্দুল হান্নান জানান, বুধবার সকাল ৯টা থেকে বৃহস্পতিবার সকাল ৯টা পর্যন্ত গত ২৪ ঘণ্টায় কক্সবাজারে ৯১ মিলিমিটার এবং বুধবার রাত ৯টা হতে বৃহস্পতিবার রাত ৯টা পর্যন্ত বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে ১০৯ মিলিমিটার। শুক্রবারও ভারী থেকে অতিভারী বৃষ্টিপাতের আশঙ্কা রয়েছে। এরপর হালকা থেকে মাঝারি বৃষ্টি ১-২ দিন থাকতে পারে।
জেলা প্রশাসনের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) ইমরান হোসাইন সজীব বলেন, বৃষ্টি ও জোয়ারের পানির তোড়ে প্লাবিত হয় কুতুবজোম, মাতারবাড়ির সাইরার ডেইল, ধলঘাটা ও ছোট মহেশখালীর নিম্নাঞ্চল। লোকালয়ের রাস্তাঘাট, দোকানপাট ও শত শত ঘরবাড়ি পানির নিচে তলিয়ে যায়। তার ফলে ভেঙে পড়েছে স্বাভাবিক জীবনযাত্রা। সকাল থেকে তীব্রভাবে চলছে লোডশেডিং। এতে লোকজন আতঙ্কিত হয়ে ঘর ছেড়ে নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে যাচ্ছেন। সাগরের ওপর ঘনীভূত লঘুচাপ নিম্নচাপে পরিণত হওয়ায় হঠাৎই জোয়ারের পানি স্বাভাবিকের চেয়ে দ্বিগুণ উচ্চতায় প্রবাহিত হয়। এতে ক্ষতিগ্রস্ত হয় ছোট মহেশখালীর মূল সড়ক। পানি ঢুকে পড়ে বিভিন্ন ইউনিয়নের বাজার, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও বসতবাড়িতে। অনেকের সম্পদ পানির তোড়ে ভেসে যায়। এ সময় জোয়ারের পানিতে ডুবে দানু মিয়া নামে এক যুবকের মৃত্যু হয় বলে খবর পেয়েছি।
Advertisement
দুর্যোগ মোকাবিলায় করণীয় নির্ধারণে জেলা প্রশাসকের সম্মেলন কক্ষে জরুরি বৈঠক করেছে জেলা দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কমিটি। জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ সালাহউদ্দিনের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সভায় সংশ্লিষ্ট কমিটির সকল বিভাগের সদস্যরা উপস্থিত থেকে সম্ভাব্য দুর্যোগ মোকাবিলায় প্রস্তুতি নিয়েছে।
ফেনী থেকে আগত পর্যটক বশির আহমদ দম্পতি জানান, বুধবার কক্সবাজার এসে বৃষ্টিতে হোটেলে আটকা পড়েছেন। আজ (বৃহস্পতিবার) রাতে চলে যাবেন বলে বিকেলে সাগরে গোসল করতে এসেছেন। বৃষ্টিতে সাগর খুবই উপভোগ্য বলে উল্লেখ করেন তারা।
স্থানীয় এনামুল হক সন্তানদের উত্তাল সাগরের দৃশ্য দেখাতে এনেছেন। লোকাল ও উপকূলের বাসিন্দা হিসেবে সন্তানদের বর্ষার এ প্রকৃতির সঙ্গে পরিচয় করানো দরকার বলে উল্লেখ করেন এনাম।
জেলা প্রশাসনের পর্যটন সেলের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট নাফিস ইনতেসার নাফি বলেন, বৈরী আবহাওয়ায় সৈকত উত্তাল। তাই পর্যটকদের সতর্কতা অবলম্বন করতে বলা হচ্ছে। অনেক পর্যটক এটি মানছেন না। তারপরও আমরা কাজ করে যাচ্ছি।
দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ার কারণে জেলেরা নিরাপদ আশ্রয়ের জন্য তীরে ফিরে এসেছেন।সাগরের ঢেউয়ের ধাক্কায় বদরখালী নৌ-চ্যানেলে অবস্থানরত বহু ফিশিং ট্রলারের জাল ছিঁড়ে গেছে।
জেলেরা জানান, কয়েকদিনের খরচের জন্য সাগরে মাছ ধরতে গিয়েছিলেন, কিন্তু উত্তাল সাগরের ঢেউয়ের মুখে পড়ে প্রায় সব জাল ছিঁড়ে গেছে। তারা দুর্যোগে আর্থিক ক্ষতির আশঙ্কায় পড়েছেন।
উপকূলের অনেকে ঢেউয়ের তোড়ে ঘর হারিয়েছেন। বেড়িবাঁধ না থাকায় প্রতিবছর এই দুর্ভোগ পোহাতে হয় দাবি করে ক্ষতিগ্রস্তরা জরুরি ভিত্তিতে টেকসই বেড়িবাঁধ নির্মাণের দাবি জানান।
বৈরী আবহাওয়ার কারণে দুপুর থেকে মহেশখালী-কক্সবাজার নৌ-রুটে সি-ট্রাক চলাচল সাময়িকভাবে বন্ধ করে দিয়েছে উপজেলা প্রশাসন। বন্ধ রয়েছে স্পিডবোট চলাচলও। ছোট মহেশখালী ইউনিয়নের সাগর তীরবর্তী এলাকাগুলোর মানুষকে দ্রুত নিরাপদ আশ্রয়কেন্দ্রে চলে যাওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। প্রশাসনের পক্ষ থেকে আশ্রয়কেন্দ্রগুলো প্রস্তুত রাখা হয়েছে। এছাড়া দুর্গত এলাকাগুলোতে নজরদারি জোরদার করা হয়েছে।
মহেশখালী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) হেদায়েত উল্যাহ জানান, উপজেলার বেশ কয়েকটি এলাকা পানিতে তলিয়ে গেছে, একাধিক বাড়িঘরে পানি ঢুকেছে। এক ব্যক্তির মৃত্যুর খবর পেয়েছি। ঝুঁকিপূর্ণ এলাকাগুলোর বাসিন্দাদের নিরাপদ আশ্রয়ে নেয়া হচ্ছে এবং দুর্যোগ পরবর্তী সহায়তা নিশ্চিত করতে কাজ করছে প্রশাসন।
কক্সবাজার পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির জিএম মকবুল আলম বলেন, আমরা প্রকৃতির কাছে অসহায়। নিম্নচাপের কারণে সারাদেশে দমকা বাতাসসহ থেমে থেমে প্রচুর বৃষ্টিপাত হচ্ছে। সমুদ্রের উপকূল হওয়ায় কক্সবাজার জেলায় এর প্রভাব বেশি। বর্তমানে নিম্নচাপটি সমুদ্র উপকূল অতিক্রম করছে। বিদ্যুৎ সেবায় নিয়োজিত সমিতির সকল কর্মচারী সারাদিন বৃষ্টিতে ভিজে বিদ্যুৎ লাইন সচল রাখতে নিরলস চেষ্টা করে যাচ্ছেন। প্রচণ্ড বাতাসে বিভিন্ন জায়গায় গাছ বা গাছের ডালপালা পড়ে বিদ্যুৎ সরবরাহে বিঘ্ন ঘটছে। নিরাপত্তাজনিত কারণে বৃষ্টির মধ্যে কাজ করা, বিশেষ করে রাতে কাজ করা খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। এ অবস্থায় সবাইকে ধৈর্য সহকারে অপেক্ষা করার জন্য বিনীতভাবে অনুরোধ করা হলো। আবহাওয়ার উন্নতি বা প্রতিকূলতা কেটে গেলে পর্যায়ক্রমে বিদ্যুৎ সরবরাহ সচল করা হবে। বাতাসে ছেঁড়া তার দেখলে হাত দিয়ে না ধরে পার্শ্ববতী বিদ্যুৎ অফিসে ফোন দিতে পরামর্শ দিয়েছে তিনি।
সায়ীদ আলমগীর/কেএএ/