সানজানা রহমান যুথী
Advertisement
একটি সমাজের টেকসই উন্নয়নের জন্য নারী-পুরুষ উভয়ের সমান অংশগ্রহণ অপরিহার্য। শুধু পুরুষদের শ্রম ও মেধার ওপর ভর করে কোনো দেশ অর্থনৈতিক অগ্রগতি কিংবা সামাজিক ন্যায় নিশ্চিত করতে পারে না। বাংলাদেশেও নারীরা দিনে দিনে কর্মক্ষেত্রে নিজেদের অবস্থান তৈরি করছেন। পোশাকশিল্প থেকে শুরু করে কৃষি, সেবা, শিক্ষা কিংবা আইটি খাতে নারীর সরব উপস্থিতি লক্ষ্য করা যাচ্ছে। তবে প্রশ্ন রয়ে যায়—এই নারী শ্রমিকেরা কতটা নিরাপদ? কর্মক্ষেত্রে তাদের অধিকার, সম্মান, নিরাপত্তা ও মর্যাদা কীভাবে নিশ্চিত হচ্ছে?
কর্মজীবী নারীর বর্তমান চিত্রবাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী, দেশের নারী শ্রমশক্তির একটি বড় অংশ এখনো কৃষি ও গৃহভিত্তিক কাজে যুক্ত। কৃষিখাতে নারীর অংশগ্রহণ ৭৪.১% আর অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে এই হার ৯৬.৬%। তুলনামূলকভাবে শিল্প খাতে মাত্র ৮.৭% এবং সেবা খাতে ১৭.২% নারী কর্মরত। বিশ্বব্যাংকের ২০২৩ সালের ডেটা অনুযায়ী, ১৫ বছর বা তদূর্ধ্ব নারীর শ্রমশক্তিতে অংশগ্রহণের হার ৪৩.৭%, যেখানে পুরুষদের ক্ষেত্রে তা ৮১.১%। এই বৈষম্যমূলক পরিসংখ্যান প্রমাণ করে—যদিও নারীর কর্মক্ষেত্রে প্রবেশ বাড়ছে কিন্তু বাস্তব চিত্র এখনো আশাব্যঞ্জক নয়। বিশেষত গ্রামীণ ও অশিক্ষিত নারী শ্রমিকদের জন্য নিরাপদ ও মর্যাদাসম্পন্ন কর্মপরিবেশ গড়ে ওঠেনি।
কর্মক্ষেত্রে নারীর চ্যালেঞ্জকর্মজীবী নারীর নিরাপত্তার প্রশ্নে সবচেয়ে বড় প্রতিবন্ধকতা হলো সমাজের মানসিকতা। অনেক পরিবার এখনো নারীর চাকরি বা বাইরে কাজ করাকে নেতিবাচকভাবে দেখে। শহরের অনেক নারী অফিসে যাওয়ার পথে হেনস্তার শিকার হন। গার্মেন্টস, কলকারখানা কিংবা সেলস প্রমোশনাল কাজে নিযুক্ত নারীরা প্রায়ই সহকর্মী বা ঊর্ধ্বতন দ্বারা মানসিক এবং শারীরিক নির্যাতনের মুখোমুখি হন। বেতন বৈষম্যও একটি বড় সমস্যা। অনেক প্রতিষ্ঠানেই সমান দায়িত্ব পালন করেও নারীরা পুরুষদের চেয়ে কম মজুরি পান। এ ছাড়া মাতৃত্বকালীন সুবিধা না দেওয়া, চাকরি থেকে ছাঁটাইয়ের হুমকি কিংবা ছুটি না দেওয়া—এসব অভিজ্ঞতা অনেক নারীর নিত্যদিনের সঙ্গী।
Advertisement
বাংলাদেশ শ্রম আইন, ২০০৬ নারী শ্রমিকদের জন্য কিছু গুরুত্বপূর্ণ সুরক্ষা বিধান করেছে। যেমন-> মাতৃত্বকালীন ছুটি: সন্তান জন্মের আগে ও পরে মোট ১৬ সপ্তাহের ছুটি এবং এই সময় পূর্ণ বেতন প্রাপ্তির অধিকার রয়েছে।> ঝুঁকিপূর্ণ কাজের সীমাবদ্ধতা: নারীদের নির্দিষ্ট কিছু ভারী ও স্বাস্থ্যঝুঁকিপূর্ণ কাজে নিয়োগ নিষিদ্ধ।> শালীন আচরণ নিশ্চিতকরণ: নারী শ্রমিকদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার, কটূক্তি বা অসম্মানজনক আচরণ শাস্তিযোগ্য অপরাধ।