খেলাধুলা

সরকারই ফারুককে চায় না, আমরা কীভাবে তার সঙ্গে কাজ করি?

সরকারই ফারুককে চায় না, আমরা কীভাবে তার সঙ্গে কাজ করি?

সেই সাত সকাল থেকেই সরব বাংলাদেশের ক্রিকেটাঙ্গন। ফারুক আহমেদকে সরিয়ে বিসিবি সভাপতি পদে আমিনুল ইসলাম বুলবুলকে বসানোর জোর চিন্তা-ভাবনা যুব ও ক্রীড়া উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়ার।

Advertisement

সারাদিন সেটাই ছিল টক অফ দ্যা টাউন। সন্ধ্যা নামতেই আরেক খবর, ফারুক আহমেদের ওপর অনাস্থা এনেছেন বিসিবির ৮ পরিচালক নাজমুল আবেদিন ফাহিম, মাহবুব আনাম, ফাহিম সিনহা, ইফতিখার রহমান মিঠু, সাইফুল আলম চৌধুরী, মঞ্জুর আলম, কাজী ইনাম ও সালাউদ্দীন চৌধুরী।

ফারুকের প্রতি অনাস্থা জ্ঞাপনকারী পরিচালকদের অভিযোগ, বোর্ডের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে এককভাবে সিদ্ধান্তগ্রহণ, একের পর এক দায়িত্বজ্ঞানহীন কাজ, একক আধিপত্য ও স্বেচ্ছাচারিতা।

এ মুহূর্তে ১০ জনের বোর্ডে ফারুক আহমেদ ছাড়া আর একজনই অনাস্থাপত্রে স্বাক্ষর করেননি। তিনি আকরাম খান। ফারুক আহমেদের আপন ভায়রা ভাই। আত্মীয় হওয়ার কারণেই হয়তো তিনি স্বাক্ষর করা থেকে বিরত থেকেছেন। খুব স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন উঠেছে, আজ বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় কেন এই অনাস্থা পত্র দেয়া হলো সরকার তথা যুব ও ক্রীড়া উপদেষ্টা বরাবর? সেটা আগে দিলে কি হতো? আজকের এই অনাস্থা পত্রটা জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের চেয়ারম্যানের হাতে দিলে তো এর আগেই ফারুক আহমেদের চেয়ারছাড়া চূড়ান্ত হয়ে যেত। কিন্তু কেন তা হয়নি? কি কারণে বোর্ড পরিচালকরা আগে না এনে আজ অনাস্থা প্রস্তাব আনলেন?

Advertisement

তা জানতে বোর্ডের বেশ কয়েকজন পরিচালকের সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও মাহবুব আনাম ও ইফতিখার রহমান মিঠু ছাড়া অন্য কেউ কথা বলেননি। মাহবুব আনাম শুরুতে ব্যস্ততার কথা জানালেও পরে কথা বলেন। নাজমুল আবেদিন ফাহিমের ফোন বন্ধ। আর ফাহিম সিনহাও কথা বলেননি।

অনাস্থা আনার বিষয়ে মাহবুব আনাম জানিয়েছেন ফারুক আহমেদের মধ্যে অহংকার বেশি। অন্যদের খুব একটা মূল্যায়নই করতে চান না। তিনি বলেন, ‘ফারুকের ইগোয়েটিক ক্যারেক্টারটা (অহংকারী চরিত্র) আমাদের মধ্যে দুটি পক্ষ তৈরি করে দিয়েছে। এই সমস্যার কারণে আমাদের মধ্যে বোঝাপড়াটাও কম ছিল। যে কারণে দিনকে দিন পরিচালকদের সঙ্গে দূরত্ব কমতে শুরু করে।’

আমিনুল ইসলাম বুলবুলের বিষয়ে মাহবুব আনাম বলেন, ‘সরকারেরই ইচ্ছা হচ্ছে, নো মোর ফারুক। সুতরাং, আমরা কিভাবে ফারুকের সঙ্গে কাজ করবো। তাকে সরালে সেখানে তো অন্য কাউকে নিয়ে আসতে হবে। সে কারণেই তারা বুলবুলের সঙ্গে যোগাযোগ করেছে। আমার ধারণা, বুলবুল যেহেতু আইসিসির বেতনভূক্ত, সুতরাং সেখান থেকে তাকে কিভাবে এনে দায়িত্ব দেয়া যায়, সে বিষয়গুলো সরকার মাথায় রেখেই এগুচ্ছে!’

