সানজানা রহমান যুথী
Advertisement
শ্রমিক—এই একটি শব্দের পেছনে লুকিয়ে আছে একটি জাতির উন্নয়নের গোড়ার গল্প। যেসব হাত প্রতিদিন সূর্য ওঠার আগেই কাজ শুরু করে আর ঘরে ফেরে রাতের আঁধারে, তাদের ঘামেই এগিয়ে চলে একটি দেশের অর্থনীতি। বাংলাদেশও ব্যতিক্রম নয়। একটি শ্রমনির্ভর অর্থনীতি হিসেবে বাংলাদেশ তার অগ্রগতির পেছনে শ্রমিক শ্রেণির অশেষ অবদান রাখে। কিন্তু প্রশ্ন হলো, এই পরিশ্রমের ন্যায্য মূল্য কতটা পাচ্ছেন শ্রমিকেরা? তাদের অধিকার কি শুধুই কাগজে-কলমে সীমাবদ্ধ, নাকি বাস্তবেও কোনো অগ্রগতি হয়েছে?
শ্রমশক্তির গুরুত্ববাংলাদেশ একটি জনবহুল দেশ। এই জনসংখ্যার একটি বড় অংশই সক্রিয় শ্রমশক্তি হিসেবে বিবেচিত। বাংলাদেশের অর্থনীতিতে পোশাক শিল্প, নির্মাণ খাত, কৃষি, পরিবহন ও প্রবাসী শ্রমিকদের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বর্তমান তথ্য অনুযায়ী, প্রায় ১৪.৯ মিলিয়ন বাংলাদেশি বিদেশে শ্রমিক হিসেবে কাজ করছেন, যারা প্রতি বছর দেশে প্রেরণ করেন বিপুল পরিমাণ রেমিট্যান্স, যা জাতীয় অর্থনীতির জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। দেশের ভেতরেও তৈরি পোশাক খাত শ্রমিকদের ঘামেই গড়ে উঠেছে। বর্তমানে প্রায় ৪০ লাখ মানুষ সরাসরি এই শিল্পের সঙ্গে জড়িত। নারীদের অংশগ্রহণও উল্লেখযোগ্য, যা দেশের নারী ক্ষমতায়নের ক্ষেত্রে একটি বড় দৃষ্টান্ত।
আইন ও নীতিমালাবাংলাদেশ সরকার শ্রমিকদের অধিকার রক্ষার জন্য বেশ কিছু আইন প্রণয়ন করেছে। ২০০৬ সালের ‘বাংলাদেশ শ্রম আইন’ (পরে সংশোধিত ২০১৩ ও ২০১৮ সালে) শ্রমিকদের কাজের সময়, মজুরি, স্বাস্থ্য নিরাপত্তা, মাতৃত্বকালীন ছুটি, ছাঁটাই, শ্রমিক ইউনিয়ন গঠনের অধিকার ইত্যাদি নির্ধারণ করেছে। পাশাপাশি ‘জাতীয় শ্রমনীতি ২০১২’ ও ‘জাতীয় সামাজিক নিরাপত্তা কৌশল ২০১৫’-এর মাধ্যমে শ্রমিকদের সুরক্ষা ও কল্যাণে নীতিগত দিকনির্দেশনা প্রদান করা হয়েছে। বিশেষ করে, শিশুশ্রম নিরসনে এবং নারী শ্রমিকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সরকার কিছু উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে।
Advertisement
আইন থাকলেও তার বাস্তবায়ন এখনো চ্যালেঞ্জের মুখে। বিশেষ করে পোশাক খাতে কর্মরত শ্রমিকেরা অনেক সময় ন্যায্য মজুরি থেকে বঞ্চিত হন। শ্রমঘণ্টা দীর্ঘ, ওভারটাইমের নির্দিষ্ট নিয়ম মানা হয় না আর কর্মক্ষেত্রে নিরাপত্তার অভাবের কারণেও অনেক সময় শ্রমিকদের জীবন হুমকির মুখে পড়ে। ২০১৩ সালের ‘রানা প্লাজা’ ধস বিশ্ববাসীর সামনে বাংলাদেশে শ্রমিক নিরাপত্তার করুণ চিত্র উন্মোচন করেছিল। