আন্তর্জাতিক

ভারতের পক্ষে কি পাকিস্তানে সিন্ধু নদের পানি প্রবাহ আটকানো সম্ভব?

ভারতের পক্ষে কি পাকিস্তানে সিন্ধু নদের পানি প্রবাহ আটকানো সম্ভব?

ভারত-পাকিস্তান সম্পর্কের নতুন উত্তেজনার প্রেক্ষাপটে ফের উঠে এসেছে একটি পুরোনো প্রশ্ন—ভারত কি সত্যিই পাকিস্তানে প্রবাহিত সিন্ধু নদী এবং এর দুই প্রধান উপনদী জেলাম ও চেনাবের পানি থামাতে পারবে?

Advertisement

এই প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে সিন্ধু পানিচুক্তি সাময়িকভাবে স্থগিত রাখার ব্যাপারে ভারতের সিদ্ধান্ত। ১৯৬০ সালের এই চুক্তি ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে ছয়টি নদীর পানি বণ্টনের কাঠামো নির্ধারণ করে দেয়। এটিকে দক্ষিণ এশিয়ায় সীমান্তবর্তী পানি ব্যবস্থাপনার সফল উদাহরণ হিসেবে দেখা হতো। এই চুক্তি দুই পারমাণবিক শক্তিধর দেশের মধ্যে যুদ্ধকালেও বহাল ছিল।

কিন্তু গত ২২ এপ্রিল ভারতশাসিত কাশ্মীরে ভয়াবহ সন্ত্রাসী হামলার জন্য পাকিস্তানকে দায়ী করে সিন্ধু পানিচুক্তি স্থগিতের ঘোষণা দেয় ভারত, যদিও ইসলামাবাদ সেই অভিযোগ অস্বীকার করেছে। পাল্টা পদক্ষেপ হিসেবে পাকিস্তানও হুঁশিয়ার করেছে যদি ভারত পানি আটকে দেয়, তাহলে সেটিকে ‘যুদ্ধ ঘোষণা’ হিসেবে বিবেচনা করবে তারা।

কী বলে চুক্তি?

চুক্তি অনুযায়ী, সিন্ধু অববাহিকার পূর্বের তিনটি নদী—রাভি, বিয়াস ও শতদ্রু—ভারতের জন্য বরাদ্দ, আর পশ্চিমের তিনটি—ইন্দাস, জেলাম ও চেনাব—প্রধানত পাকিস্তানের জন্য (প্রায় ৮০ শতাংশ) নির্ধারিত।

Advertisement

আরও পড়ুন>>

পানি আটকানো যুদ্ধ ঘোষণার শামিল: ভারতকে কড়া হুঁশিয়ারি পাকিস্তানের পাকিস্তানের পদক্ষেপে বিপাকে ভারতের এয়ারলাইনসগুলো সিমলা চুক্তি কী, স্থগিত হলে ভারতের ওপর প্রভাব পড়বে?

ভারত এদের কিছু অংশের পানি ব্যবহার করতে পারলেও বড় বাঁধ বা প্রকল্প গড়ার আগে পাকিস্তানের সঙ্গে তথ্য ভাগাভাগির বাধ্যবাধকতা ছিল। এখন ভারত বলছে, তারা এই শর্ত মানবে না।

পানি আটকানো কি বাস্তবসম্মত?

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাস্তবতা হলো—ভারতের পক্ষে এই মুহূর্তে পশ্চিমাঞ্চলীয় নদীগুলোর বিশাল পরিমাণ পানি আটকে রাখা বা অন্যদিকে প্রবাহিত করা প্রায় অসম্ভব। কারণ:

- ভারতের বিদ্যমান অবকাঠামোর বেশিরভাগই ‘রান অফ দ্য রিভার’ প্রকল্প, যেগুলো পানি ধরে রাখে না, বরং প্রবাহিত পানির গতি ব্যবহার করে বিদ্যুৎ উৎপন্ন করে।- নদীর গতিপথ পরিবর্তনের মতো বিশাল খাল বা জলাধার গড়ে তোলার জন্য ভারতের কাছে পর্যাপ্ত অবকাঠামো নেই।- পর্বতময় কঠিন ভূ-প্রকৃতি এবং অভ্যন্তরীণ বিরোধের কারণে নতুন বাঁধ বা প্রকল্প বাস্তবায়নে দেরি হবে।

Advertisement

যদিও বর্ষাকালে অতিরিক্ত পানির প্রবাহ রোধ করা অসম্ভব, তবে শুষ্ক মৌসুমে—যখন পানির চাহিদা বেশি এবং প্রাপ্যতা কম—তখন ভারত চাইলে বিদ্যমান অবকাঠামো থেকে কিছুটা পানি ধরে রাখতে পারলে পাকিস্তানে কৃষি ও জলবিদ্যুৎ উৎপাদনে প্রভাব ফেলতে পারে।

তাছাড়া, চুক্তি অনুযায়ী ভারতকে পাকিস্তানের সঙ্গে বন্যার পূর্বাভাসমূলক হাইড্রোলজিক তথ্য ভাগাভাগি করতে হতো। ভারত এখন তা বন্ধ করতে পারে—যা বিশেষ করে বর্ষাকালে পাকিস্তানের জন্য সমস্যার কারণ হতে পারে।

পানি কি অস্ত্র হয়ে উঠতে পারে?

বিশেষজ্ঞদের মতে, পানি ‘অস্ত্র’ বা ‘ওয়াটার বম্ব’ হিসেবে ব্যবহার করা খুবই বিপজ্জনক কৌশল। ভারতের বাঁধগুলো সীমান্ত থেকে অনেক দূরে, হঠাৎ পানি ছেড়ে দিলে প্রথমে ভারতের এলাকাই প্লাবিত হওয়ার ঝুঁকিতে পড়বে। তবে হঠাৎ সিল্ট বা পলিমাটি ছাড়া হলে পাকিস্তানে ক্ষতির আশঙ্কা থেকে যায়।

বড় প্রেক্ষাপট: চীনও একটি পক্ষ

সিন্ধু নদীর উৎপত্তি তিব্বতে, যা চীনের নিয়ন্ত্রণাধীন। অন্যদিকে, ব্রহ্মপুত্র (ভারতে যমুনা নামে প্রবাহিত) নিয়েও ভারত ও চীনের মধ্যে টানাপোড়েন রয়েছে।

২০১৬ সালে কাশ্মীরে হামলার পর ভারত যখন ‘রক্ত ও পানি একসঙ্গে প্রবাহিত হতে পারে না’ বলে মন্তব্য করে, তখন চীন পাকিস্তানের পাশে দাঁড়িয়ে ব্রহ্মপুত্রের একটি উপনদী আটকে দেয়।

এ অবস্থায় ভারত যদি ইচ্ছা করে, তাহলে আইনি শর্ত শিথিল করে ধাপে ধাপে পানি ব্যবস্থাপনায় কৌশলগত পরিবর্তন আনতে পারে। কিন্তু বর্তমান বাস্তবতায়—প্রযুক্তিগত সীমাবদ্ধতা, ভূপ্রকৃতির জটিলতা ও অভ্যন্তরীণ প্রতিরোধের কারণে—ভারতের পক্ষে হঠাৎ করে পাকিস্তানে প্রবাহিত পানি থামানো বা ঘুরিয়ে দেওয়ার মতো আগ্রাসী পদক্ষেপ নেওয়া সহজ নয়।

সূত্র: বিবিসিকেএএ/