ইফতিখার রহমান মিঠু জানান, শুরু থেকেই বিসিবি সভাপতি ফারুক আহমেদের সঙ্গে আমাদের বোঝাপড়া, পারস্পরিক সমঝোতা, আস্থা ও বিশ্বাস কম ছিল। তার কারণ, বোর্ড সভাপতি ফারুক আহমেদ সবাইকে নিয়ে সবার সাথে কথা বলে কাজ করার চেষ্টাই করেননি। বোর্ডকে একটা ইউনিটে রুপান্তরিত করার পরিবর্তে একক স্বেচ্ছাচারিতা ছিল তার মধ্যে।

Advertisement

বেশিরভাগ সিদ্ধান্ত তিনি নিজের মত করে নিতেন। যে কারণে আমরা একটা দল হিসেবে কাজ করতে পারিনি। আমাদের পরিচালকদের সাথে ফারুক আহমেদের সম্প্রীতি, ঐক্য ও সংহতির কমতি ছিল। ফারুক আহমেদ একাএকা সিদ্ধান্ত নিয়ে নিতেন। দেখা গেল, সিদ্ধান্ত নিয়ে অনলাইনে একটা দায়সারা গোছের মিটিং করে সে সিদ্ধান্তটা চূড়ান্ত করে ফেলতেন।

তার নিজের সাথে তেমন দুর্ব্যবহার না করলেও পরিচালক মিঠুর দাবি, বোর্ডের জ্যেষ্ঠ পরিচালক মাহবুব আনাম থেকে শুরু করে ফাহিম সিনহা এবং নাজমুল আবেদিন ফাহিমসহ সবার সঙ্গে নিয়মিতভাবেই দুর্ব্যবহার করতেন ফারুক। তাদের পাত্তা দিতেন চাইতেন না। তোয়াক্কাও করতেন না। কারো পরামর্শ গ্রহণ করতেন না। কথাই শুনতেন না। এতে করে সবার সাথেই সম্পর্ক খারাপ হয়ে গিয়েছিল। কারো সাথেই আর সু-সম্পর্ক ছিল না।

এছাড়া পরিচালক ইফতিখার রহমান মিঠু ফারুক আহমেদের বিপক্ষে বোর্ডের কয়েকজন পরিচালককে নানাভাবে হেনস্তা করার অভিযোগও এনেছেন। মিঠুর কথা, ফারুক আহমেদ কাউকে কাউকে দিয়ে জোর করে বিল সিগনেচার করিয়েছেন।

ফাহিম সিনহার নাম উল্লেখ করে মিঠু বলেন, ‘আমি জানি, সব পরিচালক জানে ফাহিম সিনহা কেমন ভাল ও সৎ ছেলে। তার কোনোই আর্থিক কেলেঙ্কারি নেই; কিন্তু তাকে দিয়ে জোরপূর্বক বিল সই করিয়ে তাকে বিরাট বিড়ম্বনায় ফেলে দিয়েছেন ফারুক। ফাহিম সিনহাকে সামাজিকভাবে হেয়-প্রতিপন্ন করার চেষ্টার অভিযোগও আনেন পরিচালক মিঠু।