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে সরকার ও আন্তর্জাতিক চাপের ফলে কিছু ইতিবাচক পরিবর্তন এসেছে। যেমন- পোশাক শিল্পে ন্যূনতম মজুরি বৃদ্ধি, কিছু কারখানায় নিরাপত্তা ব্যবস্থার উন্নয়ন এবং শ্রমিকদের স্বাস্থ্যসেবা সহজলভ্য করা। তবে দেশের অন্যান্য খাতে—বিশেষ করে নির্মাণ ও কৃষি খাতে শ্রমিকদের পরিস্থিতি এখনো বেশ নাজুক।
আরও পড়ুন দ্রুত সফলতার কোনো শর্টকাট নেই: সিহাব সাদমান অধ্যবসায় এবং কঠোর পরিশ্রমে সফলতা আসে: আবু জাফর প্রবাসী শ্রমিকদের চ্যালেঞ্জবিদেশগামী শ্রমিকরা বাংলাদেশের অর্থনীতিতে সবচেয়ে বড় অবদানকারীদের মধ্যে অন্যতম হলেও তাদের অধিকারও প্রায়শই উপেক্ষিত থাকে। মধ্যপ্রাচ্যসহ বিভিন্ন দেশে কর্মরত শ্রমিকরা মজুরি বঞ্চনা, পাসপোর্ট জব্দ, অবমাননাকর আচরণ এবং আইনি সহায়তার অভাবের শিকার হন। নারী শ্রমিকদের ক্ষেত্রে এসব সমস্যার মাত্রা আরও তীব্র, অনেকেই শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের মুখোমুখি হন। সরকার ‘এক্সপ্যাট্রিয়েট ওয়েলফেয়ার ব্যাংক’, ‘ওয়েজ আর্নারস কল্যাণ বোর্ড’ এবং ‘প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়’ গঠন করে প্রবাসী শ্রমিকদের সহায়তা দেওয়ার উদ্যোগ নিয়েছে। তবে অনেক ক্ষেত্রে এই উদ্যোগগুলোর কার্যকারিতা নিয়ে প্রশ্ন থেকে যায়।
শ্রমিক আন্দোলন ও সচেতনতাসম্প্রতি শ্রমিকেরা তাদের অধিকার আদায়ের জন্য সোচ্চার হতে শুরু করেছেন। বিভিন্ন শ্রমিক সংগঠন, এনজিও ও আন্তর্জাতিক সংস্থা শ্রমিকদের সচেতন করতে ভূমিকা রাখছে। সামাজিক মাধ্যমেও শ্রমিকদের কণ্ঠস্বর এখন অনেক বেশি শোনা যাচ্ছে। এটি একটি ইতিবাচক দিক। তবে শ্রমিক আন্দোলন প্রায়ই দমন-পীড়নের মুখে পড়ে। অনেক সময় শ্রমিক নেতাদের হেনস্তা বা হয়রানির শিকার হতে হয়। তাই শ্রমিকদের অধিকার প্রতিষ্ঠায় সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় মনোভাবের পরিবর্তন অপরিহার্য।
সামনে পথ কতদূর?শ্রমিকদের অধিকার রক্ষা করতে হলে কেবল আইন প্রণয়ন যথেষ্ট নয় বরং তার কঠোর বাস্তবায়ন জরুরি। শ্রম পরিদর্শন ব্যবস্থাকে আরও কার্যকর করা, ট্রেড ইউনিয়নের স্বাধীনতা নিশ্চিত করা এবং কর্মক্ষেত্রে মানবিক পরিবেশ সৃষ্টি করা প্রয়োজন। একটি টেকসই ও ন্যায়ভিত্তিক অর্থনীতি গড়ে তুলতে হলে শ্রমিকদের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি বদলানো জরুরি। শ্রমিকেরা কেবল একটি উৎপাদনের ‘যন্ত্র’ নয়, তারা এই দেশের উন্নয়নের প্রকৃত নায়ক।
Advertisement
এসইউ/জিকেএস