> ডে-কেয়ার সুবিধা: যেসব প্রতিষ্ঠানে ৪০ জন বা ততধিক নারী কাজ করেন; সেখানে শিশুদের জন্য দিবাযত্ন কেন্দ্র স্থাপন বাধ্যতামূলক।> যৌন হয়রানি প্রতিরোধ নীতিমালা: উচ্চ আদালতের নির্দেশে প্রতিটি প্রতিষ্ঠানে যৌন হয়রানি প্রতিরোধ কমিটি গঠন বাধ্যতামূলক।> সমকাজে সমমজুরি: সংবিধানের ২৭ ও ২৮ অনুচ্ছেদে লিঙ্গভিত্তিক বৈষম্য নিষিদ্ধ করা হয়েছে।
আইন আছে, প্রয়োগ নেইআইন থাকা সত্ত্বেও অনেক ক্ষেত্রেই তা কার্যকর হয় না। বিশেষ করে অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে কর্মরত নারীরা এসব আইনি সুরক্ষা থেকে বঞ্চিত হন। গৃহকর্মী, রাস্তার হকার, কৃষিশ্রমিক বা ক্ষুদ্র ব্যবসায় জড়িত নারীরা নানাভাবে শোষণের শিকার হন কিন্তু প্রতিবাদ জানানোর মতো পরিস্থিতি তাদের থাকে না। অধিকাংশ প্রতিষ্ঠানেই যৌন হয়রানি প্রতিরোধ কমিটি গঠিত হয় না। আবার অনেকেই জানেন না কোথায় অভিযোগ করতে হবে। আইনের ভাষা কঠিন ও প্রক্রিয়া জটিল হওয়ায় নারী শ্রমিকরা অনেক সময় ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত হন।
আরও পড়ুন বাংলাদেশ ব্যাংকে চাকরি পেতে যেভাবে প্রস্তুতি নেবেন চাকরির সিদ্ধান্ত নেওয়া সহজ ছিল না: ইরফানুল হক নাগরিক হিসেবে আমাদের দায়িত্বমানসিকতার পরিবর্তন আনতে হবে: নারীকে সম্মান করা, তাদের কাজকে ছোট করে না দেখা এবং ঘরে-বাইরে সমান মর্যাদা দেওয়া এখন সময়ের দাবি।
আইন প্রয়োগ নিশ্চিত করা: সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে এসব আইন বাস্তবায়নে কঠোর হতে হবে। নিয়মিত পরিদর্শন ও জরিমানার ব্যবস্থা করতে হবে।
Advertisement
নারীবান্ধব কর্মপরিবেশ গড়ে তোলা: প্রত্যেক কর্মস্থলে হোক তা অফিস, কারখানা কিংবা হোটেল—নারীদের জন্য নিরাপদ ও স্বাস্থ্যসম্মত পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে।
আইনি সহায়তা সহজলভ্য করা: নারী শ্রমিকদের জন্য আইনি সহায়তা কেন্দ্র, হেল্পলাইন ও কাউন্সেলিং সুবিধা আরও সম্প্রসারণ করতে হবে।
গণসচেতনতা তৈরি করা: গণমাধ্যম, এনজিও ও সুশীল সমাজকে যৌন হয়রানি, বৈষম্য ও অধিকার নিয়ে প্রচারাভিযান চালাতে হবে। যাতে নারীরা সচেতন ও সাহসী হন।
একটি সমাজ যতই উন্নয়নের কথা বলুক না কেন, যদি নারীরা কর্মক্ষেত্রে নিরাপদ না থাকেন, তবে সেই উন্নয়ন দীর্ঘস্থায়ী হয় না। আইন ও নীতিমালা তখনই কার্যকর হয়, যখন তা বাস্তবায়নের শক্তিশালী কাঠামো ও সামাজিক সমর্থন থাকে। নারী শ্রমিকদের সম্মান, নিরাপত্তা ও ন্যায্য অধিকার নিশ্চিত করলেই বাংলাদেশ এগিয়ে যাবে একটি মানবিক, ন্যায়ভিত্তিক ও টেকসই উন্নয়নের পথে। নারী শ্রমিক যেন কেবল ‘শ্রমিক’ না থেকে গর্বিত ‘অংশীদার’ হন—এটাই হোক আমাদের চূড়ান্ত লক্ষ্য।
এসইউ/জিকেএস