বোর্ডের উচ্চ পর্যায়ের এক দায়িত্বশীল সূত্রের খবর, ফাহিম সিনহার সাথে অসাদাচরণ ও দেশের অন্যতম ঔষধ নির্মাতা এবং বাজারজাতকারী প্রতিষ্ঠান একমি ল্যাবরেটরিজের অন্যতম স্বত্বাধিকারী ফাহিম সিনহার বিপক্ষে অর্থনৈতিক অস্বচ্ছতার অভিযোগ না আনা নিয়ে ফারুক আহমেদের সঙ্গে কথা বলেন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের অন্যতম উপদেষ্টা আদিলুর রহমান শুভ্র।

বলে রাখা ভালো, আদিলুর রহমানের পরম আত্মীয় হলেন ফাহিম সিনহা। তাই উপদেষ্টা আদিলুর রহমান নাকি ফাহিম সিনহার সাথে সু-সম্পর্ক বজায় রাখার অনুরোধও করেছিলেন ফারুক আহমেদকে; কিন্তু তিনি তা রাখেননি। জানা গেছে, ক্রীড়া উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজিব ভূঁইয়া গতকাল বুধবার রাতে ফারুক আহমেদের সাথে আলাপ প্রসঙ্গে নাকি এ কথাও উল্লেখ করেছেন।

পরিচালক মিঠু অভিযোগের সুরে বলেন, ফারুক সবার সাথে বসে কথা বলে সম্মিলিত প্রয়াস নিলে হয়ত বিপিএলে রাজশাহী এবং চট্টগ্রামের পেমেন্ট ইস্যুর গ্রহণযোগ্য আর ইতিবাচক সমাধান করা যেত; কিন্তু সেখানেও কারো মতামত সেভাবে প্রাধান্য পায়নি। একক সিদ্ধান্তর কারণে বিপিএলের পেমেন্ট নিয়ে অনিয়ম ও অব্যবস্থাপনা থেকেই গেছে।’

ফারুক আহমেদ নিজেই বলেছেন, ‘বিপিএল নিয়েই তার ওপর অসন্তুষ্ট খোদ অন্তর্বর্তীকালীন সরকার প্রধান ড. ইউনুস। এত বিস্তর অভিযোগ, তা এতদিন জনসম্মুখে প্রকাশ না করে আজ হঠাৎ রীতিমত অনাস্থা প্রকাশ করা কেন?

পরিচালক মিঠুর ব্যাখ্যা, ‘অভিযোগ ছিল বিস্তর; কিন্তু পরিবেশ-পরিস্থিতির উদ্রেক না ঘটায় আমরা সেভাবে প্রকাশ করিনি। এখন মানে আজ অনাস্থা আনার ঘোষণা দেয়ার কারণ খুব ‘সিম্পল। আমরা এরই মধ্যে জেনে গেছি, খোদ সরকার তাকে (ফারুক আহমেদকে) আর বিসিবি প্রধান পদে চায় না। সরকারের পক্ষ থেকেই ফারুক আহমেদকে বিসিবি প্রধানের পদ থেকে সরানোর সিদ্ধান্ত হয়েছে।’

‘তার মানে সরকার ফারুক আহমেদের পারফরমেন্সে সন্তুষ্ট নয়। যাকে খোদ সরকার আর বিসিবি সভাপতির পদে রাখতে চাচ্ছে না, তাকে আমরা কিভাবে বোর্ড সভাপতি হিসেবে মেনে কাজ করি? তার প্রতি আস্থা পোষণ করা যে সরকারি সিদ্ধান্তের বরখেলাপ! এমন অবস্থায় আমরা তার সাথে কাজ করি কি করে? আমরাতো আর সরকারের বাইরে গিয়ে বোর্ড চালাতে পারবো না। তাই পরিচালকরা বসে স্থির সিদ্ধান্ত নিয়েছি যে, আমরা আর ফারুকের সাথে বোর্ডে কাজ করবো না। এখন সরকারই সব ঠিক করবে। আমরা ফারুক আহমেদের সাথে আর নেই।

এআরবি/আইএইচএস